প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন আলোর মুখ দেখেনি এক দশকেও by মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন,

০তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস আজ শনিবার। বিশ্বের প্রায় সব দেশের মতোই দেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে দিবসটি। যাদের নিয়ে ঘটা করে দিবসটি পালন করা হয়, সেই প্রতিবন্ধীরাই এখনো রয়ে গেছে আড়ালে-আবডালে। বয়সের সামঞ্জস্যতা এবং নিয়ম-নীতির গোলকধাঁধায় আটকে যায় তারা। ফলে নূ্যনতম ভাতাটুকু জোটাতেও অনেককে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকেই আবার আসতেও পারেনি ভাতার আওতায়।


প্রতিটি সরকার দিবসটি উপলক্ষে তাদের নিয়ে কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি ও সভা-সেমিনারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, নানা প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বদলায়নি তাদের জীবনচিত্র।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। সে হিসাবে দেশে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখেরও বেশি প্রতিবন্ধী রয়েছে। এই প্রতিবন্ধীদের ৮০ শতাংশ গ্রামে বাস করে। যেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। ২০০১ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন। এ আইনে দেশের প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ প্রতিবন্ধীর জন্য বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া, সরকারি নন-গেজেটেড চাকরির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, সাধারণ পরিবহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন ও স্বল্প ভাড়ার সুবিধা দেওয়ার বিধান, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া, হাসপাতালে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণ, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে সাহায্য দেওয়া এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া_এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মূক ও বধির শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক স্তরের ১২টি স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিকে রূপান্তর করাও ওই আইনে রয়েছে। এ ছাড়া বহুতল সরকারি ভবনে যাতায়াতের জন্য প্রতিবন্ধীরা যাতে লিফটে হুইল চেয়ার নিয়ে উঠতে পারে, সে কারণে পৃথক ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করার বিধানও এ আইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলায় একটি করে মোট ৬৪টি স্কুলে দৃষ িপ্রতিবন্ধীদের সমন্বিত শিক্ষা দেওয়ার কথাও রয়েছে ওই আইনে।
এদিকে বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক কার্যবিবরণী এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিবন্ধীদের অধিকারসংক্রান্ত ১৯৯৩ সালের এসকাপ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী দেশ।
এত কিছুর পরও এ দেশের প্রতিবন্ধীদের দিন কাটে অবজ্ঞা আর অবহেলায়। তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে গঠিত আইন কেবল আইনের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা তাদের নিয়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ বিষয়ে সরকারি কোনো তৎপরতা নেই। বয়সের হিসাবে আটকে যায় প্রতিবন্ধী ভাতা। আগে ৩০ বছরের কম বয়সী প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেওয়ার বিধান না থাকলেও বর্তমান সরকারের নতুন নীতিমালায় ছয় বছরের ওপরের সব প্রতিবন্ধীই ভাতার আওতায় পড়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এ নীতিমালার আওতায় পড়া প্রতিবন্ধীদের ৯০ শতাংশও ভাতা পাচ্ছে না কোটা নির্ধারণ জটিলতার কারণে।
কেউ জন্মের পর প্রতিবন্ধী হয়, আবার কেউ প্রতিবন্ধী হয়েই পৃথিবীর আলো দেখে। এর পরই দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতা। দৃষ্টি, বাক, শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধিতাই বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী নারীরা দ্বিগুণ প্রতিবন্ধকতার শিকার। প্রতিবন্ধিতা প্রথম এবং নারী হওয়াটা তাদের প্রতি আরেক বৈষম্যের কারণ। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রাথমিক পুনর্বাসন সেবা এবং অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্র অত্যন্ত সীমিত। এমনকি প্রতিবন্ধিতা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের মধ্যেও রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণ ও সুযোগের অপ্রতুলতা রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিবন্ধীরা প্রতিনিয়তই থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশের প্রায় ১৬ লাখ প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে ৭৫ শতাংশকে উদ্যোগ ও যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সাধারণ স্কুলে পাঠানো সম্ভব। এর বাইরেও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণ এবং তাদের প্রতি বৈষম্যের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.