মন্দার পূর্বাভাস-প্রস্তুত হতে হবে এখনই
বিশ্ব অর্থনীতিতে আবারও মন্দার আভাস ঘনীভূত হয়েছে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত মহামন্দার মুখোমুখি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রত্যক্ষ অভিঘাত পড়েছিল ইউরোপের দেশগুলোতে। সে মন্দার ক্ষত পুরোপুরি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই নতুন আরেক মন্দার খবরে ইতিমধ্যে ভ্রূকুঞ্চিত হয়েছে অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বেকারত্বের ক্রমবর্ধমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য নানা পরিকল্পনা, বেইল আউটের নানা উদ্যোগের
পরও মন্দার প্রভাব পুরোটা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। ইউরোপ এবার মন্দার মুখোমুখি। ইউরো-জোনের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে মন্দার প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছেন। দু'বছর আগের সংকটের পর নতুন সংকটকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে মন্দার সংকটের পাশাপাশি চলছে মন্দা মোকাবেলা ও মন্দা থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজার প্রস্তুতিও। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার অভিঘাত কতটুকু পড়বে? গত মন্দায় আশঙ্কা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ প্রভাব খুব বেশি পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের সংশ্লিষ্টতা বেশি, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তুলনামূলকভাবে কম বলে প্রতিবেশী বড় অর্থনীতিগুলোর তুলনায় মন্দার বাতাস আমাদের কমই কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্রভাব যা পড়েছে তাকে অর্থনীতির ভাষায় বিলম্বিত প্রভাব বলে আখ্যায়িত করা হয়। মন্দার প্রভাবে আমাদের জনশক্তি রফতানির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে বিগত অর্থবছরে। মন্দায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট খাতে। একদিকে জনশক্তি রফতানির নিম্নহার, অন্যদিকে কাজ হারানোর ফলে রেমিট্যান্সের পড়তি বড় একটি সমস্যা। তবে সমস্যার কেন্দ্র যেখানে সেই ইউরোপ ও আমেরিকা আমাদের ৩০% রেমিট্যান্সের জোগানদাতা। রেমিট্যান্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মন্দার প্রভাব পড়বে কি-না, পড়লে কতটা তার ওপর নির্ভর করছে এ দেশের বাজারে মন্দার প্রভাব। রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ অবৈধ পন্থায় হুন্ডির মাধ্যমে আসে। এক্ষেত্রে বৈধ পন্থাকে উৎসাহ দিতে পারলে তা সহায়ক হতে পারে। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা। মন্দায় সেখানকার চাহিদা কমলে আবশ্যিকভাবে বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব পড়ার কথা। তবে গত মন্দায় সে প্রভাব খুব বেশি অনুভূত হয়নি। এর কারণ, আমাদের পণ্যের বিশেষ ক্রেতাশ্রেণী। বিশেষায়িত পণ্যের সুবিধা যেমন ছিল তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তামূলক উদ্যোগও ছিল। মন্দা মোকাবেলায় নগদ সহায়তার যে প্যাকেজ গত মন্দার পর নেওয়া হয়েছিল তা এখনও কার্যকর আছে। ভবিষ্যৎ সমস্যা মোকাবেলা করার স্বার্থে সহায়তা অব্যাহত রাখা দরকার। নতুন বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ইউরোপ-আমেরিকায় বাজার হারানোর আশঙ্কায় বিকল্প বাজার অনুসন্ধান বেগবান করা যেতে পারে। রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে এখনই করণীয় নির্ধারণ করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। মন্দা এখনও পুরো আঘাত হানেনি, তাই করণীয় নির্ধারণের কিছু সময় আমাদের হাতে আছে। তবে সে করণীয় দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও শেয়ারবাজারে মন্দার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে না বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। বৈদেশিক ঋণ কমে যাওয়ায় সরকার ইতিমধ্যে বাজেট ঘাটতি মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ উৎস ও ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণের সুযোগ কমলে নতুন সংকট ঘনীভূত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারেও নতুন কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। মন্দা আবশ্যিকভাবেই নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে। নতুন সংকটের কথা মাথায় রেখে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার এখনই সময়।
No comments