আন্তর্জাতিক-যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান উত্তেজনা by আয়েশা সিদ্দিকা

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের একটা যুক্তি হলো_ আফগান সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, তখন হাক্কানি নেটওয়ার্কসহ এদের অন্য গ্রুপগুলোকেও একই রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা উচিতদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা নিয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় মতবিনিময় সভা ডেকেছিলেন।


আফগানিস্তানে যুদ্ধ অবসানের পদ্ধতি নিয়ে ইসলামাবাদ এবং ওয়াশিংটন দূরে সরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সাম্প্রতিক হাক্কানি নেটওয়ার্কের ওপর পাকিস্তান হামলা চালাতে সম্মত না হওয়াটা ইসলামাবাদের সঙ্গে বিরোধের মূল কারণ। এই নেটওয়ার্ক আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ সমস্যায় ফেলেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি মিডিয়ার যুদ্ধের ত্রাহি রব তোলার বিষয়টি লক্ষণীয়। কিছু কিছু টিভি চ্যানেল তো যুদ্ধের গানও বাজাতে শুরু করেছে। আর এসবই করা হচ্ছে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য একতরফা হামলার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই। এ নিয়ে এখন আলোচনা এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, কারও পক্ষেই সরকারি অবস্থানের বিপক্ষে টুঁ শব্দটি করার জো নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী হাক্কানি নেটওয়ার্কের ওপর হামলা চালানোর যৌক্তিকতা নিয়েও কেউ আলোচনা করার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ চেয়ারম্যান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন হাক্কানি নেটওয়ার্ককে সমর্থন দেওয়ার জন্য আইএসআইর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দিলেও পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আদৌ চিড় ধরার চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হয়নি। হাক্কানি নেটওয়ার্ককে অব্যাহতভাবে পাকিস্তানের সমর্থন দেওয়া নিয়ে ওয়াশিংটনে অনেকেই বিরক্ত। ২০০০ সালের দিকে ওয়াশিংটনের চাপে পাকিস্তান তালেবান ও আল কায়দার বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে অভিযান চালালেও হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার দাবি এড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঐতিহাসিকভাবেই তালেবানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনার পক্ষপাতী নয়। কারণ তারা এদের মনে করে পাকিস্তানের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার। ফলে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে নেক মোহাম্মদ, বায়তুল্লাহ মেহসুদ, হেকিমুল্লাহ মেহসুদ ও অন্যদের মতো তালেবান নেতাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত প্রতিটি অভিযানের সমাপ্তি টানে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে। আর এটা ওয়াশিংটনকে স্বাভাবিকভাবেই বিরক্ত করে। অন্যদিকে পাকিস্তান অভিযোগ করে, তাদের রাষ্ট্র যাদের দ্বারা আক্রান্ত সেই তালেবানের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি।
তালেবানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার পক্ষে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রধান যুক্তি হচ্ছে তাদের জাতিগত পরিচিতি। বস্তুত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ২০ শতাংশই এই পশতুন জনগোষ্ঠী থেকে এসেছে। এসব যোদ্ধার কারও কারও সঙ্গে, বিশেষ করে সিরাজ উদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে আশির দশক থেকেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সখ্য। সে সময় আইএসআই ও সিআইএ এদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছিল। তালেবানও তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রত ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে সিআইএ এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানের আইএসআই এই সম্পর্ককে ধরে রাখে। তাদের নিরস্ত্র করা বা ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপ তখন নেওয়া হয়নি। মধ্য এশিয়া ও আরব যোদ্ধাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা বা তাদের পাকিস্তানের পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারেও কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি তখন।
যখন ২০০১ সালে এদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্ন এলো তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশতুন যোদ্ধা এবং আল কায়দা যোদ্ধার মধ্যে পার্থক্য রেখা টানল। সাধারণত আল কায়দা মধ্য এশীয় ও আরবদের নিয়ে গঠিত। ওসামা বিন লাদেন গত ২ মে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত এক অভিযানে নিহত হওয়া আগ পর্যন্ত তার ওপর কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। ওসামা ছাড়া অন্য অনেক আল কায়দা নেতাকে পাকিস্তান ধরে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তান একাই তালেবানের সঙ্গে ডিল করবে_ এই শর্তই তখন ছিল।
তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে নেক মোহাম্মদ, বায়তুল্লাহ মেহসুদ, হাকিমুল্লাহ মেহসুদের মতো নতুন প্রজম্মের তালেবান নেতাদের সংঘাত নিয়ে আসে। তারা সবাই প্রধানত দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানভিত্তিক ছিল। তারা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী বিবেচনা করে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করার মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই বিরোধ অবসানের চেষ্টা করে। ২০০৯ সালের আগস্টে বায়তুল্লাহর মৃত্যুর পর একই বছর চূড়ান্ত সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়। এই গ্রুপটি এখন হেকমতুল্লাহ পরিচালনা করে, সে নিজে পাকিস্তানবিরোধী এবং তার পরিচালিত সংগঠনের নাম তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান। আফগান তালেবান ও হাক্কানি গ্রুপ থেকে এই তালেবান গ্রুপটি ভিন্ন প্রকৃতির। সম্প্রতি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, অবন্ধুসুলভ মেহসুদকে হত্যা করার জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ক চেষ্টা চালাচ্ছে।
এক সময়ের আফগান যোদ্ধা জালালউদ্দিন হাক্কানির ছেলে সিরাজউদ্দিন হাক্কানি, মোল্লা নাজির ও হাফিজ গুলবাহাদুরের সমন্বয়ে হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। এসব যোদ্ধা প্রধানত আফগান। এরা ১৯৮০ সালের দিকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পাকিস্তান আসে। গ্রুপিংয়ের জন্য এরা উত্তর ওয়াজিরিস্তানকেই কাজে লাগায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদের বন্ধুভাবাপন্ন মনে করে এবং আফগান যুদ্ধ অবসানের ভবিষ্যৎ যে কোনো ব্যবস্থায় এরা পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক হবে বলে পাকিস্তান মনে করে। আর এসব ভবিষ্যৎ আফগান নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাবে না তার নিশ্চয়তার জন্যই।
জিন্নাহ ইনস্টিটিউট-এইএসআইপি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে আফগান সমস্যার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনাকে সমর্থন জানানো হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকদের একটা যুক্তি হলো_ আফগান সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে, তখন হাক্কানি নেটওয়ার্কসহ এদের অন্য গ্রুপগুলোকেও একই রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা উচিত।
কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে হামলা বা আফগানিস্তানে তালেবানের হামলা বিস্তার করার ঘটনা সম্ভবত আলোচনার আগে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের পুরনো খেলারই অংশ। অন্যদিকে ইসলামাবাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে তালেবান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায় আলোচনায় তার নিজের অবস্থান সুসংহত করার একই উদ্দেশ্যে। তবে এই পর্যায়ে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের ফলে পাকিস্তানের অবস্থানটা উত্তর কোরিয়ার মতো হয়ে যেতে পারে, যেখানে আফগান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।

আয়েশা সিদ্দিকা :পাকিস্তানি নিরাপত্তা বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর : সুভাষ সাহা
 

No comments

Powered by Blogger.