যেভাবে বিষাক্ত হয়ে গেল মিরপুরের উইকেট

ক্যায়া উইকটো (উইকেট) বানায়া ইয়ার? বল ইধার সে উধার ঘুমনে রাহা হ্যায়', স্লিপে দাঁড়ানো পাকিস্তান অধিনায়ক মিসবাহ-উল হকের এ বিস্ময় বাংলাদেশি এক ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ করে। যে কৌতুকের কারণ, কেউ 'হোম অ্যাডভান্টেজ' এভাবে প্রতিপক্ষকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়? অতিথি দলের বোলিং আক্রমণ স্পিন বিষে ভরপুর জেনেও কিনা স্পিনসহায়ক উইকেট বানিয়েছে বাংলাদেশ!


বছরে তিনবার আর টোয়েন্টি টোয়েন্টি যোগ করলে চারবার। একেবারে তাজা ব্যর্থতা বলতে টানা দুই ম্যাচে (একটি করে টোয়েন্টি টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে) এক শ'র নিচে অল আউট হয়েছে বাংলাদেশ। দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ ইনিংস সংক্ষিপ্ত হয়েছে পাকিস্তানের স্পিনার চতুষ্টয়ের জাদুতে। অবশ্য মিসবাহ তো বটেই, বাংলাদেশ দলের এক ব্যাটসম্যানেরও উপলব্ধি, 'এখানে খুব বড় টার্নার হওয়ার দরকার নেই। পিচে বল পড়েই বিশাল টার্ন নিচ্ছে।' সেখানে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান তো টার্ন পাবেনই। মুশকিল হলো পাকিস্তান দল সে সুবিধা পাচ্ছে আরো বেশি। সাঈদ আজমল, শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিক এবং মোহাম্মদ হাফিজ বল ঘোরাচ্ছেন পছন্দের মাপে। উইকেট নিচ্ছেন নয়তো নিদেনপক্ষে রানের চাকা চেপে ধরছেন অনায়াসে। তাতে স্কোর বোর্ড সচল রাখা দূরের কথা, ক্রিজে টিকে থাকাই দুরূহ হয়ে উঠেছে তামিম ইকবালদের জন্য। টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ৮৫ আর প্রথম ওয়ানডেতে ৯১ মিলিয়ে ১৭৬ রানে ১৯ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ।
অবশ্য শুধু বাংলাদেশই নয়, মিরপুরের উইকেট রহস্যের জালে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদেরও। নইলে ২০ ওভারের ক্রিকেটের সফলতম দল কেন ৭ উইকেটে ১৩৫ রান তুলেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে? ওয়ানডেতে প্রতিপক্ষের মামুলি টার্গেট পেরিয়ে যেতেও হারিয়ে বসে ৫ উইকেট। ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্যের জোরেই দুই ম্যাচ জিতে বেরিয়েছে পাকিস্তান।
উইকেটে শুধু টার্ন থাকলেও কথা ছিল। কিন্তু মিরপুরের উইকেটে এখন বল পড়ে কোন দিকে যাবে, সেটি বোলারের চিন্তাশক্তিকেও হার মানিয়ে যাচ্ছে! তাই নিখাদ স্পিন উইকেট বানিয়ে হোম অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা বাংলাদেশের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে, বিষয়টি পুরোপুরি এমন নয়। পাকিস্তান সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের পর মিরপুরের উইকেট আদৌ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। যে উইকেটে বল পড়ে নিজের ইচ্ছায় গতি বদলায়, সেটি তো আন্ডার প্রিপেয়ার্ড উইকেটই!
এদিকে উইকেট নিয়ে প্রশ্ন তুললে কিউরেটরের রক্তচাপ বেড়ে যায়। বাংলাদেশে তা আরো বেশি। ম্যাচ-পরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে তাই কিউরেটরও কান পেতে থাকেন যে উইকেট নিয়ে আবার কেউ কিছু বলল কি না। কথিত আছে, বাংলাদেশ দল থেকে এ জাতীয় কোনো মন্তব্য বেরিয়ে পড়লে কিউরেটরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বোর্ড কর্মকর্তারা। ক্রিকেটের অভিভাবক হিসেবে সেটি করতেই পারেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের বলবে কে?
উইকেট নিয়ে মিসবাহ এবং বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের পরোক্ষ অসন্তোষ থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছেন মিরপুর মাঠের দীর্ঘ সময়ের কিউরেটর বদিউল আলম খোকন। কারণ বিশ্বকাপে ভারতের ৩৭০, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের ৫৮ ও ৭৮ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেই নাকি এখন তিনি 'ওএসডি'। তাই মিরপুরের মাঠ পরিচর্যা করছেন শ্রীলঙ্কার গামিনি ডি সিলভা। যাঁর মুখে সিরিজ শুরুর আগেই অদৃশ্য 'টেপ' লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বোর্ডের পক্ষ থেকে। যেন উইকেট নিয়ে আগাম মন্তব্য না করেন সিলভা। পেশাদারিত্বের যুগে এটা একেবারে বেমানান নয়। পেশাদারিত্বের ধোয়া তুলে ক্রিকেটকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বিলি করছেন তাঁরা নিরন্তর।
তবে পেশাদারিত্বের নমুনা বোর্ড কর্মকর্তাদের আসল কাজে কতটুকু আছে, তা সংশয়াচ্ছন্ন। ক্রিকেট মাঠ পরিচর্যার জন্য পর্যাপ্ত সময় দরকার। সে কাজটি বদিউল কিংবা গামিনি অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল রাসেল, যিনি-ই করুন না কেন। কিন্তু সে সময় কতটা পান মিরপুর মাঠের কিউরেটর? একমাত্র ধুম বর্ষাকাল ছাড়া মিরপুরের মাঠ বিশ্রামই পায় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়মিত ব্যাপার। এর সঙ্গে ঘরোয়া আসরের প্রিমিয়ার ডিভিশন এবং জাতীয় লিগের কিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। আছে প্রথম বিভাগ ফাইনাল থেকে শুরু করে জেলা এবং স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল। মাঝে বিদেশি দলের সঙ্গে 'এ' দল এবং একাডেমী কিংবা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যাচ। মেয়েদের ক্রিকেট এলে মিরপুর মাঠের জন্য গ্রাউন্ডস কমিটিতে ধর্না দেওয়া হয় উইমেন্স উইংয়ের পক্ষ থেকে। মোটকথা, যে কোনো ফাইনাল সে যে পর্যায়েরই হোক না কেন, তা অনুষ্ঠিত হতে হবে মিরপুরেই। কারণ সেটিতে পুরস্কার বিতরণের ব্যাপার আছে। মিরপুরে ক্রিকেট বোর্ডের অফিস। তাই পুরস্কার প্রদানকারীর বড্ড সুবিধা হয়। আর মিরপুরে পুরস্কার বিতরণ করা মানে সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আত্মপ্রচারের সুবর্ণ সুযোগটাও তো থাকে! এর বাইরে বছরজুড়ে জাতীয় দলের প্রস্তুতি, প্রস্তুতি ম্যাচ কিংবা ম্যাচ পরিস্থিতিতে ব্যাটিংয়ের সুযোগ দিতে গিয়ে দিনের পর দিন পরিচর্যাটা পড়ন্ত বিকেলে করতে হয় কিউরেটরকে। কখনো কখনো সে সুযোগও মেলে না।
অথচ উইকেট প্রস্তুতির জন্য এ সময়টা খুব দরকার। এখানে ২০০১ সালে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফরের একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। বুলায়েতে সিরিজের প্রথম টেস্টের আগে কুইন্স পার্ক মাঠের কিউরেটর বলছিলেন, 'এ উইকেটে সবশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছিল দেড় বছর আগে। মাঝে প্রথম শ্রেণীর একটি ম্যাচ খেলিয়েছি।' আর মিরপুরের একটি উইকেটে দেড় না, এক বছরে ক'টা ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় জানেন? সে হিসাব নিশ্চিত করা কঠিন। তবে গড়পড়তা প্রতিটি উইকেটে ২৫ দিন ক্রিকেট খেলা হয়। গড়পড়তা এ কারণেই যে মিরপুরে উইকেট আছে আটটি। আর সব ধরনের ম্যাচ মিলিয়ে অনূ্যন ২০০ দিন খেলা হয় মিরপুরে।

No comments

Powered by Blogger.