জলবায়ু পরিবর্তনে-আধুনিক মানুষের উদ্ভব by এম হুসাইন

প্রায় বিশ লাখ বছর আগেদীর্ঘস্থায়ী এক তীব্র খরায় আক্রান্ত হয়েছিল পৃথিবী। গাছপালা পুড়ে সাবাড় হয়ে গিয়েছিল বনাঞ্চল। তখনই উদ্ভব হয়েছিল হোমো ইরেকটাসের, যারা গাছ থেকে নেমে এসেছিল মাটিতে। ঘাসে আচ্ছাদিত সমতল ভূমিতে দৌড়াতে এবং শিকার করতে শিখেছিল। এই হোমো ইরেকটাস আজকের আধুনিক মানুষের প্রারম্ভিক মানবজলবায়ুর পরিবর্তনই জন্ম দিয়েছিল ওই হোমো ইরেকটাসের। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি যে আজকের


আধুনিক মানবের বিকাশও ওই জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরেই। গত বিশ লাখ বছর ধরেই জলবায়ু পরিবর্তন মানবের বিবর্তন ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। বাধ্য করেছে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে, নতুন নতুন জায়গার সন্ধান করতে। একত্রে কাজ করতে এবং গোত্রবদ্ধ হতে।
অতি উষ্ণ বা অতি শীতল জলবায়ু শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। জলবায়ুর বিরূপতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের এ সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের এ গুণগান পাগলের প্রলাপ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন পাঁচটি বিশেষ সময়কাল। ওই সময়গুলোতে মানুষের সামাজিক ও জিনগত গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন ঘটেছিল। এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে মূল ভূমিকা রেখেছিল বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন।
বিশ লাখ বছর আগে তাপদাহের কারণে মানুষ সমতল ভূমিতে বসবাস ও দৌড়ানো এমনকি শিকার করা শিখতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বড় বিকাশটি ঘটে বরফ যুগে। যেটির শুরু হয় সাড়ে চার লাখ বছর আগে। বিজ্ঞানীদের ধারণা ওই সময় মানবজাতি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ইউরোপীয় মানব তখন রূপান্তরিত হয় নিয়ানডারথালে এবং এশিয়ান মানব পরিণত হয় ডেনিসোভান মানবে। অন্যদিকে যারা আফ্রিকা মহাদেশে রয়ে যায়, তারাই এক সময় পরিণত হয় আধুনিক মানবে। তবে তাদের এ রূপান্তর ঘটে ৬০ হাজার বছর আগে। দীর্ঘ এ সময় পর্যন্ত তাদের 'অপেক্ষা' করতে হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। ওই সময় দীর্ঘ এক উষ্ণ মৌসুম তাদের উত্তরের দিকে সরে যেতে বাধ্য করেছিল। পরবর্তী সময় ২৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার বছর আগে বরফ শীতল আবহাওয়া ঝেঁকে বসে পৃথিবীতে। দীর্ঘস্থায়ী সে শীতে বরফে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে গোটা পৃথিবী। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩৩০ ফুট নেমে যায়। উন্মুক্ত হয়ে পড়ে সাইবেরিয়ার সঙ্গে উত্তর আমেরিকার আলাস্কার যোগাযোগ স্থাপনকারী বেরিং প্রণালি। এতে তৎকালীন মানবের পক্ষে প্রণালি পার হয়ে উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়। এ সময়ের পর ১৪ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর আগে তাপমাত্রায় দেখা দেয় ব্যাপক উত্থান-পতন। বিরূপ আবহাওয়ায় মানুষ নিজেদের পরিবর্তনে বাধ্য হয়। পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে উদ্ভাবন করে চাষাবাদ পদ্ধতির। যা তাদের বিরূপ পরিস্থিতিতেও খাবারের নিশ্চয়তা দেয়।
দ্য অরিজিন অব আওয়ার স্পিসিসের লেখক লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ক্রিস স্টিঙ্গারের মতে, আমাদের বিবর্তনে জলবায়ু পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তার মতে, ওই জলবায়ুর পরিবর্তন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল যে আমাদের পূর্বপুরুষরা গাছ থেকে মাটিতে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিল। এরাই একসময় আফ্রিকা ও পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
গবেষণাকর্মটি এমন সময় প্রকাশিত হলো যখন জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞানীদের জন্য রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি মাসেই ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) জানিয়েছে, রাশিয়ার মতো তীব্র তাপপ্রদাহ বা আফ্রিকার মতো খরা এখন বিশ্বে খুব ঘন ঘনই দেখা দেবে। এতে বিশ্বের অনেক অঞ্চলই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। একবিংশ শতকে তাপমাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে গরম, কমে যাবে শীত।
বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনও আমাদের জন্য উপকারী_ এমনটি বলছেন না জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব বিবর্তনের যোগসূত্র গবেষণাকারীরা। না বলার কারণ মোটেও অস্পষ্ট নয়। বিশ লাখ বছর আগে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তার সুন্দর একটি ফল পাওয়া গেছে চৌদ্দ থেকে দশ হাজার বছর আগে। আর বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনে মানব সভ্যতার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, আধুনিক বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনও কোনো এক মঙ্গলময় যাত্রার সূচনা করবে হয়তো। কিন্তু তার জন্য কত লাখ বছর, কত হাজার প্রজন্মকে আত্মোৎসর্গ করতে হবে, কে জানে?

No comments

Powered by Blogger.