প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে সবার নজর রোহিঙ্গা সমস্যায়-* তালিকাভুক্তরা শর্ত সাপেক্ষে ফিরতে চায় -* বড় সমস্যা তিন লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী by তোফায়েল আহমদ,

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন মিয়ানমার সফরকে ঘিরে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। কক্সবাজারে উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থানকারী তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও চাইছে পরিবর্তিত মিয়ানমারে শর্ত সাপেক্ষে ফিরে যেতে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মূল ভাবনার কারণ দাঁড়িয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশাবাদী, আগামী ৫ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরকালে পুরো সমস্যার ইতিবাচক সমাধান বেরিয়ে আসবে।


রোহিঙ্গাদের অনেকেই মনে করছে, মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় অনেকটাই ভালো। প্রায় দুই দশক আগে যখন নিজের দেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছিল, তখনকার সঙ্গে আজকের মিয়ানমারের অনেকটাই ব্যবধান খুঁজে পাচ্ছে রোহিঙ্গা
শরণার্থীরা। ইতিমধ্যে দেশটিতে স্থানীয় ও পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তি পেয়েছেন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক যোগাযোগও বৃদ্ধি করেছে মিয়ানমার সরকার।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মন্ত্রিপর্যায়ের দুটি দল ঘুরে এসেছে মিয়ানমার। বিশাল সেনাবহর নিয়ে গত সপ্তাহে কক্সবাজার সফর করে গেছেন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ লে. জেনারেল সো উইন। এমন পরিস্থিতিতে দুই দশকের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের এফ ব্লকের বাসিন্দা শরণার্থী মমতাজ বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আঁরা দেশত ফিরত চাই। বাংলাদেশের হুকুমত শেখ হাসিনা আঁরার দেশত যাদ্দেই আঁরা খুশি। আঁরা আশা গরি, এবার এক্কান ফয়শালা অইব।' অর্থাৎ 'আমরা দেশে ফিরতে চাই। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা আমাদের দেশে যাচ্ছেন। তাই আমরা আনন্দিত। আমরা আশাবাদী, এবার কিছু একটা সমাধান হবে।'
রোহিঙ্গা নারী মমতাজ ক্যাম্প (শিবির) ব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) কো-চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, 'দেশে ফিরব না_এ রকম গোঁ ধরে আমরা আর বসে থাকব না। আমরা জেনেছি, আমাদের দেশের পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। তবে সেখানে আমাদের মর্যাদা দিতে হবে।'
কুতুপালং শিবিরের এ ব্লকের বাসিন্দা নুরুল হক মাঝি (৬০) মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা একসময় মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ার জন্য শিবিরে আন্দোলনও করেছি। কিন্তু এখন দেশে ফিরে যেতে চাই। কেননা আগের পরিস্থিতি এখন আর নেই। সেখানে নির্বাচন হয়েছে। এতকাল রোহিঙ্গাদের কোনো প্রতিনিধিও ছিল না। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আরাকান রাজ্যে দুজন রোহিঙ্গা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও তাঁরা মিয়ানমার সরকারের অনুগত লোক তবু তাঁরা রোহিঙ্গা মুসলিম।' চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনায় নিশ্চয়ই রোহিঙ্গাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন।
টেকনাফ সীমান্তের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরে যাওয়ার সংবাদে শিবিরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গারই মত হলো, তাদের দাবি-দাওয়াগুলোর আংশিক সমাধান হলেও তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তাদের এসব দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো মিয়ানমারকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা, রোহিঙ্গাদের সম-অধিকার ও আইডি কার্ড প্রদান, দেশত্যাগকালে সংঘটিত ক্ষতি পূরণ করা ও তাদের দিতে হবে যথাযথ মর্যাদা।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৯২ সালের জুন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী সময়ে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফিরে যায়। বর্তমানে দুটি শিবিরে ২৫ হাজার ৪৫ জন শরণার্থী দেশে ফেরার অপেক্ষায়। এর মধ্যে টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে ১৪ হাজার ৮১৪ ও কুতুপালং শিবিরে রয়েছে ১০ হাজার ২৩১ জন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার যুগ্ম সচিব ফিরোজ সালাউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০০৫ সালের মে থেকে ছয় বছর ধরে মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া সময়সীমায় রোহিঙ্গাদের যথাযথভাবে ফিরিয়ে দিতে বিলম্ব ঘটে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছামূলক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা বলে নানা অজুহাত সৃষ্টি করায় এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়।
আরআরআরসি কালের কণ্ঠকে জানায়, বর্তমানে শিবিরের ২৫ হাজার ৪৫ জন রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমারের ছাড়পত্র রয়েছে ১০ হাজার ২০৮ জনের। তা ছাড়া কানাডা, ইউকে, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে ৯২৬ জন রোহিঙ্গা।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা-সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, বন্ধ থাকা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম একবার শুরু হলেই দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মিয়ানমারের ছাড়পত্রপ্রাপ্তদের দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু হলে বাকি ১৫ হাজার শরণার্থীর প্রক্রিয়া শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না। তবে বিশাল সংখ্যার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বিষয়টির সমাধান খুঁজতে হবে সবার আগে।
অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তিন লক্ষাধিক : এদিকে ২৫ হাজার তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাইরে কক্সবাজারে অবৈধভাবে অবস্থান করছে তিন লক্ষাধিক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। এদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী জানান, টেকনাফ ও উখিয়ায় এ রকম অবৈধ প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীকে দুটি পৃথক স্থানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিরা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দা রোহিঙ্গা সমস্যায় জর্জরিত। তারা যেকোনো কাজে ভাগ বসায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর। এমনকি জেলা কারাগারেও রয়েছে প্রায় ৩০০ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। নানা অপরামূলক ঘটনায় তারা জড়িত। কারাগারে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে, যাদের জেল-জরিমানা শেষ হলেও আটকে রাখতে কারা কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে। কেননা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। জেলা প্রশাসক আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৃষ্ট সমস্যারও সুরাহা হবে।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, কক্সবাজারে অবস্থানকারী ২৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভরণ-পোষণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ পড়ছে স্থানীয় তথা জাতীয় জনজীবনে। এ জন্য অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর ওপর জোর দেওয়াটা জরুরি।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, 'আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনের গ্যাঁড়াকলে হয়তো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা এ রকম কোনো আইনের আওতায় না থাকা সত্ত্বেও তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য রীতিমতো উদ্বেগজনক।'
বিজিবি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে সীমান্তে পাঁচ শতাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে পুশব্যাক করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.