সদরে অন্দরে-কাঁটাতারে আটকে থাকুক মরণনেশার ইচ্ছাগুলো by মোস্তফা হোসেইন

প্রকাশ্য জনসভায় এমপি মহোদয় বললেন, 'কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা হচ্ছে ফেনসিডিল চোরাচালানিদের স্বর্গ।' নির্দিষ্ট করে বলে দিলেন, টানা ব্রিজের কাছে চোরাচালানিরা লেনদেন করে রাতের বেলা। সভাশেষে স্থানীয় মানুষ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জানায়। তাদের কথা_আসলেই কি চান্দলা চোরাচালানিদের স্বর্গ? সীমান্ত থেকে সাত-আট কিলোমিটার ভেতরের একটি জায়গা কিভাবে চোরাচালানের স্বর্গ হতে পারে?


আর স্বয়ং এমপিই যেখানে ফেনসিডিল বেচাকেনা কিংবা হাতবদলের জায়গার খোঁজ পর্যন্ত জানেন, তাহলে এত দিন পর্যন্ত ওই জায়গা থেকে চোরাচালানিরা ধরা পড়েনি কেন? তবে এখানে মাদক আসার ব্যাপারটি স্থানীয়দের কেউই অস্বীকার করেননি। বদনামের হেরফের হয়তো হতে পারে। আবার প্রশাসনের বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সাধারণ মানুষই। তাদের কথা_কারা চোরাচালানি, কারা চান্দলায় ফেনসিডিল আনছে, তা তো পুলিশ থেকে প্রশাসনের সবারই জানার কথা। ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার কারণে তো নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট দিয়েই এসব বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এটা তো জানা কথা। তার পরও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি কোন কারণে? যিনি মাদকস্বর্গ বলে ঘোষণা দিলেন তিনিও তো মাদক নিরোধ করতে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বাস্তব হচ্ছে, মাদকদ্রব্য আসা বন্ধ হয়নি। ব্রাহ্মণপাড়া থানার ওসি বললেন, 'অক্টোবর মাসে চোরাচালানির মামলা হয়েছে ১২টি। আর এমপি সাহেবের বক্তব্যের পর নভেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ৯টি। মাদকদ্রব্য আটকও হয়েছে সে সময়।' কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল, শালদা নদী, চান্দলা, সিদলাই, দুলালপুর, সাহেবাবাদের মতো বিভিন্ন গ্রামেই চলে ফেনসিডিলের ব্যবহার। সমানে আসছে মরণনেশার দ্রব্যগুলো।
কুমিল্লা শহরে ঢুকছে ফেনসিডিল, গাঁজা থেকে শুরু করে হরেক রকম দ্রব্য। এখানে কাপড়চোপড়ও আসে ওপার থেকে। চৌদ্দগ্রাম থেকে বিবিরবাজার হয়ে বিভিন্ন রুটে এসব আসে কুমিল্লায়। জেলা শহরেই প্রকাশ্যে ভারতীয় দ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনিয়ন্দ, মন্দবাগ, কর্নেলবাজার, আজমপুর, বাউতলা, বিজয়নগর এলাকা যেন মাদকের রাজ্য। সীমান্ত এলাকার যুবকদের একটি অংশ বুঁদ হয়ে থাকে মাদকের নেশায়। কাশিনগর গ্রামে চোরাচালানিদের গাঁজা রাখার জন্য ঘণ্টা হিসেবে ঘর ভাড়া দেওয়ার কথা সবারই জানা। আর এ কাজে এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোও জড়িত বলে শোনা যায়। এসব চোরাচালানের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পর্ক আছে বলে যে অভিযোগ আছে তা-ও কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? কিংবা সরকারের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করছে চোরাচালানিরা_এই অভিযোগও কি অস্বীকার করা যাবে? যেমন_আখাউড়া এলাকার সীমান্তবর্তী এলাকার কথাই ধরা যায়। বাংলাদেশ থেকে মাছ রপ্তানি হয় সেই পথে। বাংলাদেশ এই বাণিজ্য মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এটা খুবই আশার কথা। কিন্তু সেই সঠিক পথের আয়ও বাধাগ্রস্ত হয় চোরাচালানিদের কারণে। এবং অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের ভুল কিছু নীতি-নিয়মের সূত্র ধরে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মাছ রপ্তানিকারকদের অসুবিধা হচ্ছে নিয়মিত। তাঁরা রপ্তানির কাগজপত্র পেতে পেতে বেলা বেজে যায় সকাল ৮টা কিংবা ৯টা। যে কারণে ওপারের বাজারগুলো ধরা ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সুযোগটি গ্রহণ করে চোরাচালানিরা। তারা অবৈধপথে রাতের অন্ধকারে মাছ পেঁৗছে দেয় ওপারে। ওপারের ব্যবসায়ীরাও লুফে নেন এ সুযোগ। বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশের সরকার অবগত নেই, তা নয়। কারণ তাদের সামনে দিয়েই এসব হচ্ছে। দেশের স্বার্থে অফিস সময় এগিয়ে আনা কি অসম্ভব? ভোররাতেই যদি কাগজপত্র প্রস্তুত হয়ে যায়, তাহলে সকালের বাজার ধরা মাছ ব্যবসায়ীদের জন্য অসম্ভব কিছু নয়। আর এমনটি হলে নিশ্চয়ই চোরাচালানিরা সুযোগ গ্রহণ করতে পারত না। মাদকের নেশায় আমাদের যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বুঁদ হয়েও থাকছে। আর এর প্রতিফলন হিসেবে সমাজে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে। প্রশ্নও একের পর এক চলছেই। আশঙ্কা আর সন্দেহ কোনোটাই থেমে নেই। কী দুর্বিষহ অবস্থা।
সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেও একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। সবখানেই চোরাচালানি হয়ে ওপার থেকে ক্ষতিকর দ্রব্য প্রবেশ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যা যাচ্ছে তা অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য। সরকার এসব দ্রব্য থেকে লাখ লাখ টাকা দৈনিক শুল্ক আদায় করতে পারত। কিন্তু চোরাচালানিদের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। সুনামগঞ্জ এলাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান দ্রব্য ওপারে চোরাচালান হয়। এই পথে যা আসে, তা বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। শোনা যায়, দুয়ারাবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেদার অস্ত্র প্রবেশ করছে। মধ্যনগর দিয়ে ফার্নেস অয়েল থেকে শুরু করে ডিজেল পর্যন্ত নিত্য ওপারে যায়। যায় মুরগি ও মাছও। আসে সর্বনাশা মরণনেশা। গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ ঢুকছে দেশের মাটিতে। কালের কণ্ঠের সুনামগঞ্জের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করে জানা যায়, মাঝেমধ্যে বর্ডার গার্ড কিছু মাদকদ্রব্য আটক করে ঠিকই; কিন্তু তা আইওয়াশ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শেরপুরের সীমান্ত দিয়ে আসে চোরাই মোটরসাইকেল, আদা, ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে ঢোকে গরু। যায় গার্মেন্টস সামগ্রী, জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ, পাঙ্গাশ মাছ। হালুয়াঘাট থেকে রৌমারী পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার সীমান্তপথে চোরাচালানিরা গারো সম্প্রদায়ের লোকদের ব্যবহার করে। দুদিকেই গারো থাকার কারণে চিনতে অসুবিধায় হয় বিজিবির লোকজনের। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে এই অপকর্মে ব্যবহার করে গডফাদাররা নিরাপদ দূরত্বে থেকে যায়। মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে আসে মোটরসাইকেল। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে চোরাচালান হয় নিয়মিত। তবে কোনো কোনো জায়গায় বিশেষ বিশেষ দ্রব্য চোরাচালান হয়ে থাকে। যেমন_দিনাজপুরের বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিলের পাশাপাশি অস্ত্র বাংলাদেশে আসে। যায় তামা, কাঁসা ও পিতলের সামগ্রী। দিনাজপুর এলাকার সাংবাদিকদের ঝুঁকিতে থাকতে হয় সর্বক্ষণ। হিলি থেকে আসা আন্তনগর কিংবা লোকাল ট্রেনে প্রকাশ্যেই মসলা প্যাকেট হয়। কেউ ছবি তুললে ট্রেন থেকে নামার পর তার নিরাপত্তা দেওয়ার কেউ থাকে না। 'ট্রেনের ভেতরে ভারতীয় মসলার প্যাকেট হচ্ছে'_এই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একাধিকবার সাংবাদিককে মারাত্মক আহত হতে হয়েছে। দিনাজপুর এলাকার চোরাচালানিদের নিয়ন্ত্রণ করে বগুড়ায় অবস্থানকারী গডফাদাররা। এমন তথ্য জানা যায় স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে। কিন্তু প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে এবং তারা সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাদের টিকিটা স্পর্শ করারও কারো ক্ষমতা থাকে না।
দিনাজপুর এলাকায় করিডর দিয়ে গরু আসে। সে আলোকেই বর্ডার হাট চালু হলে অবৈধ অনেক কাজই বন্ধ হয়ে যেত। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল বর্ডার হাট চালু করার ব্যাপারে। তেমনি একটি হাট সুনামগঞ্জ জেলার দলুয়ায় এখনো চালু হয়নি সব কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার পরও। কবে নাগাদ হবে তা কে জানে। চোরাচালানের দ্রব্যগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে ভারত থেকে আসছে ধ্বংসাত্মক জিনিস। আর বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। নেশায় নেশায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছে সীমান্ত এলাকার হাজার হাজার যুবক-কিশোর। আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রামগুলোতে ফেনসিডিল তৈরির কারখানা আছে_এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু সেসব কারখানা থেকে যা উৎপাদন হচ্ছে তার প্রধান খদ্দের হচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির কি কোনো উপায় নেই? কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও কি আটকে রাখা গেছে মানবসভ্যতাবিধ্বংসী সেসব মরণনেশাকে? কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকে ফালানীর লাশ, কেন ঝোলে না মরণনেশার ইচ্ছাগুলো?
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.