ফরেনসিক ডিটেকশেন-জোড়া খুনের আসামি by হাসান খুরশীদ রুমী

ইলিয়াম ব্যালিস্থান : রুয়াওয়ারো, নিউজিল্যান্ডগুরুত্বপূর্ণ বিষয় : এই কেসটা শেষ হয় স্মরণীয় একটা বিচারের মাধ্যমে, যাতে আসামিকে দুটো খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, যদিও একজনের মৃতদেহ কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৩৩ সালের ১৬ অক্টোবর সোমবার, ক্রিস্টোবেল ল্যাকির মৃতদেহ একটি ফার্মের পুকুর থেকে টেনে তোলা হয়, যেখানে সে এবং তার স্বামী স্যামুয়েল কাজ করত। ফার্মটি ছিল নিউজিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ডের একটি শহর


রুয়াওয়ারোর কাছে। মুখে নীল হয়ে যাওয়া আঘাতের চিহ্ন মোটামুটি নিশ্চিত করে_ তাকে হত্যা করা হয়েছে। স্যাম ল্যাকিকে কোথাও পাওয়া যায়নি এবং তার নিজের রাইফেলগুলো উধাও। এক দশক ধরে ব্যবহৃত একটি ঘোড়ার গাড়িতে সম্প্রতি ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া যায় এবং এটার চাকায় রক্তের দাগও পাওয়া যায়। একটি গোলাঘরের ভেতর আরও রক্তের চিহ্ন নির্দেশ করে স্যাম ল্যাকিকে এটার ভেতরেই খুন করা হয়েছে এবং তার মৃতদেহ লুকাতে ঘোড়ার গাড়িটি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু কোথায়?
৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বিষয়টি একটা রহস্য হিসেবে থেকে গিয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুলিশ, ল্যাকির সীমানা বেড়ার কাছে জলাভূমিতে কিছু খোঁজার সময় ধাতব কিছু অনুভব করে। কয়েক স্তর কাদা সরানোর পর হারিয়ে যাওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়_দুটো শটগান এবং একটি পা রাইফেল পরে শনাক্ত করে দেখা গেছে, ওগুলো ল্যাকির ছিল। ব্যস, তারপর পাশের সম্পত্তির মালিক উইলিয়াম ব্যালি রাগের সঙ্গে অনুসন্ধানকারীদের তার এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আদেশ দেন। পুলিশ তার এই আক্রমণাত্মক ঘটনায় তেমন বিস্মিত হয়নি। কারণ তারা ইতিমধ্যে ব্যালি এবং ল্যাকিদের মধ্যে রেষারেষির কথা শুনেছেন।
তারা তার এলাকায় অবৈধভাবে প্রবেশ করবে না_এই আশ্বাস পাওয়ার পর ব্যালি একসময় বেশি বেশি করে সহযোগিতা করতে থাকেন, বোঝানোর চেষ্টা করেন হয়তো স্যাম ল্যাকি তার স্ত্রীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যান, এজন্য যে এই হত্যার জন্য তাকেই সন্দেহ করা হতে পারে। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এমন একটা বর্ণনায় সাক্ষ্য দেওয়ার পর ব্যালি নিজেও অদৃশ্য হয়ে যান। কিছুদিন পর এক প্রতিবেশী এগিয়ে এসে বলেন, ল্যাকিরা যেদিন নিখোঁজ হয়, ব্যালির গোয়ালঘর থেকে সেদিন ঘন ধোঁয়া নির্গত হচ্ছিল। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধানে নামে।
পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ : গোয়ালঘরের পুরোটা মেঝে ছাইয়ে ছিল ঢাকা। এক কোণে একটা বিশাল ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া তেলের ড্রাম ছিল, চারপাশে রক্তে মাখা। সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ করা হয় ল্যাকিকে তৈরি করা এই চিতায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং ফার্মের উঠানে ব্যাপক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। অনুসন্ধানকারীরা শত শত হাড়ের পোড়া টুকরো, দুটি নকল দাঁত, কিছু বস্তার কাপড়, একটা সিগারেট লাইটারের অংশবিশেষ এবং একটি চেরি কাঠে তৈরি পাইপের পোড়া অংশ, ল্যাকি যেমনটা ব্যবহার করতো ঠিক তেমন। তেলের ড্রাম এবং ঘরের অন্যত্র পাওয়া গুলির সিসার পরিমাণ ২৮.৭ গ্রাম, কাকতালীয়ভাবে ল্যাকির রাইফেলের একটা বুলেটের ওজনের সমান। ব্যালির একটা ট্রাউজার পকেটে এই মাপের একটা শেলও পাওয়া যায়। একটা পানপাত্র থেকে ভেড়ার এক গোছা ধূসর চুলসহ আরও কয়েকটি হাড়, কয়েকটি শটগানের কার্টিজ এবং একটি সিগারেট লাইটার পাওয়া যায়, যার সাদা উলের সলতেটি শনাক্ত করা হয় মিসেস ল্যাকির কাজের জিনিস রাখার বাক্সে।
তদন্তকারীরা যদিও নিশ্চিত ছিলেন, ব্যালিই জোড়া খুনের আসামি। তারা নিশ্চিত হতে চান মৃতদেহের এই অংশগুলো স্যাম ল্যাকির।
নিউজিল্যান্ডের পথিকৃৎ প্যাথলজিস্ট, ড. পিপি লিঞ্চকে বলা হয় অবশিষ্টাংশগুলোর একটি পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করতে। সেটা ছিল একটা বিশাল কাজ। প্রথমে তিনি চুল নিয়ে কাজ করেন_ নিশ্চিতভাবেই ওঠা ছিল মানুষের। আলাদা আলাদা হাড়ের ব্যাপারে তিনি অ্যাটলাস চিহ্নিত করেন, যা মেরুদণ্ডের ওপরের হাড়; গোড়ালির হাড়ের একটি অংশ এবং মাথার খুলির ওপরের অংশের বিভিন্ন টুকরো। ব্যালি বিশাল তেলের ড্রামে স্যাম লাকিকে পুড়িয়ে মেরেছে, তা পরীক্ষার জন্য লিঞ্চ ১৫০ পাউন্ডের একটি বাছুরের মৃতদেহ একই রকম একটি পাত্রে পোড়ান। এক বিকেল সোয়া ৪টায় আগুন লাগানো হয়। পরদিন সকালে মৃতদেহটি এক বালতি ছাইয়ে পরিণত হয়। গোলাঘরে যে পরিমাণ পাওয়া গিয়েছিল প্রায় একই পরিমাণ।
লিঞ্চ তার কাজ শেষ করার আগে ব্যালি তার আত্মগোপন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৩৪ সালের ২৩ জুন একটি ইতিহাস রচিত হলো। স্যাম ল্যাকির মৃতদেহ তার বিরুদ্ধে প্রমাণ দেখাতে না পারলেও ব্যালিকে জোড়া খুনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং এক মাস পরে মাউন্ট ইডেন কারাগারে তার ফাঁসি হয়।
উপসংহার : এমনকি আজও, বিচারকরা কোনো মৃতদেহ ছাড়া হত্যা মামলায় সাজা দিতে অনিচ্ছুক থাকেন। বহু বছর আগে নিউজিল্যান্ডের এক বিচারক এই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নেন, যা মামলায় প্রাপ্ত ফরেনসিক প্রমাণের গুণাগুণ ও পরিমাণের কথা বলে।
কলিন ইভান্সের দ্য কেসবুক অব ফরেনসিক ডিটেকশেন বই থেকে

No comments

Powered by Blogger.