বন্ধু রাসেলকে লেখা চিঠি by লুৎফর রহমান রিটন
বন্ধু রাসেল, আজ থেকে ১৫ বছর আগে, ১৯৯৬ সালের ১৮ অক্টোবর তোমার জন্মদিন সামনে রেখে একটি চিঠি লিখেছিলাম তোমাকে। সেই চিঠিটি ছাপা হয়েছিল 'ছোটদের কাগজ' নামের একটি পত্রিকায়। আমার সম্পাদনায় পত্রিকাটি বেরোত। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছিল পত্রিকাটি। বিশ্ব শিশু দিবস আর শিশু অধিকার সপ্তাহে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর সংখ্যাটি আমরা প্রকাশ করেছিলাম তোমাকে বিষয় করে।
টকটকে লাল রঙের প্রচ্ছদে মিষ্টি একটা ছবি ছিল তোমার। প্রচ্ছদ কাহিনীর শিরোনাম ছিল 'রাসেল হত্যার বিচার চাই'। দেশের বিখ্যাত মানুষরা লিখেছিলেন তোমাকে নিয়ে, সেই সংখ্যায়। তোমার হাসু আপাসহ সেই সংখ্যায় লিখেছিলেন সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সেলিনা হোসেন, মমতাজউদ্দীন আহমদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, তোয়াব খান, আবেদ খান, শামসুজ্জামান খান, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, রাহাত খান, হাশেম খান, রশীদ হায়দার, ফজল-এ-খোদা, বেবী মওদুদ, কাইজার চৌধুরী, শাহাবুদ্দীন নাগরী, আমীরুল ইসলাম, আহমাদ মাযহার, গোলাম কিবরিয়া ও তপন বাগচী। আমার লেখাটি ছিল চিঠির ফরম্যাটে।
ভয়ানক প্রতিকূল একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তোমাকে, তোমার বাবাকে, মাকে, তোমার দুই ভাইয়া আর দুই ভাবিকেসহ এতজন মানুষকে হত্যা করার পর আমাদের সংবিধানে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুত-বর্বর-নিষ্ঠুর-জঘন্য একটা আইন সংযোজন করিয়ে নিয়েছিল খুনিরা। সংবিধানে লেখা হয়েছিল_এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না! ভাবতে পারো, রাসেল! কলঙ্কজনক এ আইনটি ছিল আমাদের সংবিধানের লজ্জা। কুখ্যাত এই আইনটির নাম ছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। কোনো সুস্থ ও বিবেকবান সভ্য মানুষ এই আইন মানতে পারে না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমরা বাংলাদেশের মানুষ আইনটি মেনে নিয়েই বেঁচে ছিলাম দীর্ঘদিন, অবলীলায়! তোমার হাসু আপা ১৯৯৬ সালে ইলেকশনে জয়ী হলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর সংসদে এই অমানবিক আইনটি বাতিল করা হলো ২১ বছর পর। পাঁচ বছর তোমার হাসু আপা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না খুনিদের শাস্তি দিতে। তারপর ২০০১ সালে দেশের ওপর নেমে এল আরেকটি ঘনঘোর অন্ধকার সময়। একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো বিএনপি-জামায়াত জোট। পঁচাত্তরে মোশতাক সরকার ঘাতকদের নিরাপদে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিছুদিন পর মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে সেসব খুনিকে চাকরি দিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে। সে আরেক ঘৃণ্য ইতিহাস। জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে একাত্তরের ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এমনকি রাজাকারকে দেশের প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন! জিয়ার আমলেই একজন রাজাকার হয়েছিল সংসদে ডেপুটি স্পিকার!
১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ-পাঁচটি বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও খুনিদের শাস্তি দিতে পারেননি তোমার হাসু আপা। পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন না করেই তোমার হাসু আপা ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির প্রতিটি মানুষের ওপর নেমে এল নির্মম নির্যাতন, নিষ্ঠুর নিপীড়ন। দেশব্যাপী শুরু হলো হত্যা ও লুণ্ঠন। পূর্ণিমাসহ বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু মেয়েকে ধর্ষণও করা হলো প্রায় প্রকাশ্যে। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। ২০০১-এর নির্বাচনের পর থেকে দেশটাকে খুবলে-খামচে ক্ষতবিক্ষত করা হলো পরবর্তী পাঁচটি বছর। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও জয়ী হলেন তোমার হাসু আপা। এবার তিনি আর বোকামি করলেন না আগের মতো। তোমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হলো। অবশেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হলো। আহা, দেশজুড়ে মানুষের কী বিপুল আবেগ আর উচ্ছ্বাস! অচেনা মানুষজনও পরস্পরকে আলিঙ্গন করছিল অশ্রুসজল নয়নে। দেশের মানুষের সেই অশ্রু বেদনার ছিল না; ছিল আনন্দের, গ্লানি মোচনের।
বাংলাদেশটাকে মুজিবশূন্য করার পর এখন তাদের লক্ষ্য হাসিনাশূন্য বাংলাদেশ। তোমার হাসু আপাকে হত্যা করতে পারলেই দেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানাতে পারবে ওরা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা তোমার হাসু আপা। আর সে কারণেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের জনসভায় তৎকালীন সরকারের নিপুণ সহযোগিতায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হলেও অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তোমার হাসু আপা, জননেত্রী শেখ হাসিনা। একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তোমার হাসু আপা। আর তখনই একযোগে শুরু হলো গ্রেনেড হামলা। একটা গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল ট্রাকের ওপর। সেটা বিস্ফারিত হয়নি। আরেকটা গ্রেনেড সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঠিক ট্রাকের ওপর না পড়ে গড়িয়ে পড়েছিল নিচে, যেখানে আইভি রহমানরা বসে ছিলেন। মুহূর্তেই উড়ে গিয়েছিল আইভি রহমানের পা। আইভি রহমানসহ ২২ জন মৃত্যুবরণ করেছিলেন ওখানেই। আর আহত হয়েছিলেন শত শত মানুষ। তোমার হাসু আপা গ্রেনেড হামলার পরও বেঁচে গেছেন বুঝতে পেরেই, যখন তিনি গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়াচ্ছন্ন ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেই তাঁর গাড়িতে করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে চাইছিলেন দ্রুত, ঠিক তখনই শুরু হয়েছিল গুলি। কোনো কারণে গ্রেনেড হামলায় তোমার হাসু আপা বেঁচে গেলে তাঁকে ওখানেই গুলি করে খতম করে দেওয়ার জন্য স্নাইপারও প্রস্তুত ছিল। কী ভয়ংকর ছক! একটা গুলি এসে বিদ্ধ হয়েছিল বুলেটপ্রুফ গাড়ির জানালার কাচে। আরেকটি গুলি ছুটে এসেছিল নিপুণ নিশানায় তোমার হাসু আপার দিকেই। কিন্তু তাঁর দেহরক্ষী মামুন সেটি নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন। তোমার হাসু আপাকে ক্ষিপ্র গতিতে একঝটকায় গাড়ির ভেতর প্রবেশ করিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দরজা বন্ধ করছিলেন মামুন। ঠিক তক্ষুনি ছুটে এসেছিল পরবর্তী গুলিটা। তোমার হাসু আপার জীবন বাঁচাতে মামুন নিজের দেহটাকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বলেই সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তোমার হাসু আপা! সেদিন তিনি নিহত হলে তোমার হত্যাকারীদের কোনো শাস্তিই হতো না এই পোড়ার দেশে। বরং সূর্যসন্তান বলে সেই ঘাতকদেরই সম্মানিত করা হতো, পুরস্কৃত করা হতো আবারও।
বাংলাদেশের আকাশে তাহলে চিরস্থায়ী হতো ঘনঘোর অন্ধকার মেঘ। লাল-সবুজ পতাকার বদলে বাতাসে দোল খেত চাঁদ-তারা নিশান।
দেখো রাসেল, কেমন দুর্ভাগা আমরা। একটি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি বারবার আমাদের ওপর প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। স্বাধীন দেশে ওদের তো জায়গা হওয়ার কথা ছিল না। ওদের তো পালিয়ে যাওয়ার কথা! লুকিয়ে থাকার কথা ইঁদুরের গর্তে! কিন্তু আমাদের নষ্ট রাজনীতি সেই নরঘাতকদের মাথায় তুলে নাচছে! একাত্তর আর পঁচাত্তরের ঘাতকরা মন্ত্রী হচ্ছে! সারা বাংলাদেশের মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে তিরিশ লক্ষ শহীদ। সেই শহীদদের বুকের ওপর দিয়ে ঘাতকরা স্বাধীনতার পতাকাশোভিত গাড়িতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা দেশ! কী লজ্জা! কী লজ্জা! বাংলাদেশের মাটিতে কান পাতো যদি, তুমি কেবল শহীদদের আর্তনাদই শুনতে পাবে, রাসেল!
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে তোমার বয়স ছিল এগারোর কাছাকাছি। ভয়াল সেই রাতের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে ১৩ বছরের বেবী, ১০ বছরের আরিফ এবং চার বছরের সুকান্তও নিহত হয়েছিল। একজন শিশুর স্বাভাবিক মৃত্যুতেই কেঁদে ওঠে ধরিত্রী বসুন্ধরা। চারটি শিশুর এমন মৃত্যুতে ধরিত্রী কি বিলাপ করেছিল সেই রাতে? অমানবিক নৃশংসতার শিকার এই চারজন নিষ্পাপ শিশুর প্রতীক হিসেবে তোমাকে নির্বাচন করে ছোটদের কাগজের সেই বিশেষ সংখ্যায় তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠির শিরোনামটি ছিল_'শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা'। আমার লেখাটির সঙ্গে একটা ছবি ছিল তোমার। একটা তিন চাকার সাইকেলে বসে আছ তুমি।
আজ তোমাকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখতে গিয়ে বারবার আমার কেবল মনে পড়ছে তোমার সাইকেলটির কথা। তিন চাকার বেবি সাইকেল। কিড়িং কিড়িং বেল বাজিয়ে ঘর-বারান্দা-উঠান-লবি চষে বেড়াতে তুমি। কোক, পটেটো চিপস আর টিকটিকির ডিম (স্মার্টি) ভীষণ পছন্দ ছিল তোমার। জানো রাসেল, আমার কন্যা নদীরও ছেলেবেলায় ভীষণ প্রিয় ছিল এই টিকটিকির ডিম। নদীর জন্য নানা বর্ণের খুদে খুদে টিকটিকির ডিমের প্যাকেট কিনতে গিয়ে কত দিন যে তোমার কথা মনে পড়েছে আমার!
শুনেছি, খুনিরা একে একে তোমাদের পরিবারের সবাইকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার পর সবার শেষে হত্যা করেছে তোমাকে। তুমি কাঁদছিলে। 'মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব' বলে কাঁদছিলে তুমি। কাঁদবেই তো। তুমি তো বন্ধু মায়ের কাছেই যেতে চাইবে। মায়ের বুকের উষ্ণতা আর মায়ের গায়ের গন্ধই তো তোমার সবচেয়ে প্রিয় হওয়ার কথা। খুনিরা সবাইকে শেষ করার পর তোমাকে পেয়েছিল। তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তোমার বাবার লাশ, মায়ের লাশ, ভাইদের লাশ অতিক্রম করে তুমি পেঁৗছে গিয়েছিলে মায়ের লাশের কাছে। মায়ের লাশের পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে তোমার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করেছিল মানুষরূপী একটা পশু।
আর কয়েক দিন পর, ১৮ অক্টোবর তোমার জন্মদিন। আগাম 'হ্যাপি বার্থ ডে' রাসেল। জন্মদিনের উপহার হিসেবে তোমার জন্য শিশু দিবস স্মরণে আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম রাশি রাশি বর্ণাঢ্য টিকটিকির ডিম...
লেখক : ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক
riton100@gmail.com
ভয়ানক প্রতিকূল একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তোমাকে, তোমার বাবাকে, মাকে, তোমার দুই ভাইয়া আর দুই ভাবিকেসহ এতজন মানুষকে হত্যা করার পর আমাদের সংবিধানে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুত-বর্বর-নিষ্ঠুর-জঘন্য একটা আইন সংযোজন করিয়ে নিয়েছিল খুনিরা। সংবিধানে লেখা হয়েছিল_এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না! ভাবতে পারো, রাসেল! কলঙ্কজনক এ আইনটি ছিল আমাদের সংবিধানের লজ্জা। কুখ্যাত এই আইনটির নাম ছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। কোনো সুস্থ ও বিবেকবান সভ্য মানুষ এই আইন মানতে পারে না। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমরা বাংলাদেশের মানুষ আইনটি মেনে নিয়েই বেঁচে ছিলাম দীর্ঘদিন, অবলীলায়! তোমার হাসু আপা ১৯৯৬ সালে ইলেকশনে জয়ী হলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর সংসদে এই অমানবিক আইনটি বাতিল করা হলো ২১ বছর পর। পাঁচ বছর তোমার হাসু আপা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনি পারলেন না খুনিদের শাস্তি দিতে। তারপর ২০০১ সালে দেশের ওপর নেমে এল আরেকটি ঘনঘোর অন্ধকার সময়। একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো বিএনপি-জামায়াত জোট। পঁচাত্তরে মোশতাক সরকার ঘাতকদের নিরাপদে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিছুদিন পর মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে সেসব খুনিকে চাকরি দিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে। সে আরেক ঘৃণ্য ইতিহাস। জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে একাত্তরের ঘাতক-রাজাকার-আলবদরদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এমনকি রাজাকারকে দেশের প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছিলেন! জিয়ার আমলেই একজন রাজাকার হয়েছিল সংসদে ডেপুটি স্পিকার!
১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ-পাঁচটি বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও খুনিদের শাস্তি দিতে পারেননি তোমার হাসু আপা। পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন না করেই তোমার হাসু আপা ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির প্রতিটি মানুষের ওপর নেমে এল নির্মম নির্যাতন, নিষ্ঠুর নিপীড়ন। দেশব্যাপী শুরু হলো হত্যা ও লুণ্ঠন। পূর্ণিমাসহ বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু মেয়েকে ধর্ষণও করা হলো প্রায় প্রকাশ্যে। হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। ২০০১-এর নির্বাচনের পর থেকে দেশটাকে খুবলে-খামচে ক্ষতবিক্ষত করা হলো পরবর্তী পাঁচটি বছর। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবারও জয়ী হলেন তোমার হাসু আপা। এবার তিনি আর বোকামি করলেন না আগের মতো। তোমার বাবার হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হলো। অবশেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হলো। আহা, দেশজুড়ে মানুষের কী বিপুল আবেগ আর উচ্ছ্বাস! অচেনা মানুষজনও পরস্পরকে আলিঙ্গন করছিল অশ্রুসজল নয়নে। দেশের মানুষের সেই অশ্রু বেদনার ছিল না; ছিল আনন্দের, গ্লানি মোচনের।
বাংলাদেশটাকে মুজিবশূন্য করার পর এখন তাদের লক্ষ্য হাসিনাশূন্য বাংলাদেশ। তোমার হাসু আপাকে হত্যা করতে পারলেই দেশটাকে মিনি পাকিস্তান বানাতে পারবে ওরা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা তোমার হাসু আপা। আর সে কারণেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের জনসভায় তৎকালীন সরকারের নিপুণ সহযোগিতায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এই হামলায় ২২ জনের মৃত্যু হলেও অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তোমার হাসু আপা, জননেত্রী শেখ হাসিনা। একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তোমার হাসু আপা। আর তখনই একযোগে শুরু হলো গ্রেনেড হামলা। একটা গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল ট্রাকের ওপর। সেটা বিস্ফারিত হয়নি। আরেকটা গ্রেনেড সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঠিক ট্রাকের ওপর না পড়ে গড়িয়ে পড়েছিল নিচে, যেখানে আইভি রহমানরা বসে ছিলেন। মুহূর্তেই উড়ে গিয়েছিল আইভি রহমানের পা। আইভি রহমানসহ ২২ জন মৃত্যুবরণ করেছিলেন ওখানেই। আর আহত হয়েছিলেন শত শত মানুষ। তোমার হাসু আপা গ্রেনেড হামলার পরও বেঁচে গেছেন বুঝতে পেরেই, যখন তিনি গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়াচ্ছন্ন ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যেই তাঁর গাড়িতে করে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে চাইছিলেন দ্রুত, ঠিক তখনই শুরু হয়েছিল গুলি। কোনো কারণে গ্রেনেড হামলায় তোমার হাসু আপা বেঁচে গেলে তাঁকে ওখানেই গুলি করে খতম করে দেওয়ার জন্য স্নাইপারও প্রস্তুত ছিল। কী ভয়ংকর ছক! একটা গুলি এসে বিদ্ধ হয়েছিল বুলেটপ্রুফ গাড়ির জানালার কাচে। আরেকটি গুলি ছুটে এসেছিল নিপুণ নিশানায় তোমার হাসু আপার দিকেই। কিন্তু তাঁর দেহরক্ষী মামুন সেটি নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন। তোমার হাসু আপাকে ক্ষিপ্র গতিতে একঝটকায় গাড়ির ভেতর প্রবেশ করিয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দরজা বন্ধ করছিলেন মামুন। ঠিক তক্ষুনি ছুটে এসেছিল পরবর্তী গুলিটা। তোমার হাসু আপার জীবন বাঁচাতে মামুন নিজের দেহটাকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বলেই সেই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তোমার হাসু আপা! সেদিন তিনি নিহত হলে তোমার হত্যাকারীদের কোনো শাস্তিই হতো না এই পোড়ার দেশে। বরং সূর্যসন্তান বলে সেই ঘাতকদেরই সম্মানিত করা হতো, পুরস্কৃত করা হতো আবারও।
বাংলাদেশের আকাশে তাহলে চিরস্থায়ী হতো ঘনঘোর অন্ধকার মেঘ। লাল-সবুজ পতাকার বদলে বাতাসে দোল খেত চাঁদ-তারা নিশান।
দেখো রাসেল, কেমন দুর্ভাগা আমরা। একটি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি বারবার আমাদের ওপর প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। স্বাধীন দেশে ওদের তো জায়গা হওয়ার কথা ছিল না। ওদের তো পালিয়ে যাওয়ার কথা! লুকিয়ে থাকার কথা ইঁদুরের গর্তে! কিন্তু আমাদের নষ্ট রাজনীতি সেই নরঘাতকদের মাথায় তুলে নাচছে! একাত্তর আর পঁচাত্তরের ঘাতকরা মন্ত্রী হচ্ছে! সারা বাংলাদেশের মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে তিরিশ লক্ষ শহীদ। সেই শহীদদের বুকের ওপর দিয়ে ঘাতকরা স্বাধীনতার পতাকাশোভিত গাড়িতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা দেশ! কী লজ্জা! কী লজ্জা! বাংলাদেশের মাটিতে কান পাতো যদি, তুমি কেবল শহীদদের আর্তনাদই শুনতে পাবে, রাসেল!
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে তোমার বয়স ছিল এগারোর কাছাকাছি। ভয়াল সেই রাতের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে ১৩ বছরের বেবী, ১০ বছরের আরিফ এবং চার বছরের সুকান্তও নিহত হয়েছিল। একজন শিশুর স্বাভাবিক মৃত্যুতেই কেঁদে ওঠে ধরিত্রী বসুন্ধরা। চারটি শিশুর এমন মৃত্যুতে ধরিত্রী কি বিলাপ করেছিল সেই রাতে? অমানবিক নৃশংসতার শিকার এই চারজন নিষ্পাপ শিশুর প্রতীক হিসেবে তোমাকে নির্বাচন করে ছোটদের কাগজের সেই বিশেষ সংখ্যায় তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠির শিরোনামটি ছিল_'শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা'। আমার লেখাটির সঙ্গে একটা ছবি ছিল তোমার। একটা তিন চাকার সাইকেলে বসে আছ তুমি।
আজ তোমাকে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখতে গিয়ে বারবার আমার কেবল মনে পড়ছে তোমার সাইকেলটির কথা। তিন চাকার বেবি সাইকেল। কিড়িং কিড়িং বেল বাজিয়ে ঘর-বারান্দা-উঠান-লবি চষে বেড়াতে তুমি। কোক, পটেটো চিপস আর টিকটিকির ডিম (স্মার্টি) ভীষণ পছন্দ ছিল তোমার। জানো রাসেল, আমার কন্যা নদীরও ছেলেবেলায় ভীষণ প্রিয় ছিল এই টিকটিকির ডিম। নদীর জন্য নানা বর্ণের খুদে খুদে টিকটিকির ডিমের প্যাকেট কিনতে গিয়ে কত দিন যে তোমার কথা মনে পড়েছে আমার!
শুনেছি, খুনিরা একে একে তোমাদের পরিবারের সবাইকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার পর সবার শেষে হত্যা করেছে তোমাকে। তুমি কাঁদছিলে। 'মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব' বলে কাঁদছিলে তুমি। কাঁদবেই তো। তুমি তো বন্ধু মায়ের কাছেই যেতে চাইবে। মায়ের বুকের উষ্ণতা আর মায়ের গায়ের গন্ধই তো তোমার সবচেয়ে প্রিয় হওয়ার কথা। খুনিরা সবাইকে শেষ করার পর তোমাকে পেয়েছিল। তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তোমার বাবার লাশ, মায়ের লাশ, ভাইদের লাশ অতিক্রম করে তুমি পেঁৗছে গিয়েছিলে মায়ের লাশের কাছে। মায়ের লাশের পাশে তোমাকে দাঁড় করিয়ে তোমার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করেছিল মানুষরূপী একটা পশু।
আর কয়েক দিন পর, ১৮ অক্টোবর তোমার জন্মদিন। আগাম 'হ্যাপি বার্থ ডে' রাসেল। জন্মদিনের উপহার হিসেবে তোমার জন্য শিশু দিবস স্মরণে আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম রাশি রাশি বর্ণাঢ্য টিকটিকির ডিম...
লেখক : ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক
riton100@gmail.com
No comments