কালের আয়নায়-ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগের দায় আ'লীগ সহজে এড়াতে পারবে না by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া বৈধ কি অবৈধ হয়েছে, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। সে সম্পর্কে রায় দেবেন মহামান্য আদালত। এটা এখন তাদের বিচার্য বিষয়। আমার কথা হলো, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি বৈধও হয়ে থাকে, তা কি ঢাকার ধনী-দরিদ্র, সব নাগরিক জীবনের অন্তহীন সমস্যা কমাবে, না আরও বাড়াবে? আমার আশঙ্কা আরও বাড়াবে। শুধু সমস্যা বাড়ানো নয়, নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক জটিলতা বাড়াবে]
১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করার জন্য বিলাত থেকে ইংরেজ রেডক্লিফ (জবফপষরভভ) সাহেবকে ডেকে আনতে হয়েছিল। তিনি কোনো কিছু বিচার-বিবেচনায় না এনে ছুরি হাতে বাংলার মানচিত্র কেটে দু'ভাগ করে ফেললেন। তাতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা মুর্শিদাবাদ পড়ে গেল ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের ভাগে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ খুলনা জেলা পড়ে গেল সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে। অসংখ্য নদী, শাখা নদীর পানি বণ্টন ও পানি প্রবাহের প্রশ্নটি, ছিটমহল সমস্যা, বর্ডার ডিমারকেশনের সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেল। তা থেকে বর্তমানের যত সমস্যা ও সংকটের উদ্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পর এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকা শহর প্রশাসনিকভাবে ভাগ হতে যাচ্ছে। এই ভাগ করার জন্য আর বিলাত থেকে রেডক্লিফ সাহেবের মতো কাউকে ছুরি হাতে ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হয়নি। আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরাই এবার সে কাজটি করে দিয়েছেন। এ নিয়ে সংসদেও কোনো বিতর্ক, আলোচনা নেই। জনমত সমীক্ষারও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। সরকারি দলের সাংসদরা সুবোধ বালকের মতো মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ঢাকা ভাগের বিলটি পাস করে দিয়েছেন।
চৌষট্টি বছর আগে রেডক্লিফ সাহেবের বাংলা ভাগকে কেউ চ্যালেঞ্জ জানায়নি। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা ভাগের এই সিদ্ধান্তকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন বর্তমানের অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের 'গদিনশিন' মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তাকে 'গদিনশিন মেয়র' বললাম এ জন্য যে, খোকা সাহেবের মেয়রগিরির মেয়াদ বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন মেয়র নির্বাচনে বর্তমান সরকারের এ যাবৎকালের অক্ষমতার জন্য তিনি বহাল-তবিয়তে স্বপদে বহাল আছেন এবং এখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তি চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেছেন। উচ্চ আদালত মামলাটি গ্রহণ করেছেন এবং এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শানোর জন্য সরকারের ওপর রুল জারিও করেছেন।
ঢাকা বিভক্তিকরণ নিয়ে এককালের 'চাচা-ভাতিজির' মধ্যে একটা পরোক্ষ বাগ্যুদ্ধও হয়ে গেছে। 'চাচা' ড. কামাল হোসেন হাইকোর্টে সাদেক হোসেন খোকার মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি জাতীয় সংসদে এই বিভক্তিকরণের বিল কয়েক মিনিটে পাস হয়ে যাওয়াকে কটাক্ষ করে বলেছেন, 'আইন পাস সুপারসনিক গতিতে করা যায় না।' অন্যদিকে ভাতিজি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমার হাতে টাকা থাকলে আমি ঢাকা শহরকে চার ভাগ করতাম।' প্রধানমন্ত্রীর এই তির্যক মন্তব্য শুনে ছোটবেলায় পড়া সুনির্মল বসুর একটি বিখ্যাত ছড়ার লাইন মনে পড়েছে, 'আমার নিজের পাঁঠাটিকে কাটব আমি লেজের দিকে/ কোন্ ব্যাটা কি করতে পারে?' মুশকিল হয়েছে এই যে, ঢাকা শহরটি আওয়ামী লীগ সরকারের একার পাঁঠা নয়।
ঢাকা শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা অসম্ভব হারে বৃদ্ধি বিস্ময়কর। জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা এখন বিশ্বের একটি মেগাসিটি। এই মহানগরীর লাখ লাখ নরনারী জন্তু-জানোয়ার নয় যে, কারও ইচ্ছামতো তাদের একাধিক গোয়ালে ঢুকিয়ে দিলাম। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটা দাম আছে। সুতরাং যে নাগরিকদের সুখ-সুবিধা বিধান করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, সেটি বিভক্ত করার আগে শহরের নতুন-পুরনো দুই অঞ্চলেই জনমত জরিপের প্রয়োজন ছিল।
এই বিভক্তির ভালোমন্দ দুটি দিকই আছে। তা নিয়ে সংবাদপত্রে, টিভির টক শোতে, বিভিন্ন সেমিনারে, সংসদে আরও ব্যাপক প্রাণবন্ত বিতর্ক ও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার যেভাবে তড়িঘড়ি করে ঢাকা বিভক্তিকরণের ব্যবস্থা করলেন, তাতে সাতচলি্লশ সালে ইংরেজ রেডক্লিফকে ছুরি হাতে ডেকে এনে রাতারাতি মানচিত্র দু'টুকরো করার কথা মনে হয়। ঢাকা বিভক্তিকরণের ব্যাপারে ছুরি নয়, অনুগত সংসদ সদস্যদের তাৎক্ষণিক ভোটের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
যে শহরটির নাগরিকদের ভাগ করা হলো, যাদের সুখ-সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য সিটি করপোরেশন, তাদের মতামতের কোনো গুরুত্বই সরকারের কাছে রয়েছে বলে তাদের সংসদীয় সিদ্ধান্তে মনে হলো না। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্তকে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি ও নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। এখানেও তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বার্থ-সুবিধাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিএনপি এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্তে বাধাদান অথবা তার প্রতিবাদ জানানোর জন্য সংসদে যায়নি। তারা দলীয় সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে আগামী রোববার (৪ ডিসেম্বর) ঢাকা শহরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছেন। মনে হয়, সুযোগ পেলেই হরতাল ডাকাটা বিএনপির নেশা অথবা পেশা। নাগরিক সুখ-সুবিধার কথা তাদের বিবেচ্য নয়। নইলে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তিকরণের প্রতিবাদ জানানোর জন্য সংসদসহ বিভিন্ন ফোরাম ব্যবহার করার বদলে প্রথমেই হরতালের নামে নাগরিক জীবনের উপদ্রব সৃষ্টির এই প্রয়াস কেন? দোষ যদি করে থাকে তাহলে করেছে সরকার। এখন তার শোধ নিতে হবে নাগরিক জীবনের অরাজকতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করে?
অন্যদিকে সরকারের এক মন্ত্রী ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তিকরণ সম্পর্কে তার জ্ঞানের বহর দেখিয়ে বলেছেন, 'দুটি সিটি করপোরেশন বহু বড় শহরেই আছে।' এই ব্যাপারে তিনি লন্ডন শহরের নাম টেনে এনে বলেছেন, 'লন্ডনেও দুটি সিটি করপোরেশন আছে।' লন্ডনে এখন গ্রেটার লন্ডন অথরিটি নামে একটিই সিটি করপোরেশন আছে। আগে এর নাম ছিল গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল বা জিএলসি। মিসেস মার্গারট থ্যাচার টোরি সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের জেদের বশে জিএলসি বিলুপ্ত করেছিলেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। বৃহত্তর লন্ডনের পৌর প্রশাসনে নৈরাজ্য দেখা দেওয়ায় গ্রেটার লন্ডন অথরিটি নামে আবার কেন্দ্রীয় পৌর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
গ্রেটার লন্ডনের বাইরে পুর সংস্থাগুলোর নাম কাউন্ট্রি কাউন্সিল। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বহু ব্যাপারে গ্রেটার লন্ডন অথরিটির কর্তৃত্ব লন্ডনের বাইরেও প্রসারিত। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনগুলো (টিউব) লন্ডন সিটির বাইরেও যাতায়াত করে। তার কর্তৃত্ব গ্রেটার লন্ডন অথরিটির হাতেই। ঢাকায় যে মন্ত্রী মহোদয় দুই সিটি করপোরেশনের গল্প ফেঁদেছেন তাকে আমি চিনি। তিনি যে সবসময় 'স্বজ্ঞানে' কথাবার্তা বলেন তা নয়। এ জন্য বড় শহরের পৌর প্রশাসন সম্পর্কে তার জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া বৈধ কি অবৈধ হয়েছে, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। সে সম্পর্কে রায় দেবেন মহামান্য আদালত। এটা এখন তাদের বিচার্য বিষয়। আমার কথা হলো, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি বৈধও হয়ে থাকে, তা কি ঢাকার ধনী-দরিদ্র, সব নাগরিক জীবনের অন্তহীন সমস্যা কমাবে, না আরও বাড়াবে? আমার আশঙ্কা আরও বাড়াবে। শুধু সমস্যা বাড়ানো নয়, নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক জটিলতা বাড়াবে।
আমাকে কেউ কেউ বলেছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিরাট এবং অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই ভেবে শঙ্কিত হয় যে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনেও তারা জয়ী হতে পারবে না। ফলে বিএনপিদলীয় মেয়রের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তার হাতেই ঢাকা করপোরেশনের দায়িত্ব রেখে দিয়ে তারা পরাজয় এড়ানোর পন্থার কথা ভাবতে থাকেন।
এই ভাবনাচিন্তার মধ্যেই এক বা একাধিক 'বিজ্ঞ' পরামর্শদাতার পরামর্শে ঢাকা সিটি করপোরেশন বাইফারকেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে যুক্তি নাকি ছিল, বিভক্ত করপোরেশনের দুটি মেয়র পদেই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সরকারি দলের জন্য বাড়বে। আর দুটিতে জয়ী হওয়া না গেলেও অন্তত একটিতে সরকারদলীয় প্রার্থী জয়ী হবে এবং রাজধানীর অর্ধাংশ অন্তত সরকারের কর্তৃত্বাধীনে থাকবে।
এই যুক্তি দুটির একটিও ধোপে টেকে না। প্রথমত, বিভক্ত শহরের দুটি মেয়র পদেই যদি সরকার সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে কী হবে? এটা কি সরকারের ওপরে গোটা রাজধানীর নাগরিকদের অনাস্থা প্রকাশ বলে বিবেচিত হবে না? তখন নতুন সাধারণ নির্বাচন না ডেকে কেন্দ্রীয় সরকার হিসেবে ক্ষমতায় থাকা বৈধ হতে পারে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকার নৈতিকতা প্রশ্নটি কি এসে যাবে না?
যদি ঢাকার প্রস্তাবিত দুই মেয়র পদেই সরকার সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হন, তাহলেও সমস্যার পরিসর কমবে, না বাড়বে? একটি সিটি করপোরেশনকে যেখানে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না, সেখানে আরেকটি করপোরেশন পাশাপাশি গড়ে তোলা, নতুন প্রশাসন তৈরি, নতুন কাঠামো তৈরি, বিভিন্ন সার্ভিস বা সেবার কাজ বিভক্তিকরণ, দুই সিটির সীমানা ও দুই সিটি করপোরেশনের এখতিয়ার নির্দিষ্ট করা কি চাট্টিখানি কথা? তাতে প্রাথমিকভাবে যে অব্যবস্থা ও নৈরাজ্য দেখা দেবে তা দূর করতে কত বছর লাগবে? আর আমাদের যে ঘুণে ধরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাতে ঢাকার জন্য একটির বদলে দুটি সিটি করপোরেশন সুষ্ঠু ও উন্নতভাবে গড়ে তোলা ও পরিচালনা সম্ভব হবে কি?
এক গর্তে দুই সিংহ যেমন বাস করতে পারে না, তেমনি এক শহরে দুই মেয়রের শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সহাবস্থান কি সম্ভব অথবা সহজ হবে? দু'জনে একই দলের মেয়র হলেও তারা সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে নগরীর স্ব-স্ব এলাকা উন্নয়নে পাল্লা দেবেন, না তাদের কর্তৃত্বের সীমানার ঝগড়া ও রেষারেষিতে দুই করপোরেশনেরই উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত ও অচল হয়ে পড়বে, সে প্রশ্নও অনেকের মনেই রয়েছে। যদি দুই মেয়রের একজন সরকারি দলের এবং অন্যজন বিরোধী দলের সমর্থিত হন, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?
প্রথমেই বিরোধী দল অথবা তাদের মেয়র অভিযোগ তুলবেন, তার অধীনের সিটি করপোরেশন সরকারের কাছ থেকে বিমাতাসুলভ ও বৈষম্যমূলক আচরণ পাচ্ছে। অর্থ বরাদ্দ থেকে সব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারেই সিংহভাগ পাচ্ছে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র। এই অভিযোগ তুলে তিনি করপোরেশনের কাজকাম শিকেয় তুলে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশি সময় কাটাবেন এবং তাতে তার করপোরেশনভুক্ত শহর এলাকার মানুষকে বৈষম্য-বঞ্চনার ধুয়া তুলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে টানতেও পারবেন।
সিটি করপোরেশন ভাগ করার ফলে আরেকটা বড় অসুবিধা সৃষ্টি হবে। সেটা হলো পুরনো ও নতুন ঢাকার বাসিন্দাদের মনে মনস্তাত্তি্বক বিরোধ। নতুন ঢাকার বৃহদাংশ যে করপোরেশনের অধীনে পড়বে, তাতেই শহরের ধনী ও এলিটশ্রেণী, মন্ত্রী, আমলা, সাংসদদের অধিকাংশের বাস। সরকারের অর্থ বরাদ্দে এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন ঢাকার সিটি করপোরেশনই সুয়োরানীর অনুগ্রহ পাচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ উঠতে পারে। এই অভিযোগ সঠিক হতে পারে, আবার সঠিক না হলেও পুরান ঢাকার মানুষের মনে এই বৈষম্য, বঞ্চনার সন্দেহ ও অভিযোগ দানা বাঁধবেই। তা থেকে ঢাকার দুই করপোরেশনভুক্ত এলাকার মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও অন্যান্য ব্যবধানের দেয়াল তৈরি হয়ে এ টেল অব টু সিটির উপাখ্যান সৃষ্টি হতে পারে।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, আওয়ামী লীগ সরকারের মতো একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেবল নির্বাচনী জয়-পরাজয়কে বিবেচনা করে এত দীর্ঘকাল খোদ রাজধানীর পৌর সংস্থার মেয়র নির্বাচন কীভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন এবং এখন সংস্থাটি দু'ভাগ করার সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এক করপোরেশনের বদলে দুটি করপোরেশন চালাতে গেলে খরচও বাড়বে দ্বিগুণ। এমনিতেই রাজধানীর নাগরিকরা করভারে জর্জরিত। তার ওপর বিভক্ত করপোরেশনের বর্ধিত খরচ সংকুলানের জন্য তাদের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো হলে তারা খুশি হবে কি?
আসলে ঢাকায় মানুষকে উন্নত নাগরিক পরিসেবা দিতে হলে সিটি করপোরেশন ভাগ করে খুব বেশি লাভ হবে না। ঢাকা করপোরেশন কেন, দেশের সবগুলো সিটি করপোরেশনের জন্য যা দরকার, তা হলো লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিওর মতো সিটি করপোরেশনগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। সরকারের হস্তক্ষেপ ও আমলাতন্ত্রের লালফিতার দৌরাত্ম্য সেখানে থাকবে না।
কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রের মূলভিত্তি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে রাজি নন। সাংসদরা জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের ওপর পর্যন্ত তাদের অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক খবরদারি ছাড়তে রাজি নন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে দুটি বড় দলেরই এই মনোভাব একটি বড় বাধা।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে কী লাভ হবে আমি জানি না। তার বদলে করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রের প্রাপ্য ক্ষমতা বাড়ালে, ঢাকা সিটির ৯২টি ওয়ার্ডের ৯২ জন ওয়ার্ড কমিশনারের নাগরিক পরিসেবা দানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়ালে বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। এটাই চেয়েছিলেন ঢাকার প্রয়াত জনপ্রিয় সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ঢাকার মেয়র থাকাকালে একাধিকবার বিদেশ সফরে এসেছেন, শুধু লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনের মতো শহরগুলোর পৌর ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপমুক্তভাবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কীভাবে নাগরিক জীবনের সব চাহিদা মেটায়, তা পর্যবেক্ষণ এবং ঢাকায় তা অনুসরণের ইচ্ছা নিয়ে। তখন আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ঢাকা করপোরেশনকে উন্নত ও সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত করার ব্যাপারে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের ক্রমাগত বাধার দরুন মোহাম্মদ হানিফ সফল হতে পারেননি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানতাম বলে তার হতাশা ও মনোবেদনার কথা আমি জানি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার হাতে অর্থ থাকলে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে চার ভাগ করতেন। রাজধানীর মানুষকে নাগরিক সেবাদানের কাজ উন্নত করার ইচ্ছাই যদি তার থাকে, তাহলে ঢাকা শহরের এই পরিকল্পিত চার এলাকার জন্য তিনি বর্তমান সিটি করপোরেশনে চারজন ডেপুটি মেয়র পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে পারেন। তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়াতে পারেন। আরেকটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অহেতুক অর্থ ব্যয় না করে বর্তমান সিটি করপোরেশনেরই আর্থিক বরাদ্দ বাড়াতে পারেন। তা না করে এই যে রাতারাতি রেডক্লিফের ছুরি চালানো হলো ঢাকা সিটি করপোরেশনের বুকে, ফল কী হবে তা আমি জানি না।
ব্রিটেনের সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তার দেশের মানুষের কাছে অন্তত তিন টার্ম একটানা প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটেনের মানুষ তার ইচ্ছা পূরণ করেছিল। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় টার্মের শেষ পর্যায়ে তিনি জেদ ধরলেন, জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তিনি পোল ট্যাক্স নামে একটি কর প্রবর্তন করবেনই। প্রবল গণঅসন্তোষের মুখে তাকে তৃতীয় টার্ম শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা থেকে সরকার বিরত না হলে ব্রিটেনের মতো অবস্থা ঘটবে তা বলি না। কিন্তু এর ফলে সৃষ্ট গণঅসন্তোষ যে আগামী সাধারণ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনেও বিরাট প্রভাব ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই।
লন্ডন, ২ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০১১
বাংলাদেশের স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পর এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকা শহর প্রশাসনিকভাবে ভাগ হতে যাচ্ছে। এই ভাগ করার জন্য আর বিলাত থেকে রেডক্লিফ সাহেবের মতো কাউকে ছুরি হাতে ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হয়নি। আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরাই এবার সে কাজটি করে দিয়েছেন। এ নিয়ে সংসদেও কোনো বিতর্ক, আলোচনা নেই। জনমত সমীক্ষারও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। সরকারি দলের সাংসদরা সুবোধ বালকের মতো মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ঢাকা ভাগের বিলটি পাস করে দিয়েছেন।
চৌষট্টি বছর আগে রেডক্লিফ সাহেবের বাংলা ভাগকে কেউ চ্যালেঞ্জ জানায়নি। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা ভাগের এই সিদ্ধান্তকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন বর্তমানের অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের 'গদিনশিন' মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। তাকে 'গদিনশিন মেয়র' বললাম এ জন্য যে, খোকা সাহেবের মেয়রগিরির মেয়াদ বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন মেয়র নির্বাচনে বর্তমান সরকারের এ যাবৎকালের অক্ষমতার জন্য তিনি বহাল-তবিয়তে স্বপদে বহাল আছেন এবং এখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভক্তি চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেছেন। উচ্চ আদালত মামলাটি গ্রহণ করেছেন এবং এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তার কারণ দর্শানোর জন্য সরকারের ওপর রুল জারিও করেছেন।
ঢাকা বিভক্তিকরণ নিয়ে এককালের 'চাচা-ভাতিজির' মধ্যে একটা পরোক্ষ বাগ্যুদ্ধও হয়ে গেছে। 'চাচা' ড. কামাল হোসেন হাইকোর্টে সাদেক হোসেন খোকার মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি জাতীয় সংসদে এই বিভক্তিকরণের বিল কয়েক মিনিটে পাস হয়ে যাওয়াকে কটাক্ষ করে বলেছেন, 'আইন পাস সুপারসনিক গতিতে করা যায় না।' অন্যদিকে ভাতিজি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমার হাতে টাকা থাকলে আমি ঢাকা শহরকে চার ভাগ করতাম।' প্রধানমন্ত্রীর এই তির্যক মন্তব্য শুনে ছোটবেলায় পড়া সুনির্মল বসুর একটি বিখ্যাত ছড়ার লাইন মনে পড়েছে, 'আমার নিজের পাঁঠাটিকে কাটব আমি লেজের দিকে/ কোন্ ব্যাটা কি করতে পারে?' মুশকিল হয়েছে এই যে, ঢাকা শহরটি আওয়ামী লীগ সরকারের একার পাঁঠা নয়।
ঢাকা শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা অসম্ভব হারে বৃদ্ধি বিস্ময়কর। জনসংখ্যার দিক থেকে ঢাকা এখন বিশ্বের একটি মেগাসিটি। এই মহানগরীর লাখ লাখ নরনারী জন্তু-জানোয়ার নয় যে, কারও ইচ্ছামতো তাদের একাধিক গোয়ালে ঢুকিয়ে দিলাম। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটা দাম আছে। সুতরাং যে নাগরিকদের সুখ-সুবিধা বিধান করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, সেটি বিভক্ত করার আগে শহরের নতুন-পুরনো দুই অঞ্চলেই জনমত জরিপের প্রয়োজন ছিল।
এই বিভক্তির ভালোমন্দ দুটি দিকই আছে। তা নিয়ে সংবাদপত্রে, টিভির টক শোতে, বিভিন্ন সেমিনারে, সংসদে আরও ব্যাপক প্রাণবন্ত বিতর্ক ও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার যেভাবে তড়িঘড়ি করে ঢাকা বিভক্তিকরণের ব্যবস্থা করলেন, তাতে সাতচলি্লশ সালে ইংরেজ রেডক্লিফকে ছুরি হাতে ডেকে এনে রাতারাতি মানচিত্র দু'টুকরো করার কথা মনে হয়। ঢাকা বিভক্তিকরণের ব্যাপারে ছুরি নয়, অনুগত সংসদ সদস্যদের তাৎক্ষণিক ভোটের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
যে শহরটির নাগরিকদের ভাগ করা হলো, যাদের সুখ-সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য সিটি করপোরেশন, তাদের মতামতের কোনো গুরুত্বই সরকারের কাছে রয়েছে বলে তাদের সংসদীয় সিদ্ধান্তে মনে হলো না। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্তকে জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিভঙ্গি ও নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করছে বলে মনে হয় না। এখানেও তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বার্থ-সুবিধাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
বিএনপি এই বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্তে বাধাদান অথবা তার প্রতিবাদ জানানোর জন্য সংসদে যায়নি। তারা দলীয় সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে আগামী রোববার (৪ ডিসেম্বর) ঢাকা শহরে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছেন। মনে হয়, সুযোগ পেলেই হরতাল ডাকাটা বিএনপির নেশা অথবা পেশা। নাগরিক সুখ-সুবিধার কথা তাদের বিবেচ্য নয়। নইলে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তিকরণের প্রতিবাদ জানানোর জন্য সংসদসহ বিভিন্ন ফোরাম ব্যবহার করার বদলে প্রথমেই হরতালের নামে নাগরিক জীবনের উপদ্রব সৃষ্টির এই প্রয়াস কেন? দোষ যদি করে থাকে তাহলে করেছে সরকার। এখন তার শোধ নিতে হবে নাগরিক জীবনের অরাজকতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করে?
অন্যদিকে সরকারের এক মন্ত্রী ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তিকরণ সম্পর্কে তার জ্ঞানের বহর দেখিয়ে বলেছেন, 'দুটি সিটি করপোরেশন বহু বড় শহরেই আছে।' এই ব্যাপারে তিনি লন্ডন শহরের নাম টেনে এনে বলেছেন, 'লন্ডনেও দুটি সিটি করপোরেশন আছে।' লন্ডনে এখন গ্রেটার লন্ডন অথরিটি নামে একটিই সিটি করপোরেশন আছে। আগে এর নাম ছিল গ্রেটার লন্ডন কাউন্সিল বা জিএলসি। মিসেস মার্গারট থ্যাচার টোরি সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নিজের জেদের বশে জিএলসি বিলুপ্ত করেছিলেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। বৃহত্তর লন্ডনের পৌর প্রশাসনে নৈরাজ্য দেখা দেওয়ায় গ্রেটার লন্ডন অথরিটি নামে আবার কেন্দ্রীয় পৌর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
গ্রেটার লন্ডনের বাইরে পুর সংস্থাগুলোর নাম কাউন্ট্রি কাউন্সিল। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি বহু ব্যাপারে গ্রেটার লন্ডন অথরিটির কর্তৃত্ব লন্ডনের বাইরেও প্রসারিত। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনগুলো (টিউব) লন্ডন সিটির বাইরেও যাতায়াত করে। তার কর্তৃত্ব গ্রেটার লন্ডন অথরিটির হাতেই। ঢাকায় যে মন্ত্রী মহোদয় দুই সিটি করপোরেশনের গল্প ফেঁদেছেন তাকে আমি চিনি। তিনি যে সবসময় 'স্বজ্ঞানে' কথাবার্তা বলেন তা নয়। এ জন্য বড় শহরের পৌর প্রশাসন সম্পর্কে তার জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে অধিক আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করছি।
ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া বৈধ কি অবৈধ হয়েছে, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। সে সম্পর্কে রায় দেবেন মহামান্য আদালত। এটা এখন তাদের বিচার্য বিষয়। আমার কথা হলো, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ যদি বৈধও হয়ে থাকে, তা কি ঢাকার ধনী-দরিদ্র, সব নাগরিক জীবনের অন্তহীন সমস্যা কমাবে, না আরও বাড়াবে? আমার আশঙ্কা আরও বাড়াবে। শুধু সমস্যা বাড়ানো নয়, নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক জটিলতা বাড়াবে।
আমাকে কেউ কেউ বলেছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিরাট এবং অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার এই ভেবে শঙ্কিত হয় যে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনেও তারা জয়ী হতে পারবে না। ফলে বিএনপিদলীয় মেয়রের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তার হাতেই ঢাকা করপোরেশনের দায়িত্ব রেখে দিয়ে তারা পরাজয় এড়ানোর পন্থার কথা ভাবতে থাকেন।
এই ভাবনাচিন্তার মধ্যেই এক বা একাধিক 'বিজ্ঞ' পরামর্শদাতার পরামর্শে ঢাকা সিটি করপোরেশন বাইফারকেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে যুক্তি নাকি ছিল, বিভক্ত করপোরেশনের দুটি মেয়র পদেই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সরকারি দলের জন্য বাড়বে। আর দুটিতে জয়ী হওয়া না গেলেও অন্তত একটিতে সরকারদলীয় প্রার্থী জয়ী হবে এবং রাজধানীর অর্ধাংশ অন্তত সরকারের কর্তৃত্বাধীনে থাকবে।
এই যুক্তি দুটির একটিও ধোপে টেকে না। প্রথমত, বিভক্ত শহরের দুটি মেয়র পদেই যদি সরকার সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে কী হবে? এটা কি সরকারের ওপরে গোটা রাজধানীর নাগরিকদের অনাস্থা প্রকাশ বলে বিবেচিত হবে না? তখন নতুন সাধারণ নির্বাচন না ডেকে কেন্দ্রীয় সরকার হিসেবে ক্ষমতায় থাকা বৈধ হতে পারে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকার নৈতিকতা প্রশ্নটি কি এসে যাবে না?
যদি ঢাকার প্রস্তাবিত দুই মেয়র পদেই সরকার সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হন, তাহলেও সমস্যার পরিসর কমবে, না বাড়বে? একটি সিটি করপোরেশনকে যেখানে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না, সেখানে আরেকটি করপোরেশন পাশাপাশি গড়ে তোলা, নতুন প্রশাসন তৈরি, নতুন কাঠামো তৈরি, বিভিন্ন সার্ভিস বা সেবার কাজ বিভক্তিকরণ, দুই সিটির সীমানা ও দুই সিটি করপোরেশনের এখতিয়ার নির্দিষ্ট করা কি চাট্টিখানি কথা? তাতে প্রাথমিকভাবে যে অব্যবস্থা ও নৈরাজ্য দেখা দেবে তা দূর করতে কত বছর লাগবে? আর আমাদের যে ঘুণে ধরা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাতে ঢাকার জন্য একটির বদলে দুটি সিটি করপোরেশন সুষ্ঠু ও উন্নতভাবে গড়ে তোলা ও পরিচালনা সম্ভব হবে কি?
এক গর্তে দুই সিংহ যেমন বাস করতে পারে না, তেমনি এক শহরে দুই মেয়রের শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সহাবস্থান কি সম্ভব অথবা সহজ হবে? দু'জনে একই দলের মেয়র হলেও তারা সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে নগরীর স্ব-স্ব এলাকা উন্নয়নে পাল্লা দেবেন, না তাদের কর্তৃত্বের সীমানার ঝগড়া ও রেষারেষিতে দুই করপোরেশনেরই উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত ও অচল হয়ে পড়বে, সে প্রশ্নও অনেকের মনেই রয়েছে। যদি দুই মেয়রের একজন সরকারি দলের এবং অন্যজন বিরোধী দলের সমর্থিত হন, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?
প্রথমেই বিরোধী দল অথবা তাদের মেয়র অভিযোগ তুলবেন, তার অধীনের সিটি করপোরেশন সরকারের কাছ থেকে বিমাতাসুলভ ও বৈষম্যমূলক আচরণ পাচ্ছে। অর্থ বরাদ্দ থেকে সব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারেই সিংহভাগ পাচ্ছে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র। এই অভিযোগ তুলে তিনি করপোরেশনের কাজকাম শিকেয় তুলে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশি সময় কাটাবেন এবং তাতে তার করপোরেশনভুক্ত শহর এলাকার মানুষকে বৈষম্য-বঞ্চনার ধুয়া তুলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে টানতেও পারবেন।
সিটি করপোরেশন ভাগ করার ফলে আরেকটা বড় অসুবিধা সৃষ্টি হবে। সেটা হলো পুরনো ও নতুন ঢাকার বাসিন্দাদের মনে মনস্তাত্তি্বক বিরোধ। নতুন ঢাকার বৃহদাংশ যে করপোরেশনের অধীনে পড়বে, তাতেই শহরের ধনী ও এলিটশ্রেণী, মন্ত্রী, আমলা, সাংসদদের অধিকাংশের বাস। সরকারের অর্থ বরাদ্দে এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় নতুন ঢাকার সিটি করপোরেশনই সুয়োরানীর অনুগ্রহ পাচ্ছে এই ধরনের অভিযোগ উঠতে পারে। এই অভিযোগ সঠিক হতে পারে, আবার সঠিক না হলেও পুরান ঢাকার মানুষের মনে এই বৈষম্য, বঞ্চনার সন্দেহ ও অভিযোগ দানা বাঁধবেই। তা থেকে ঢাকার দুই করপোরেশনভুক্ত এলাকার মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও অন্যান্য ব্যবধানের দেয়াল তৈরি হয়ে এ টেল অব টু সিটির উপাখ্যান সৃষ্টি হতে পারে।
আমার ভাবতে অবাক লাগে, আওয়ামী লীগ সরকারের মতো একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেবল নির্বাচনী জয়-পরাজয়কে বিবেচনা করে এত দীর্ঘকাল খোদ রাজধানীর পৌর সংস্থার মেয়র নির্বাচন কীভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারেন এবং এখন সংস্থাটি দু'ভাগ করার সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। এক করপোরেশনের বদলে দুটি করপোরেশন চালাতে গেলে খরচও বাড়বে দ্বিগুণ। এমনিতেই রাজধানীর নাগরিকরা করভারে জর্জরিত। তার ওপর বিভক্ত করপোরেশনের বর্ধিত খরচ সংকুলানের জন্য তাদের ওপর নতুন করের বোঝা চাপানো হলে তারা খুশি হবে কি?
আসলে ঢাকায় মানুষকে উন্নত নাগরিক পরিসেবা দিতে হলে সিটি করপোরেশন ভাগ করে খুব বেশি লাভ হবে না। ঢাকা করপোরেশন কেন, দেশের সবগুলো সিটি করপোরেশনের জন্য যা দরকার, তা হলো লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিওর মতো সিটি করপোরেশনগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। সরকারের হস্তক্ষেপ ও আমলাতন্ত্রের লালফিতার দৌরাত্ম্য সেখানে থাকবে না।
কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রের মূলভিত্তি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে রাজি নন। সাংসদরা জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের ওপর পর্যন্ত তাদের অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক খবরদারি ছাড়তে রাজি নন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে দুটি বড় দলেরই এই মনোভাব একটি বড় বাধা।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে কী লাভ হবে আমি জানি না। তার বদলে করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়রের প্রাপ্য ক্ষমতা বাড়ালে, ঢাকা সিটির ৯২টি ওয়ার্ডের ৯২ জন ওয়ার্ড কমিশনারের নাগরিক পরিসেবা দানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়ালে বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। এটাই চেয়েছিলেন ঢাকার প্রয়াত জনপ্রিয় সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ঢাকার মেয়র থাকাকালে একাধিকবার বিদেশ সফরে এসেছেন, শুধু লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিনের মতো শহরগুলোর পৌর ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপমুক্তভাবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কীভাবে নাগরিক জীবনের সব চাহিদা মেটায়, তা পর্যবেক্ষণ এবং ঢাকায় তা অনুসরণের ইচ্ছা নিয়ে। তখন আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ঢাকা করপোরেশনকে উন্নত ও সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত করার ব্যাপারে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের ক্রমাগত বাধার দরুন মোহাম্মদ হানিফ সফল হতে পারেননি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানতাম বলে তার হতাশা ও মনোবেদনার কথা আমি জানি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার হাতে অর্থ থাকলে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে চার ভাগ করতেন। রাজধানীর মানুষকে নাগরিক সেবাদানের কাজ উন্নত করার ইচ্ছাই যদি তার থাকে, তাহলে ঢাকা শহরের এই পরিকল্পিত চার এলাকার জন্য তিনি বর্তমান সিটি করপোরেশনে চারজন ডেপুটি মেয়র পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে পারেন। তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়াতে পারেন। আরেকটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার জন্য অহেতুক অর্থ ব্যয় না করে বর্তমান সিটি করপোরেশনেরই আর্থিক বরাদ্দ বাড়াতে পারেন। তা না করে এই যে রাতারাতি রেডক্লিফের ছুরি চালানো হলো ঢাকা সিটি করপোরেশনের বুকে, ফল কী হবে তা আমি জানি না।
ব্রিটেনের সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তার দেশের মানুষের কাছে অন্তত তিন টার্ম একটানা প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটেনের মানুষ তার ইচ্ছা পূরণ করেছিল। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রিত্বের তৃতীয় টার্মের শেষ পর্যায়ে তিনি জেদ ধরলেন, জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তিনি পোল ট্যাক্স নামে একটি কর প্রবর্তন করবেনই। প্রবল গণঅসন্তোষের মুখে তাকে তৃতীয় টার্ম শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা থেকে সরকার বিরত না হলে ব্রিটেনের মতো অবস্থা ঘটবে তা বলি না। কিন্তু এর ফলে সৃষ্ট গণঅসন্তোষ যে আগামী সাধারণ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনেও বিরাট প্রভাব ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই।
লন্ডন, ২ ডিসেম্বর শুক্রবার, ২০১১
No comments