পরিবেশ আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়-সাক্ষাৎকার by ড. নজরুল ইসলাম

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অর্থনীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক উদ্যোগ 'বেন' (বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বৈশ্বিক সমন্বয়কারী। ২০০৬ সালে বর্তমান কর্মস্থলে যোগদানের আগে তিনি জাপানভিত্তিক ইসিএসইএডির রিসার্চ প্রফেসর এবং উন্নয়ন কৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নজরুল ইসলাম জাপানের কিয়ুশু


ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল স্টাডিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮০ সালে তার কর্মজীবন শুরু। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও ১৯৯৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিষয়ে ১৯৮০ সালে রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তার জন্ম ১৯৫৭ সালে মুন্সীগঞ্জে। সর্বসম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের গ্রাম : অতীত ও ভবিষ্যৎ' (২০১১), ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'রিসার্জেন্ট চায়না : ইস্যুজ ফর দ্য ফিউচার' (২০০৯) এবং 'ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড টাস্কস ফর বাংলাদেশ' (যৌথভাবে সম্পাদিত; ২০০৯)
সমকাল : প্রান্তিক ভাবনা হিসেবে শুরু হয়ে পরিবেশ এখন অন্যতম কেন্দ্রীয় ইস্যু। পরিবেশ আন্দোলনের বৈশ্বিক প্রবণতা কেমন?
নজরুল ইসলাম : পরিবেশ আন্দোলন দিন দিন প্রভুত্ব বিস্তারকারী হয়ে উঠছে। আগে অনেক সময় প্রান্তিক মনে হতো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে চলে আসার পর পরিবেশ ইস্যু এখন সবকিছু ছাপিয়ে উপরে উঠেছে। এর একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিই। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে জাতিসংঘে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এমডিজি যখন গৃহীত হয়, তখন এর আটটি লক্ষ্যের মধ্যে সাত নম্বরটিতে কেবল পরোক্ষভাবে পরিবেশ ইস্যু স্থান পেয়েছে। এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও আছে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই আমরা দেখছি, অন্যান্য ইস্যু ছাপিয়ে পরিবেশের বিষয়টিই এগিয়ে এসেছে। এই এমডিজি ২০১৫ সালে চূড়ান্ত পর্বে পেঁৗছবে। তার পরের লক্ষ্যে যে পরিবেশই প্রাধান্য পাবে, সে ব্যাপারে এখনই কথাবার্তা হচ্ছে। গত কয়েক বছরে পরিবেশ আন্দোলনের ভূমিকা, গুরুত্ব এবং সমাজে এর ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে।
সমকাল : আমরা দেখেছি উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপে পরিবেশবাদী রাজনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে। জার্মানির গ্রিন পার্টি এখন ক্ষমতাসীন জোটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা আসলে কী করে? পরিবেশ সুরক্ষার জন্য রাজনীতি, না রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবেশ ইস্যুকে অগ্রাধিকার দেয়?
নজরুল ইসলাম : এই দলগুলো চায়, পরিবেশের ইস্যু রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব লাভ করুক। এর জন্য দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝানো। দ্বিতীয়ত, নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত হওয়া। কারণ কেবল পরিবেশ ইস্যুর দিকে নজর দিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা করা যাবে না। বাংলায় একটি কথা আছে, কান টানলে মাথা আসে। সে রকমই পরিবেশ সুরক্ষা করতে হলে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি পরিবেশবান্ধব হতে হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও ইউরোপে গ্রিন পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটছে। ইউরোপের রাজনৈতিক দলগুলো এমনিতে যথেষ্ট পরিবেশবান্ধব। কিন্তু সেখানকার পরিবেশবাদীরা মনে করছেন, সামগ্রিক পরিবর্তন ছাড়া পরিবেশ সুরক্ষা করা যাবে না। তারা মনে করছেন, রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হলেই অন্য সব নীতি প্রভাবিত করা যাবে। জার্মানিতে এই ধারা সবচেয়ে এগিয়ে গেছে। গোটা ইউরোপেই গ্রিন পার্টি এখন প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি।
সমকাল : বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশ ইস্যুতে কতটা আন্তরিক। পরিবেশবাদী রাজনৈতিক সংগঠন বা জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনাই-বা কতখানি?
নজরুল ইসলাম : আমি সম্ভাবনা দেখি। তবে এখনও তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বাপা (বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন) নেতৃবৃন্দকে মাঝে মধ্যে আমি ঠাট্টা করে বলি, পরিবেশ বাঁচাতে হলে এই সংগঠন থেকে নির্বাচন করা যেতে পারে, এমপি নির্বাচন করা যেতে পারে। বাংলাদেশে বরং আমরা চেষ্টা করছি, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক হোক, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা, পরিকল্পনা গ্রহণ করুক। আপনি জানেন, প্রথম থেকেই বাপা সব কাজে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করে আসছে। সব রাজনৈতিক দলকেই আমরা পরিবেশ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে চাই। বিশেষ করে বড় বড় সম্মেলন ও আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকি আমরা। এটা খুশির ব্যাপার, যে স্বল্পসংখ্যক সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা উপস্থিত থাকেন, তার মধ্যে বাপাও রয়েছে। তারা এসেছেন, পরিবেশের পক্ষে অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন। এটা আমাদের সাফল্য। প্রধান দুটি দল শুধু নয়, সব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই আসেন। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়, আমাদের প্রস্তাব তাদের কাছে পেঁৗছে দেই। এখন পর্যন্ত এই ধারাতেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই, এই ধারা সফল হোক। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোই পরিবেশবান্ধব নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করুক, যাতে করে নতুন করে পরিবেশবাদী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা না দেয়। তবে ভবিষ্যৎ প্রমাণ করবে সবকিছু।
সমকাল : রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে আমরা সভা-সেমিনারে পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিতে দেখি। তাদের নীতি, কর্মসূচি বা ইশতেহারে পরিবেশ ইস্যু কতখানি প্রতিফলিত হয়?
নজরুল ইসলাম : এ ক্ষেত্রে ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। যেমন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলেরই এখন পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক রয়েছে। আগে কিন্তু ছিল না। এটা একটা অগ্রগতি। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, কিছুটা হলেও নিজস্ব অবস্থান জানানোর চেষ্টা করে। তবে এসব অগ্রগতি প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। বাংলাদেশের মতো দেশে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় বিবেচনায় থাকা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি বিচারে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা করে দেশ কীভাবে টিকে থাকবে, এটাই এখন রাজনীতিকদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত। দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইস্যু নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটিই সবচেয়ে বড়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের সর্বস্তরে এর প্রতিফলন থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিবেশ ইস্যুতে আরও অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখা জরুরি, পরিবেশ আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
সমকাল : সরকারিভাবে বোধহয় পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগ বেড়েছে।
নজরুল ইসলাম : হ্যাঁ, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নদী রক্ষার বিষয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। ড্রেজিং করে নদীপথের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য মহাপরিকল্পনা হয়েছে। নদী দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে অভিযান বেড়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে ৯-১০ ফুট পলিথিন স্তর জমে গিয়েছিল। সেগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরিবেশ ইস্যুতে পিছিয়ে রয়েছে। নেতাকর্মীরা পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতনও নয়, আন্তরিকও নয়। একই কথা বলা চলে বিএনপির ব্যাপারেও। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এবং সময়ের দাবি পূরণ করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিবেশ ইস্যুতে আরও অনেক কিছু করতে হবে।
সমকাল : রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই তো পরিবেশ ধ্বংসকারী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত। নদী দখল করছে রাজনৈতিক নেতারা। বন উজাড় করছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। যে দলই ক্ষমতায় থেকেছে, আমরা কমবেশি একই চিত্র দেখেছি। পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে তারা নিজেরাই তো চ্যালেঞ্জ।
নজরুল ইসলাম : হ্যাঁ, তারা নিজেরাই বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্যই তো শীর্ষ নেতৃত্ব শুধু সচেতন হলে চলবে না, দলের ভেতরে, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও সচেতন করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক দল নয়_ আপনি দেখবেন, সামগ্রিকভাবে পরিবেশ সচেতনতার দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। আমার মনে আছে, ১৯৯৯ সালে বুড়িগঙ্গা সেতুর পাদদেশে একটি জমায়েত করেছিলাম। সেটা থেকেই বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সূচনা। পরে নদী বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেই সমাবেশ করা হয়েছিল, কারণ ওই সেতুর কাছেই সেনা কল্যাণ সংস্থা নদীর মধ্যে জেটি তৈরি করেছিল। তার মানে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানও নদীর গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। যেমন সম্প্রতি গাজীপুর জেলা প্রশাসক নদীর মাঝখানে সীমানা পিলার স্থাপন করেছেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের দেশে পরিবেশ, নদ-নদীর গুরুত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা সামান্যই।
সমকাল : এই সচেতনতার অভাব কি নির্বাহী পর্যায়ে, না জনগণ পর্যায়ে?
নজরুল ইসলাম : নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকদের তো বটেই, পরিবেশ সচেতনতা জনগণের পর্যায়েও প্রসারিত হতে হবে। সে কারণে পরিবেশ বিষয়ে গণজাগরণ বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। বড়াল নদীকে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনি জানেন। সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড স্লুইস গেট করেছে। সেটা এক ধরনের ভ্রান্ত নীতির ফল। কিন্তু খোদ জনপ্রতিনিধিরা যা করেছেন, তা আরও বিপজ্জনক। কেবল চাটমোহর উপজেলায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় বড়াল নদীতে তিনটি ক্রসবাঁধ নির্মিত হয়েছে। তাদের তো বোঝা উচিত ছিল নদীকে এভাবে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। সে কারণেই রাজনীতিক, প্রশাসন, সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ ইস্যুতে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার।
সমকাল : আমরা দেখছি, গত এক দশকে সারাদেশে পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত নানা উদ্যোগও গড়ে উঠেছে। ঠিক যেভাবে আমেরিকা এবং ইউরোপে পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। ছোট-বড় এসব উদ্যোগ পরিবেশ ইস্যুকে মূলধারায় পরিণত করার ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?
নজরুল ইসলাম : পরিবেশ ইস্যুতে ছোট-বড় নানা উদ্যোগ গড়ে ওঠাকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। যদিও এর মধ্যে কিছু কিছু উদ্যোগের পেছনে দুরভিসন্ধিও রয়েছে। তারা শিল্পপতিদের কাছ থেকে, দখলদারদের কাছ থেকে, অবৈধ অর্থ পায় বলে আমাদের কাছে খবর আসে। সেগুলো অবশ্য কম। আমরা চাই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্যোগ গড়ে উঠুক। স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে আসুক। সেদিক থেকে পরিবেশ বিষয়ক সৎ ও আন্তরিক উদ্যোগ বাড়তে থাকুক। এটা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও দ্রুত ও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে পরিবেশ ইস্যুকে মূলধারায় পরিণত করা কঠিন হবে না। সে ক্ষেত্রে মিডিয়ারও ভূমিকা রয়েছে।
সমকাল : কেউ কেউ সমালোচনা করে থাকেন যে আমাদের দেশের পরিবেশবাদী উদ্যোগগুলো যতটা সভা-সেমিনার, র‌্যালি ও মানববন্ধনে উদ্যোগী; পরিবেশ বিষয়ে নিজস্ব গবেষণা, সমীক্ষার ব্যাপারে ততটা আগ্রহী নয়। আপনার মত জানতে চাই।
নজরুল ইসলাম : এই সমালোচনা সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। বাপার সঙ্গে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আমরা বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের সমাবেশ ঘটিয়েছি এখানে। কারণ শুধু গবেষণা দিয়ে যেমন পরিবেশ বাঁচানো যাবে না, শুধু আন্দোলন দিয়েও সম্ভব নয়। পরিবেশ বিষয়ক সব উদ্যোগকেই এই সত্য অনুধাবন করতে হবে। তবে আপনাকে এ কথা আমি বলতে পারি যে বাংলাদেশে পরিবেশ বিষয়ে যত গবেষণা ও নথিকরণ হয়, তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোনো দেশে তেমন হয় না। যারা এ ধরনের সমালোচনা করছেন, তারা হয়তো পূর্ণ চিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
সমকাল : আমরা জানি, বাপা তহবিলের বিনিময়ে কাজ করে না। কিন্তু অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের ক্ষেত্রে অভিযোগ হচ্ছে, পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগের এনজিওকরণ বেড়েছে, তহবিল নির্ভরতা বাড়ছে। তাহলে আন্দোলন কীভাবে হবে?
নজরুল ইসলাম : সেটা শুধু পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগে সীমাবদ্ধ নেই। উন্নয়ন কাজ, সামাজিক উদ্যোগ_ সবকিছুরই একটি এনজিওকরণ হয়েছে। তহবিল নির্ভরতা বেড়েছে। পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন এগিয়ে নিতে হলে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। তাতে করে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা কম কাজ হলেও ভালো। তা না হলে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা কঠিন। জনগণের জন্য কাজ করতে দামি হোটেলে যেতে হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের মতো পাবলিক স্পেসগুলো ব্যবহার করলেই তো হয়!
সমকাল : আপনি তো দেশের বাইরে থাকেন। সেখানে পরিবেশ আন্দোলন, সেগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়? অর্থায়ন কীভাবে হয়?
নজরুল ইসলাম : দেশভেদে ভিন্ন হয়। জার্মানিতে গ্রিন পার্টি আছে। তারা সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। উন্নত বিশ্বের সুবিধা হচ্ছে যে সেখানে পরনির্ভরতা বিস্তৃত হয়নি। উন্নয়নশীল বিশ্ব, যেসব দেশ উপনিবেশ ছিল, সেখানকার পরিবেশ বিষয়ক আন্দোলনগুলো পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। উন্নত বিশ্বে সাধারণ মানুষ পরিবেশ আন্দোলনের জন্য ডোনেট করে। পাঁচ ডলার পর্যন্ত চাঁদা দেয়। তবে সেখানেও ঝামেলা আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগগুলো যত না বেশি সদস্য ও ব্যক্তি পর্যায়ের চাঁদার ওপর নির্ভরশীল, তার চেয়ে অনেক বেশি বড় বড় প্রতিষ্ঠানের চাঁদার ওপর নির্ভর করে। ধনীরাও আবার আয়কর রেয়াতের জন্য সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগে চাঁদা দেয়। তারা যে পরিমাণ চাঁদা দেয়, তার চেয়ে বেশি আয়কর রেয়াত পায়। তাতে করে লাভও হয়, নামও হয়।
সমকাল : আমরা সবাই প্রত্যাশা করি বাংলাদেশে কার্যকর পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠুক। আপনি নিজেও এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম : বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশ সুরক্ষার বিকল্প নেই। সমকাল সে ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশা করি। আপনাকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.