পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-নিয়োগ-প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন by শান্ত নূরুননবী

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগবৃত্তান্ত নিয়ে বহুবিধ বিরূপ মন্তব্য প্রায়ই শোনা যায়, কিন্তু গঠনমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। নিয়োগ-প্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত হওয়ার কারণে মেধাসম্পন্ন প্রার্থীরাই বঞ্চিত কেবল হন যে তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান, গবেষণামূলক কাজসহ সব কাজের মান নিম্নমুখী হয়, হচ্ছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে ভোট-নিয়োগ হয়ে থাকে।


ছাত্ররাজনীতির হীন অবস্থা যখন দেশের বিবেকে আঘাত করছে, তখন মেধাবী প্রার্থীরা অধ্যয়নের বাইরে রাজনীতি করার কথা কল্পনা করতে পারছেন না। অথচ শিক্ষক নিয়োগের সময় তাঁর গায়ে দলীয় পরিচয়ের লেবেল সেঁটে দেওয়া না থাকার কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারছেন না। একজন মেধাবী প্রার্থীকে বঞ্চিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দেওয়া আছে!
আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর পদগুলো ক্ষমতাসীন দলের হাতে চলে যায়। নিয়োগদানের জন্য মাননীয় উপাচার্য যখন নিয়োগ বোর্ড গঠন করেন, তখন এমন সব অধ্যাপকের বোর্ডের সদস্য করেন, যাঁরা উপাচার্যের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবেন না বলে নিশ্চয়তা থাকে। নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় যেহেতু শুধু সাক্ষাৎকার ছাড়া অন্য প্রক্রিয়া নেই, সেহেতু পছন্দসই প্রার্থী রেখে অন্যদের বাতিল করাটা অত্যন্ত সহজ। এমনকি শিক্ষক পদপ্রার্থীরা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কখনো কখনো একটি পদের বিপরীতে হয়তো ১০০ আবেদন রয়েছে, সেখানে শুধু একটি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে চাইলেও প্রকৃত মেধাবী বাছাই করা দুরূহ। দেশের পুরোনো চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ ভোটের কারণে হলেও শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ সম্পূর্ণভাবে সরকারের মনেভাবের ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকার তোষণনীতিই অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভিত্তি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দৃষ্টান্ত আশাব্যঞ্জক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বায়ত্তশাসিত হেতু নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিজেদের মতো করে তৈরি করার সুযোগ আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-প্রক্রিয়া অভিন্ন করে এবং সে নিয়োগ-প্রক্রিয়া এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে চাইলেই উপাচার্য নিজের পছন্দসই প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে না পারেন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমাদের প্রস্তাব, শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়ার একটি অংশ এরূপ থাকা প্রয়োজন, যাতে করে চাকরিপ্রার্থী শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করেন এবং শিক্ষার্থীরা তার মূল্যায়ন করেন। উপাচার্যগণ চাইলেই অ্যাডহক পদ্ধতিতে নিয়োগ দিতে পারেন। এটি একটি সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অ্যাডহক-ভিত্তিক নিয়োগ পরবর্তী সময়ে স্থায়ী করা হয়, যা নিয়োগ-প্রক্রিয়ার অন্যতম দুর্বলতা। অধিকাংশ সময়ে অ্যাডহক নিয়োগ ভালো হয় না। এসব নিয়োগদানের ক্ষেত্রে কি আমাদের এই বোধোদয়টুকু হয় না যে এঁরা প্রায় চার দশক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করবেন। এঁরা দিনের পর দিন শিক্ষার্থীদের শুধু বঞ্চিতই করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রথম শ্রেণী কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড কিংবা নন-গেজেটেড কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) রয়েছে। পিএসসির মাধ্যমে একজনকে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার চাকরি পেতে হলে অনেক রকম মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। যাঁরা বিসিএসের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হন, তাঁদের প্রিলিমিনারি বাছাই হয়, তারপর লিখিত পরীক্ষা, সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা ইত্যাদি হয়। কয়েকটি স্তরে বিভাজিত পরীক্ষায় অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির উদাহরণ যে নেই তা নয়, তবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হয় না।। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় শুধু একটি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে থাকে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা একেবারেই কাম্য নয়।
হরহামেশাই শোনা যায়, চারটি প্রথম শ্রেণী থাকা সত্ত্বেও তিনটি প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত শিক্ষার্থী মেধাবী। এ ব্যাপারে মতভেদের সুযোগ কম থাকলেও এ কথাও সমান সত্য যে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অর্ধশতাধিক প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রথম শ্রেণী আজকাল অর্জন করাও যায় না, শিক্ষকেরা প্রথম শ্রেণী প্রদান করেন! ঢাকা কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা সম্মান কিংবা স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে প্রথম শ্রেণী বছরের পর বছর পায়ই না, সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষার্থীসংখ্যার অর্ধেকও অনেক সময় প্রথম শ্রেণী পাচ্ছে। এ অবস্থায় এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর মান শুধু ফলাফলে বিচার করা অসম্ভব। সে কারণে শুধু সনদপত্রকেই মেধা বিচারের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তার পরও যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণের প্রতি নৈতিক আস্থা রাখা যেত, তাহলে হয়তো শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ন্যূনতম মেধা যাচাই সম্ভব হতো। সুতরাং বাস্তবতার আলোকে নিয়োগ-প্রক্রিয়া এমনভাবে সাজানো প্রয়োজন, যাতে করে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ না থাকে।
বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিচারের ক্রম অনুযায়ী প্রথম কয়েক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম তুলে ধরতে চাইলে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে দেশে যে নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে সরকারকে দূরদর্শী হতে হবে, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের যোগ্য প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বার্থেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পচনের মাত্রাটা এখনো হয়তো চিকিৎসাযোগ্য। সুন্দর একটি দেশের প্রার্থনা করলে সর্বপ্রথম সুশিক্ষা দানের উত্তম ভূমি প্রয়োজন।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.