আমাদের এমপি সাহেবের কী গতি করা যায়? by ফজলুল বারী
আমাদের দেশের একজন আলোচিত এমপি আরেকটি ঘটনা ঘটিয়েছেন! ইনি রাজধানীর মিরপুরের কামাল আহমেদ মজুমদার। পাড়া গাঁ’র কোনো এমপি না। খোদ ঢাকা শহরে থাকেন। সারাদিন মিডিয়ার লোকজন দেখেন, নানাভাবে তাদের ফেসও করেন। নিজস্ব মিডিয়াও তার আছে।
কিন্তু সেই তিনিই কিনা এভাবে হাত তুললেন দেশের একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে! তার নেত্রীও কিন্তু একজন নারী! বিদেশের পত্রপত্রিকা-মিডিয়ার মতো দেশি মিডিয়ার অনলাইন সংস্করণেও আজকাল ভিডিও ক্লিপ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ কারণে আমরা অনলাইনের পাঠক-দর্শকরা বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকি, তারা কিন্তু অনেক উপকার পাচ্ছি। কোনো একটি ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারছি। এ ভিডিও ক্লিপটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়েছি, কামাল মজুমদারের ঘটনাটিও সত্য। সাজানো-বানানো কিছু নয়।
দেশের একজন আইন প্রণেতা হিসাবে এ ঘটনায় তিনি সীমা লঙ্ঘন করেছেন। আইন প্রণেতা হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গুরুতর অন্যায় করেছেন। এ ঘটনার দায় তাকে নিতে হবে। ঘটনাটিতে সাংবাদিকতার নামে বাড়াবাড়িও আছে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আমার বা আমাদেরও কিছু সীমারেখা আছে, আছে কোড অব এথিক্স। সীমার বাইরে আমরা যেতে পারি না বা সে ব্যাপারে দেখে-শুনে কাউকে প্রশ্রয়ও দিতে পারি না। এ বিষয়টিতে পরে আসছি। আগে দেখা যাক, আমরা আমাদের এমপি সাহেবের জন্য কী করতে পারি।
আমি যে দেশটায় থাকি, এ দেশটায় অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু এমন ঘটনা অকল্পনীয়। এদেশের এমপি-মন্ত্রীরাও কিন্তু আমার দেশের এমপি-মন্ত্রীদের মতো এত মহা শক্তিধর না যে, এলাকার গরুর বাজার থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ সব কিছুরই পরিচালনা কমিটির সভাপতি বনে যাবেন! যেমন, এদেশে কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাও খুব কম লোক জানে। পুলিশের কাজ পুলিশ করে। কোনো ঘটনায় মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন এলাকার পুলিশ কমিশনার। কারণ, তার এলাকার কোন বেআইনি ঘটনার প্রতিকার নিয়ে পুলিশ কী করেছে না করেছে, তা কিন্তু কমিশনারের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
কামাল মজুমদারের মতো এমন একটি ঘটনা অস্ট্রেলিয়ায় ঘটলে কিন্তু সঙ্গে এ জাতের এমপি-মন্ত্রী যেই হোন না কেন তাকে ঘটনার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করে চলে যেতে হতো। শুধু তাই না, প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়ে মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা, পুলিশ কেস শুরু থেকে শুরু হয়ে যেতো সব। এসব তদন্ত প্রভাবমুক্ত হবার স্বার্থেই এ ধরনের দায়িত্বশীলদের পদত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমাদের আমাদের নেতাদের চামড়া যেহেতু গণ্ডারের চেয়ে পুরু, তাদের হায়া-শরম কম, সরকারি দলের লোক হতে পারলে তারা প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে থাকেন, তারা এসবের ধার ধারেন না, বা ধরতে হয় না।
কল্পনা করুন, মঙ্গলবারের ঘটনাটি যদি কামাল মজুমদার না হয়ে বিএনপির কোনো এমপি করতেন, তাহলে এতক্ষণে কতগুলো মামলা চালু হয়ে যেতো? ঘটনার দিনেই ঢাকায় পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সবাই মিলে পুলিশকে দলীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে নির্ভয়ে কঠোর হস্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালনের বড় বড় বক্তৃতা দেননি? এসব কি আইনের শাসনের নমুনা?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয় ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন। স্পিকার আব্দুল হামিদও দেখেছেন নিশ্চয়। এ ঘটনা দেখে তারা নিশ্চয় লজ্জিত হয়েছেন। যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষের এমন ঘটনা দেখে লজ্জিত হবার কথা। বিশেষ করে যারা রাজনীতি করেন। রাজনীতির মাধ্যমে যারা আমাদের ভদ্রভাবে আইনানুগ জীবন-যাপনের কথা বলেন অথবা সেভাবে চলার বলার স্বপ্ন দেখান, এ ভিডিও ক্লিপ দেখে তারাও তারাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন তাদের এই এমপির আচার-আচরণ কতোটা অভদ্র, জঘণ্য!
আইনসভার একজন সদস্যের যদি এ চেহারা হয় তাহলে দেশের পার্লামেন্ট, আইনের শাসনেরইবা কী চেহারা দাঁড়ায়? একজন সরকার-দলীয় এমপি করেছেন বলে যদি এমন অভব্য ঘৃণ্য আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে কী সরকার দেশের দৃর্বৃত্ত দমনের নৈতিক অধিকার হারায় না?
২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ দুহাত ভরে দিয়েছিলো এই প্রধানমন্ত্রীকে। এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিলো যে সরকার গঠন পরিচালনা থেকে শুরু করে কোথাও কারো মুখোমুখি হতে হয়নি এবং এখনও হচ্ছে না। কিন্তু এসব কী এ সরকার, এর কিছু লোকজনের মধ্যে বিশেষ কিছু ঔদ্ধত্য-স্বেচ্ছাচারিতার সৃষ্টি করেনি? কামাল মজুমদারের ঘটনাটি কি তেমন একটি স্বেচ্ছাচারিতার নমুনা নয়?
এবার ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের কোনো একটি দলীয় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কী শক্ত ভূমিকা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? এ দলটিকেই কী আগামী নির্বাচনে আবার জনগণের ভোটের মুখোমুখি হতে হবে না? ভোটে জিততে তখনও কী পাবলিকের পাশাপাশি মিডিয়া লাগবে না? এ ঘটনাগুলো নিয়ে কী জবাব দেওয়া যাবে ভোটের বাজারে?
একজন এমপি যদি প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে গুণ্ডামি করেন, ‘গুলি কর গুলি কর’ বলে মিডিয়ার লোককে শাসান তখন এসব নিয়ে কী সংসদের অভিভাবক স্পিকারের কিছুই করার নেই। একটি সার্বভৌম সংসদের স্পিকারেরও এমন সাক্ষী-গোপাল চরিত্র? মিরপুরের পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একজন এমপির গুণ্ডামির ঘটনার পর আইনগত কী ভূমিকা নিয়েছেন মিরপুর থানার ওসি? বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এ ঘটনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী দৃষ্টান্ত রেখেছেন?
বিএনপি-জামায়াতের কে কখন গাড়ি পুড়িয়েছেন, এসব নিয়ে যদি গবেষণা করে করে সত্য-মিথ্যা ব্যবস্থা নেওয়া যায়, প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে সরকারদলীয় একজন এমপির গুণ্ডামির প্রতিকারে তারা কী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে জবাবদিহিতো তাদেরকে করতেই হবে। টুডে অর টুমরো। যে কোনো স্থানে অথবা ফোরামে।
আজ ক্ষমতা আছে বলে একজন সাংবাদিকের ক্যামেরা অথবা বুম হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবেন? গায়ে হাত তুলবেন একজন সাংবাদিকের গায়ে? তাও একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে? ক্ষমতাতো আমাদের অনেকের ছিলো! এখন কিভাবে রাস্তাঘাটে তাদের ঘোরাঘুরি করতে হয়, তা দেখে-শুনেও কি হুঁশ হয় না?
এখন একটু সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলি। দেশে কোনো দিন সাংবাদিকতায় পড়াশুনা করিনি অথবা করাও লাগেনি। হাতুড়ে ডাক্তারের মতো সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লেও মাশাল্লা কিন্তু বেশ ছিলাম! কিন্তু এদেশে সাংবাদিকতায় পড়তে এসে প্র্যাকটিক্যালি অনেক কিছু দেখে-শুনে সবার আগে যে আত্ম উপলদ্ধি হয় তাহলো দেশেতো সাংবাদিকতা করিনি, সাংবাদিকতার নামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি! দেশে সংবাদের সাবজেক্টের বেশিরভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত বলে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি বা তুলতে পারেনি। দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়াতে সাংবাদিক দেখলেই বা বেত দেখেই দৌড়ে পালিয়েছে। মিরপুরের ওই স্কুলে অভিভাবকদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছিল। এর জন্য সাংবাদিক যাতে না ঢুকতে পারেন, সেজন্য প্রহরা রাখা হয়েছিল গেটে! কিন্তু তারা যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে কিন্তু আমি বা আমরা জোর করে কোনো প্রাইভেট প্রেমিসে ঢুকতে পারি না। সেখানে কৌশল করে যদি অভিভাবকের বেশে ঢুকি তাহলে সেটিও রিপোর্টে স্বচ্ছতার জন্য ব্যাখ্যা করে বলতে হবে।
আরটিভি‘র সাংবাদিকরা অনুমতি নিয়ে স্কুল প্রেমিসের ভিতরে ঢোকার কথা বলেছেন। আবার আরেক ভাষ্যে আছে অনুমতি ছাড়া ঢোকার কথা বলে স্কুলের শিক্ষকসহ কিছু স্টাফ গুণ্ডার মতো আচরণ করে তাদের সেখান থেকে বের করে দিতে উদ্যত হন। তাদের কাজ-কর্মে যদি স্বচ্ছতা থাকতো তাহলে তারা তাদের স্কুলে আসা কোনো সাংবাদিক বা সাধারণ অতিথির সঙ্গেও এমন আচরণ করতেন না। কোনো ভদ্রলোক কী এমন করে?
এরপর সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত ও বের হয়ে আসার পথে এমপির দেখা পেয়ে আমি বা আমরা কী আগে এমপিকে বলেছি যে, আমরা এ সাবজেক্ট নিয়ে কথা বলবো?, না রাস্তায় পেয়েই ‘কথা বলেন, কথা বলেন’ বলে ক্যামেরা স্টার্ট করে দিয়েছি? দেশে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু তাই করি। তথ্য পাবার নির্ধারিত-সুনির্দিষ্ট সূত্রের অভাবের কারণে এ অভ্যাসটি আমাদের গড়ে উঠেছে।
এখন একজন এমপি যিনি সংশ্লিষ্ট স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। অন্যরাও এমন বলেন, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে যদি কথা বলতে না পারেন বা কথা বলার বিষয়ে প্রস্তুত না হন সেটিও কিন্তু রিপোর্টারকে বলতে পারেন। ধাক্কা দিয়ে ক্যামেরা ফেলে দিতে পারেন না। রিপোর্টারের গায়ে হাত তুলতে তো নয়ই।
এটা স্রেফ গুণ্ডামি হয়েছে, যা একজন এমপি করতে পারেন না। এখন একজন এমপি গুণ্ডামি করার পর আমি বা আমাদের কাজ কী? আমরাতো বিষয়টির বিস্তারিত আমাদের রিপোর্টে লিখবো, বা টিভি রিপোর্টিং’এ তা ফুটিয়ে তুলবো। কিন্তু আমি বা আমরাতো গুণ্ডামির মতো এর পালটা কিছু করতে পারি না। একজন যদি কথা বলতে না চায় বারবার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু তাকে বাধ্য করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট লোক যদি আমাকে বা আমাদের শাসায় বা শাসিয়েছে বলে মনে হয়, এটিওতো আমরা আমাদের রিপোর্টে ফুটিয়ে তুলতে পারি।
এর জন্য দেশের আইন আছে, আমি-আমরা আইনের দ্বারস্থ হতে পারি, কিন্তু আমি বা আমরাতো তাকে শাসাতে বা সে রকম কিছু করার চেষ্টা করতে পারি না। এতে রিপোর্টার হিসাবে আমার সীমালঙ্ঘন, একজন এমপির গুণ্ডামির বিরুদ্ধে আমার-আমাদের অভিযোগ দুর্বল হয়। আজকাল কিন্তু নানা ঘটনায় এমন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ভিডিও ক্লিপিংসে কিন্তু এমন সুস্পষ্ট বেশ কিছু সাউন্ড আছে সাংবাদিকতার নীতিমালায় কোনো অবস্থাতেই তা আমরা করতে বা এ ধরনের আচরণের সঙ্গে জড়িত-সম্পৃক্ত হতে পারি না।
সাংবাদিক নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু করার ঘটনার প্রতিবাদ-নিন্দা করতে গিয়ে আম-জনতার মতো সাংবাদিকরাও প্রেসক্লাবের সামনে পাবলিকের গাড়ি ভেঙেছেন, প্রাইভেট প্রপার্টিতে আগুন দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আবেগ-সহানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, এসব কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমরা করতে পারি না। দেশের অসহায় আম-জনতা পাবলিকের কিছু করণীয় নেই বলে এসব করে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা করে, কিন্তু আমাদেরতো মিডিয়া আছে।
আমাদের প্রতিবাদসহ যা কিছু তা আমরা আমাদের মিডিয়ার মাধ্যমে করতে পারি। রাস্তায় ভাঙ্গচুর-আগুন দিয়ে নয়। সারা বছর নিখিল ভদ্রের মতো অসংখ্য ঘটনা দেশে ঘটছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে-পঙ্গু হচ্ছে।
কাজেই আমরা আমাদের শক্তির যাতে হেলায় অপব্যবহার না করি। আমাদের প্রতি দেশবাসীর আস্থা-ভালোবাসার সম্মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। যেন ভুলে না যাই সীমা লঙ্ঘন করে আমরাও কিন্তু যা খুশি করার লাইসেন্সপ্রাপ্তও নই। কামাল মজুমদারের গুণ্ডামির ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের মিডিয়ার মুরব্বিরা এ ঘটনার শিকার আমাদের লাঞ্ছিতা বোন অপর্ণার পাশে দাঁড়াবেন, এ ঘটনা থেকে যা শিক্ষণীয় তা কাজে লাগাবেন আশা করছি।
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
এ কারণে আমরা অনলাইনের পাঠক-দর্শকরা বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকি, তারা কিন্তু অনেক উপকার পাচ্ছি। কোনো একটি ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে পারছি। এ ভিডিও ক্লিপটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়েছি, কামাল মজুমদারের ঘটনাটিও সত্য। সাজানো-বানানো কিছু নয়।
দেশের একজন আইন প্রণেতা হিসাবে এ ঘটনায় তিনি সীমা লঙ্ঘন করেছেন। আইন প্রণেতা হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে গুরুতর অন্যায় করেছেন। এ ঘটনার দায় তাকে নিতে হবে। ঘটনাটিতে সাংবাদিকতার নামে বাড়াবাড়িও আছে। একজন সাংবাদিক হিসাবে আমার বা আমাদেরও কিছু সীমারেখা আছে, আছে কোড অব এথিক্স। সীমার বাইরে আমরা যেতে পারি না বা সে ব্যাপারে দেখে-শুনে কাউকে প্রশ্রয়ও দিতে পারি না। এ বিষয়টিতে পরে আসছি। আগে দেখা যাক, আমরা আমাদের এমপি সাহেবের জন্য কী করতে পারি।
আমি যে দেশটায় থাকি, এ দেশটায় অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু এমন ঘটনা অকল্পনীয়। এদেশের এমপি-মন্ত্রীরাও কিন্তু আমার দেশের এমপি-মন্ত্রীদের মতো এত মহা শক্তিধর না যে, এলাকার গরুর বাজার থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ সব কিছুরই পরিচালনা কমিটির সভাপতি বনে যাবেন! যেমন, এদেশে কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাও খুব কম লোক জানে। পুলিশের কাজ পুলিশ করে। কোনো ঘটনায় মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন এলাকার পুলিশ কমিশনার। কারণ, তার এলাকার কোন বেআইনি ঘটনার প্রতিকার নিয়ে পুলিশ কী করেছে না করেছে, তা কিন্তু কমিশনারের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
কামাল মজুমদারের মতো এমন একটি ঘটনা অস্ট্রেলিয়ায় ঘটলে কিন্তু সঙ্গে এ জাতের এমপি-মন্ত্রী যেই হোন না কেন তাকে ঘটনার দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করে চলে যেতে হতো। শুধু তাই না, প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়ে মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা, পুলিশ কেস শুরু থেকে শুরু হয়ে যেতো সব। এসব তদন্ত প্রভাবমুক্ত হবার স্বার্থেই এ ধরনের দায়িত্বশীলদের পদত্যাগ গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু আমাদের আমাদের নেতাদের চামড়া যেহেতু গণ্ডারের চেয়ে পুরু, তাদের হায়া-শরম কম, সরকারি দলের লোক হতে পারলে তারা প্রচলিত আইনের উর্ধ্বে থাকেন, তারা এসবের ধার ধারেন না, বা ধরতে হয় না।
কল্পনা করুন, মঙ্গলবারের ঘটনাটি যদি কামাল মজুমদার না হয়ে বিএনপির কোনো এমপি করতেন, তাহলে এতক্ষণে কতগুলো মামলা চালু হয়ে যেতো? ঘটনার দিনেই ঢাকায় পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সবাই মিলে পুলিশকে দলীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে নির্ভয়ে কঠোর হস্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব পালনের বড় বড় বক্তৃতা দেননি? এসব কি আইনের শাসনের নমুনা?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয় ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন। স্পিকার আব্দুল হামিদও দেখেছেন নিশ্চয়। এ ঘটনা দেখে তারা নিশ্চয় লজ্জিত হয়েছেন। যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষের এমন ঘটনা দেখে লজ্জিত হবার কথা। বিশেষ করে যারা রাজনীতি করেন। রাজনীতির মাধ্যমে যারা আমাদের ভদ্রভাবে আইনানুগ জীবন-যাপনের কথা বলেন অথবা সেভাবে চলার বলার স্বপ্ন দেখান, এ ভিডিও ক্লিপ দেখে তারাও তারাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন তাদের এই এমপির আচার-আচরণ কতোটা অভদ্র, জঘণ্য!
আইনসভার একজন সদস্যের যদি এ চেহারা হয় তাহলে দেশের পার্লামেন্ট, আইনের শাসনেরইবা কী চেহারা দাঁড়ায়? একজন সরকার-দলীয় এমপি করেছেন বলে যদি এমন অভব্য ঘৃণ্য আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তাহলে কী সরকার দেশের দৃর্বৃত্ত দমনের নৈতিক অধিকার হারায় না?
২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ দুহাত ভরে দিয়েছিলো এই প্রধানমন্ত্রীকে। এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিলো যে সরকার গঠন পরিচালনা থেকে শুরু করে কোথাও কারো মুখোমুখি হতে হয়নি এবং এখনও হচ্ছে না। কিন্তু এসব কী এ সরকার, এর কিছু লোকজনের মধ্যে বিশেষ কিছু ঔদ্ধত্য-স্বেচ্ছাচারিতার সৃষ্টি করেনি? কামাল মজুমদারের ঘটনাটি কি তেমন একটি স্বেচ্ছাচারিতার নমুনা নয়?
এবার ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের কোনো একটি দলীয় স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে কী শক্ত ভূমিকা দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? এ দলটিকেই কী আগামী নির্বাচনে আবার জনগণের ভোটের মুখোমুখি হতে হবে না? ভোটে জিততে তখনও কী পাবলিকের পাশাপাশি মিডিয়া লাগবে না? এ ঘটনাগুলো নিয়ে কী জবাব দেওয়া যাবে ভোটের বাজারে?
একজন এমপি যদি প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে গুণ্ডামি করেন, ‘গুলি কর গুলি কর’ বলে মিডিয়ার লোককে শাসান তখন এসব নিয়ে কী সংসদের অভিভাবক স্পিকারের কিছুই করার নেই। একটি সার্বভৌম সংসদের স্পিকারেরও এমন সাক্ষী-গোপাল চরিত্র? মিরপুরের পুলিশের উপস্থিতিতে ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একজন এমপির গুণ্ডামির ঘটনার পর আইনগত কী ভূমিকা নিয়েছেন মিরপুর থানার ওসি? বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এ ঘটনায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী দৃষ্টান্ত রেখেছেন?
বিএনপি-জামায়াতের কে কখন গাড়ি পুড়িয়েছেন, এসব নিয়ে যদি গবেষণা করে করে সত্য-মিথ্যা ব্যবস্থা নেওয়া যায়, প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে সরকারদলীয় একজন এমপির গুণ্ডামির প্রতিকারে তারা কী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে জবাবদিহিতো তাদেরকে করতেই হবে। টুডে অর টুমরো। যে কোনো স্থানে অথবা ফোরামে।
আজ ক্ষমতা আছে বলে একজন সাংবাদিকের ক্যামেরা অথবা বুম হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবেন? গায়ে হাত তুলবেন একজন সাংবাদিকের গায়ে? তাও একজন নারী সাংবাদিকের গায়ে? ক্ষমতাতো আমাদের অনেকের ছিলো! এখন কিভাবে রাস্তাঘাটে তাদের ঘোরাঘুরি করতে হয়, তা দেখে-শুনেও কি হুঁশ হয় না?
এখন একটু সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলি। দেশে কোনো দিন সাংবাদিকতায় পড়াশুনা করিনি অথবা করাও লাগেনি। হাতুড়ে ডাক্তারের মতো সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লেও মাশাল্লা কিন্তু বেশ ছিলাম! কিন্তু এদেশে সাংবাদিকতায় পড়তে এসে প্র্যাকটিক্যালি অনেক কিছু দেখে-শুনে সবার আগে যে আত্ম উপলদ্ধি হয় তাহলো দেশেতো সাংবাদিকতা করিনি, সাংবাদিকতার নামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেত নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি! দেশে সংবাদের সাবজেক্টের বেশিরভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত বলে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেনি বা তুলতে পারেনি। দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়াতে সাংবাদিক দেখলেই বা বেত দেখেই দৌড়ে পালিয়েছে। মিরপুরের ওই স্কুলে অভিভাবকদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছিল। এর জন্য সাংবাদিক যাতে না ঢুকতে পারেন, সেজন্য প্রহরা রাখা হয়েছিল গেটে! কিন্তু তারা যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে কিন্তু আমি বা আমরা জোর করে কোনো প্রাইভেট প্রেমিসে ঢুকতে পারি না। সেখানে কৌশল করে যদি অভিভাবকের বেশে ঢুকি তাহলে সেটিও রিপোর্টে স্বচ্ছতার জন্য ব্যাখ্যা করে বলতে হবে।
আরটিভি‘র সাংবাদিকরা অনুমতি নিয়ে স্কুল প্রেমিসের ভিতরে ঢোকার কথা বলেছেন। আবার আরেক ভাষ্যে আছে অনুমতি ছাড়া ঢোকার কথা বলে স্কুলের শিক্ষকসহ কিছু স্টাফ গুণ্ডার মতো আচরণ করে তাদের সেখান থেকে বের করে দিতে উদ্যত হন। তাদের কাজ-কর্মে যদি স্বচ্ছতা থাকতো তাহলে তারা তাদের স্কুলে আসা কোনো সাংবাদিক বা সাধারণ অতিথির সঙ্গেও এমন আচরণ করতেন না। কোনো ভদ্রলোক কী এমন করে?
এরপর সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত ও বের হয়ে আসার পথে এমপির দেখা পেয়ে আমি বা আমরা কী আগে এমপিকে বলেছি যে, আমরা এ সাবজেক্ট নিয়ে কথা বলবো?, না রাস্তায় পেয়েই ‘কথা বলেন, কথা বলেন’ বলে ক্যামেরা স্টার্ট করে দিয়েছি? দেশে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু তাই করি। তথ্য পাবার নির্ধারিত-সুনির্দিষ্ট সূত্রের অভাবের কারণে এ অভ্যাসটি আমাদের গড়ে উঠেছে।
এখন একজন এমপি যিনি সংশ্লিষ্ট স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। অন্যরাও এমন বলেন, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে যদি কথা বলতে না পারেন বা কথা বলার বিষয়ে প্রস্তুত না হন সেটিও কিন্তু রিপোর্টারকে বলতে পারেন। ধাক্কা দিয়ে ক্যামেরা ফেলে দিতে পারেন না। রিপোর্টারের গায়ে হাত তুলতে তো নয়ই।
এটা স্রেফ গুণ্ডামি হয়েছে, যা একজন এমপি করতে পারেন না। এখন একজন এমপি গুণ্ডামি করার পর আমি বা আমাদের কাজ কী? আমরাতো বিষয়টির বিস্তারিত আমাদের রিপোর্টে লিখবো, বা টিভি রিপোর্টিং’এ তা ফুটিয়ে তুলবো। কিন্তু আমি বা আমরাতো গুণ্ডামির মতো এর পালটা কিছু করতে পারি না। একজন যদি কথা বলতে না চায় বারবার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু তাকে বাধ্য করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট লোক যদি আমাকে বা আমাদের শাসায় বা শাসিয়েছে বলে মনে হয়, এটিওতো আমরা আমাদের রিপোর্টে ফুটিয়ে তুলতে পারি।
এর জন্য দেশের আইন আছে, আমি-আমরা আইনের দ্বারস্থ হতে পারি, কিন্তু আমি বা আমরাতো তাকে শাসাতে বা সে রকম কিছু করার চেষ্টা করতে পারি না। এতে রিপোর্টার হিসাবে আমার সীমালঙ্ঘন, একজন এমপির গুণ্ডামির বিরুদ্ধে আমার-আমাদের অভিযোগ দুর্বল হয়। আজকাল কিন্তু নানা ঘটনায় এমন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ভিডিও ক্লিপিংসে কিন্তু এমন সুস্পষ্ট বেশ কিছু সাউন্ড আছে সাংবাদিকতার নীতিমালায় কোনো অবস্থাতেই তা আমরা করতে বা এ ধরনের আচরণের সঙ্গে জড়িত-সম্পৃক্ত হতে পারি না।
সাংবাদিক নিখিল ভদ্রকে পঙ্গু করার ঘটনার প্রতিবাদ-নিন্দা করতে গিয়ে আম-জনতার মতো সাংবাদিকরাও প্রেসক্লাবের সামনে পাবলিকের গাড়ি ভেঙেছেন, প্রাইভেট প্রপার্টিতে আগুন দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আবেগ-সহানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, এসব কিন্তু সাংবাদিক হিসাবে আমরা করতে পারি না। দেশের অসহায় আম-জনতা পাবলিকের কিছু করণীয় নেই বলে এসব করে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা করে, কিন্তু আমাদেরতো মিডিয়া আছে।
আমাদের প্রতিবাদসহ যা কিছু তা আমরা আমাদের মিডিয়ার মাধ্যমে করতে পারি। রাস্তায় ভাঙ্গচুর-আগুন দিয়ে নয়। সারা বছর নিখিল ভদ্রের মতো অসংখ্য ঘটনা দেশে ঘটছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে-পঙ্গু হচ্ছে।
কাজেই আমরা আমাদের শক্তির যাতে হেলায় অপব্যবহার না করি। আমাদের প্রতি দেশবাসীর আস্থা-ভালোবাসার সম্মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। যেন ভুলে না যাই সীমা লঙ্ঘন করে আমরাও কিন্তু যা খুশি করার লাইসেন্সপ্রাপ্তও নই। কামাল মজুমদারের গুণ্ডামির ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের মিডিয়ার মুরব্বিরা এ ঘটনার শিকার আমাদের লাঞ্ছিতা বোন অপর্ণার পাশে দাঁড়াবেন, এ ঘটনা থেকে যা শিক্ষণীয় তা কাজে লাগাবেন আশা করছি।
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
No comments