যুগের বাণী-সত্যপ্রাণ কবীর চৌধুরী by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
মৃত্যুর আগের বছর এক সাক্ষাৎকারে আপনার জীবনদর্শন কী_প্রশ্নটির উত্তরে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেছিলেন, "যে পথ কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণে সাহায্য করে, সেই পথে সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে চলা। স্বদেশপ্রেম ও সাধারণ মানুষের জন্য অকৃত্রিম হৃদয়ে নিরন্তর সহানুভূতি জাগিয়ে রাখা। আর লালন ফকিরের গানের কথায় : 'সত্য বল, সুপথে চল' নীতিকে আঁকড়ে থাকা।" ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম দিন। তিনি ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির
উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি। কমিটির উদ্যোগে ২০১০ সালে তাঁর ৮৮তম জন্মদিবস পালন করা হয়। সে অনুষ্ঠানে তিনি লিখিত বক্তৃতায় বলেন, "আমি আর কত দিন বাঁচব, তা নিয়ে আমি ভাবি না। আমি কী পাইনি তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র সময় অপচয় করি না। হাতের কাছে, কোলের কাছে যা আছে_তা অনেক আছে। আমি দেশ-বিদেশের অনেক হৃদয় আলোকিত করা বই পড়েছি, দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছি, সাহিত্য ছাড়াও 'সংস্কৃতি পাঠ' ও 'দক্ষিণ এশিয়ার মৌলবাদের বিকাশ'-এর মতো বিষয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান করেছি। হ্যাঁ, জীবনের ৮৭ বছর পেরিয়ে পেছনে তাকিয়ে তেমন কোনো অতৃপ্তির বোধ বা খেদ দ্বারা আক্রান্ত হই না।...নিজের কথা বলতে হলে বলব, দেহ নানাদিক থেকে জরাক্রান্ত হলেও আমার মন এখনো সতেজ আছে, বাইবেলের ভাষায় : দ্য ফ্লেশ উইক, বাট দ্য স্পিরিট ইজ উইলিং।"
তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা আমার শুরু হয় নানা আলোচনা সভায় ও বৈঠকে। আমি কৌতূহলচিত্তে তাঁর স্বরূপকে খুঁজে সেটি পেয়েছি এবং যে কাজটিতে আকর হিসেবে ব্যবহার করেছি তাঁর অনূদিত কয়েকটি বিশ্বসাহিত্যের সেরা গ্রন্থ। কাজটি করার আগে কেন এই পদ্ধতি বেছে নিলাম তার কৈফিয়ত দিচ্ছি। মাধ্যমিক বিজ্ঞান শ্রেণীতে আমার পড়ার সময়ে ইংরেজি বিষয়ে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল 'নাইন মডার্ন প্লেজ' নামে একটি বই। বইটিতে সংকলিত নাটকগুলোর মধ্যে 'রাইডার্স টু দ্য সি' নামে এক অঙ্ক নাটকটি আমাকে বেদনাতুর মুগ্ধ করেছিল। কলেজে পড়া অর্ধশতাব্দীরও এক দশক আগের অন্য বইগুলো হারিয়ে গেছে; কিন্তু ওই বইটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। কবীর চৌধুরীর অনূদিত 'রূপান্তর নাটক' পড়তে গিয়ে দেখলাম, আমার ওই প্রিয় নাটকটি 'সাগরপানে ঘোড় সওয়ার' নামে সেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং দুজনের ভালোলাগার সাদৃশ্য দেখে ইতিপূর্বে উলি্লখিত পদ্ধতি বেছে নিলাম।
নাগিব মাহফুজ নোবেল বিজয়ী মিসরের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা একটি উপন্যাস 'সত্যে বসবাসকারী' নামে অনুবাদ করেছেন কবীর চৌধুরী। উৎসর্গ পাতায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি কন্যাকে আশীর্বাদ করেছেন সেটা তাঁর ব্যক্তিক আদর্শও বটে : 'সত্যের বন্ধন পরো, সে বন্ধন/প্রেম মন্ত্রবলে করো অলঙ্কার।' চিনুয়া আচেবে নাইজেরিয়ার একজন লেখক, যিনি আফ্রিকার সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রচারক। তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কবীর চৌধুরী অনুবাদ করেছেন 'সব কিছু ভেঙেচুরে যায়' অনূদিত শিরোনামে। অনুবাদ গ্রন্থটির উৎসর্গ পাতায় তিনি লিখেছেন : 'উনিশ শতকের শেষ দিকে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর নায়ক দুই ভাই সিধু ও কানুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে।' ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ পুরোপুরি চরমে পেঁৗছে, যাকে ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহের উত্তরসূরি বলা যায়। এখানে আমরা কবীর চৌধুরীর প্রগাঢ় ইতিহাসমনস্কতার পরিচয় পাই। স্বাধীনতা-সংগ্রামের কোনো নায়ককেই তিনি আমাদের ভুলতে দেননি।
"একজন দারোগা অন্যায়ভাবে কতিপয় সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করিয়া থানায় লইয়া যাইতেছিল। পথে বিদ্রোহীরা তাহাদিগকে আটক করিয়া তাহাদের নায়ক সিধু ও কানুর নিকট লইয়া যায়। দারোগা ক্রোধে চিৎকার করিয়া উঠিল, 'কে তুই সরকারি কাজে বাধা দিস!'
একজন বলিল, 'আমি কানু, এ আমার দেশ।'
দ্বিতীয়জন বলিল, 'আমি সিধু, এ আমার দেশ।' কানু চিৎকার করিয়া ঘোষণা দিল, 'হুল (বিদ্রোহ) আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। চারিদিকে শালের ডাল পাঠাইয়া দাও। এখন আর দারোগা নাই, হাকিম নাই, সরকার নাই। আমাদের রাজ আসিয়া গিয়াছে।" (আর ব্যাট্রিক, 'সান্তাল মিউটিনি', অনুবাদ সুপ্রকাশ রায়)
কবীর চৌধুরী বাঙালিদের, বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। কলকাতার দেশ পত্রিকায় তাঁর অনূদিত উপন্যাসগুলোর বিজ্ঞাপন তার সাক্ষ্য দেয়। বিদেশি লেখকদের লেখা বিশাল সমুদ্রভাণ্ডার থেকে তিনি দক্ষ ডুবুরির মতো নানা রঙের, নানা স্বাদের গ্রন্থ বেছে নিয়ে পরিবেশন করেছেন প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় মূল রচনার সঙ্গে পুরোপুরি মিল রেখে। তাঁর অনূদিত আঁদ্রে জিদের লেখা 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' পড়ার আগে কে জানত চলতি ধারার নয়, অন্য এক ধারার দিনপঞ্জি-উপন্যাসের কথা? আমার মতো বোধ করি অনেকেই। অনূদিত গ্রন্থটির ভূমিকায় কবীর চৌধুরী আমাদের পাঠ দিচ্ছেন : "আঁদ্রে জিদ উপন্যাসের প্রচলিত রীতিতে 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' রচনা করেননি। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র একজন যাজক দুটি নোট বইয়ে দিনপঞ্জির আকারে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। ঘটনার বিবরণ প্রদানের পাশাপাশি তিনি তাঁর মনের অবস্থা, চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং সংঘটিত ঘটনাগুলো যেসব ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দেয় তার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই নোটবুক দুটিই 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' উপন্যাস।"
কবীর চৌধুরীর বিরচণক্ষেত্র কেবল বিশ্বসাহিত্যই নয়, তার অন্তর্ভুক্ত বিশ্বচিত্রকলাও। তাঁর রচিত এ বিষয়ে কয়েকটির মধ্যে যেটা আমার সংগ্রহে আছে সেটা হচ্ছে 'গয়্যা'_স্পেনের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। গয়্যার আঁকা অনেক চিত্রের প্রতিলিপিসহ সে সময়কালের প্রেক্ষাপটে গয়্যার জীবনকথা লেখা কবীর চৌধুরীর আরেকটি অনবদ্য কীর্তি। বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় বিক্ষুব্ধ কবীর চৌধুরী তাই ক্যানভাসে আঁকা গয়্যার চিত্রকর্মের যে রঙিন প্রতিলিপি তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন, তার বিষয় হচ্ছে ১৮০৮ সালের ৩ মের হত্যাযজ্ঞ। কবীর চৌধুরী লিখেছেন, '১৮০৮ সালের ৩ মে দখলদার ফরাসি সেনাবাহিনী স্পেনে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে তা স্পেনের গণমানুষকে গণবিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয়। সমগ্র দেশে প্রতিরোধ আন্দোলন দানা বাঁধে এবং শুরু হয়ে যায় স্পেনকে শত্রুমুক্ত করার সংগ্রাম।' গয়্যা বইটির লেখা পড়ে ও ছবির প্রতিলিপিগুলো দেখে যে নান্দনিক অভিজ্ঞতা ঘটে তা শুধু অনুভবযোগ্যই, বর্ণনা করা যায় না।
এখানেই শেষ নয়। কবীর চৌধুরী একজন সমাজমনস্ক ব্যক্তিও বটে। নানা সামাজিক আন্দোলনের নেতা। মিসবাহউদ্দিন স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেন যা বাঙালি জাতির হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষাও বটে : 'কী রকম দেশ ও সমাজ চাই আমরা? আমরা এমন একটি সমাজ ও দেশ চাই, যা হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণমুক্ত ও বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্দীপ্ত। আমরা কিছুতেই তেমন সমাজ চাই না, যেখানে স্বৈরাচারী শাসকরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটভাবে বিরাজ করবে, অহিংস অথবা সহিংস মৌলবাদ শিকড় গেড়ে বসবে এবং যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনসহ সামগ্রিক জীবনাচরণে বাঙালিত্বের পরিবর্তে অন্য সংস্কৃতি প্রাধান্য পাবে।'
কবীর চৌধুরীর লেখা ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর সংখ্যা অনেক ও তার বিষয়বস্তুও বিচিত্র। তাঁর লেখা শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা ১৭, মৌলিক প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা বাংলায় ও ইংরেজিতে মিলিয়ে শতাধিক। কবীর চৌধুরী দীর্ঘায়ু ছিলেন। ৯০ বছরের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে চিরবিদায় নিয়েছেন। দীর্ঘ আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকা তেমন কিছু নয়, কিন্তু সগৌরবে কীর্তিমান থেকে, শুধু তাই-ই নয়, সেটা নিরবচ্ছিন্ন থেকে বেঁচে থাকা আমাদের দেশে বিরল ঘটনা এবং এখানেই তাঁর দীর্ঘায়ুর সার্থকতা। না, আমি ভুল বলছি। কবীর চৌধুরী চিরজীবী। তাঁর লেখা দেড় শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন, বংশপরম্পরায় বাঙালিদের প্রেরণা দেবেন, উৎসাহ দেবেন : আমরা মৌলবাদমুক্ত একটি সমাজ গড়ব।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা আমার শুরু হয় নানা আলোচনা সভায় ও বৈঠকে। আমি কৌতূহলচিত্তে তাঁর স্বরূপকে খুঁজে সেটি পেয়েছি এবং যে কাজটিতে আকর হিসেবে ব্যবহার করেছি তাঁর অনূদিত কয়েকটি বিশ্বসাহিত্যের সেরা গ্রন্থ। কাজটি করার আগে কেন এই পদ্ধতি বেছে নিলাম তার কৈফিয়ত দিচ্ছি। মাধ্যমিক বিজ্ঞান শ্রেণীতে আমার পড়ার সময়ে ইংরেজি বিষয়ে পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল 'নাইন মডার্ন প্লেজ' নামে একটি বই। বইটিতে সংকলিত নাটকগুলোর মধ্যে 'রাইডার্স টু দ্য সি' নামে এক অঙ্ক নাটকটি আমাকে বেদনাতুর মুগ্ধ করেছিল। কলেজে পড়া অর্ধশতাব্দীরও এক দশক আগের অন্য বইগুলো হারিয়ে গেছে; কিন্তু ওই বইটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। কবীর চৌধুরীর অনূদিত 'রূপান্তর নাটক' পড়তে গিয়ে দেখলাম, আমার ওই প্রিয় নাটকটি 'সাগরপানে ঘোড় সওয়ার' নামে সেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং দুজনের ভালোলাগার সাদৃশ্য দেখে ইতিপূর্বে উলি্লখিত পদ্ধতি বেছে নিলাম।
নাগিব মাহফুজ নোবেল বিজয়ী মিসরের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। তাঁর লেখা একটি উপন্যাস 'সত্যে বসবাসকারী' নামে অনুবাদ করেছেন কবীর চৌধুরী। উৎসর্গ পাতায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি কন্যাকে আশীর্বাদ করেছেন সেটা তাঁর ব্যক্তিক আদর্শও বটে : 'সত্যের বন্ধন পরো, সে বন্ধন/প্রেম মন্ত্রবলে করো অলঙ্কার।' চিনুয়া আচেবে নাইজেরিয়ার একজন লেখক, যিনি আফ্রিকার সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রচারক। তাঁর লেখা একটি উপন্যাস কবীর চৌধুরী অনুবাদ করেছেন 'সব কিছু ভেঙেচুরে যায়' অনূদিত শিরোনামে। অনুবাদ গ্রন্থটির উৎসর্গ পাতায় তিনি লিখেছেন : 'উনিশ শতকের শেষ দিকে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর নায়ক দুই ভাই সিধু ও কানুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে।' ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ পুরোপুরি চরমে পেঁৗছে, যাকে ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহের উত্তরসূরি বলা যায়। এখানে আমরা কবীর চৌধুরীর প্রগাঢ় ইতিহাসমনস্কতার পরিচয় পাই। স্বাধীনতা-সংগ্রামের কোনো নায়ককেই তিনি আমাদের ভুলতে দেননি।
"একজন দারোগা অন্যায়ভাবে কতিপয় সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করিয়া থানায় লইয়া যাইতেছিল। পথে বিদ্রোহীরা তাহাদিগকে আটক করিয়া তাহাদের নায়ক সিধু ও কানুর নিকট লইয়া যায়। দারোগা ক্রোধে চিৎকার করিয়া উঠিল, 'কে তুই সরকারি কাজে বাধা দিস!'
একজন বলিল, 'আমি কানু, এ আমার দেশ।'
দ্বিতীয়জন বলিল, 'আমি সিধু, এ আমার দেশ।' কানু চিৎকার করিয়া ঘোষণা দিল, 'হুল (বিদ্রোহ) আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। চারিদিকে শালের ডাল পাঠাইয়া দাও। এখন আর দারোগা নাই, হাকিম নাই, সরকার নাই। আমাদের রাজ আসিয়া গিয়াছে।" (আর ব্যাট্রিক, 'সান্তাল মিউটিনি', অনুবাদ সুপ্রকাশ রায়)
কবীর চৌধুরী বাঙালিদের, বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। কলকাতার দেশ পত্রিকায় তাঁর অনূদিত উপন্যাসগুলোর বিজ্ঞাপন তার সাক্ষ্য দেয়। বিদেশি লেখকদের লেখা বিশাল সমুদ্রভাণ্ডার থেকে তিনি দক্ষ ডুবুরির মতো নানা রঙের, নানা স্বাদের গ্রন্থ বেছে নিয়ে পরিবেশন করেছেন প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় মূল রচনার সঙ্গে পুরোপুরি মিল রেখে। তাঁর অনূদিত আঁদ্রে জিদের লেখা 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' পড়ার আগে কে জানত চলতি ধারার নয়, অন্য এক ধারার দিনপঞ্জি-উপন্যাসের কথা? আমার মতো বোধ করি অনেকেই। অনূদিত গ্রন্থটির ভূমিকায় কবীর চৌধুরী আমাদের পাঠ দিচ্ছেন : "আঁদ্রে জিদ উপন্যাসের প্রচলিত রীতিতে 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' রচনা করেননি। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র একজন যাজক দুটি নোট বইয়ে দিনপঞ্জির আকারে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। ঘটনার বিবরণ প্রদানের পাশাপাশি তিনি তাঁর মনের অবস্থা, চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং সংঘটিত ঘটনাগুলো যেসব ঘাত-প্রতিঘাতের জন্ম দেয় তার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই নোটবুক দুটিই 'পাস্টোরাল সিম্ফনি' উপন্যাস।"
কবীর চৌধুরীর বিরচণক্ষেত্র কেবল বিশ্বসাহিত্যই নয়, তার অন্তর্ভুক্ত বিশ্বচিত্রকলাও। তাঁর রচিত এ বিষয়ে কয়েকটির মধ্যে যেটা আমার সংগ্রহে আছে সেটা হচ্ছে 'গয়্যা'_স্পেনের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। গয়্যার আঁকা অনেক চিত্রের প্রতিলিপিসহ সে সময়কালের প্রেক্ষাপটে গয়্যার জীবনকথা লেখা কবীর চৌধুরীর আরেকটি অনবদ্য কীর্তি। বাংলাদেশে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার বাহিনীর গণহত্যায় বিক্ষুব্ধ কবীর চৌধুরী তাই ক্যানভাসে আঁকা গয়্যার চিত্রকর্মের যে রঙিন প্রতিলিপি তাঁর গ্রন্থে দিয়েছেন, তার বিষয় হচ্ছে ১৮০৮ সালের ৩ মের হত্যাযজ্ঞ। কবীর চৌধুরী লিখেছেন, '১৮০৮ সালের ৩ মে দখলদার ফরাসি সেনাবাহিনী স্পেনে যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে তা স্পেনের গণমানুষকে গণবিদ্রোহের দিকে ঠেলে দেয়। সমগ্র দেশে প্রতিরোধ আন্দোলন দানা বাঁধে এবং শুরু হয়ে যায় স্পেনকে শত্রুমুক্ত করার সংগ্রাম।' গয়্যা বইটির লেখা পড়ে ও ছবির প্রতিলিপিগুলো দেখে যে নান্দনিক অভিজ্ঞতা ঘটে তা শুধু অনুভবযোগ্যই, বর্ণনা করা যায় না।
এখানেই শেষ নয়। কবীর চৌধুরী একজন সমাজমনস্ক ব্যক্তিও বটে। নানা সামাজিক আন্দোলনের নেতা। মিসবাহউদ্দিন স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেন যা বাঙালি জাতির হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষাও বটে : 'কী রকম দেশ ও সমাজ চাই আমরা? আমরা এমন একটি সমাজ ও দেশ চাই, যা হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণমুক্ত ও বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্দীপ্ত। আমরা কিছুতেই তেমন সমাজ চাই না, যেখানে স্বৈরাচারী শাসকরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটভাবে বিরাজ করবে, অহিংস অথবা সহিংস মৌলবাদ শিকড় গেড়ে বসবে এবং যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনসহ সামগ্রিক জীবনাচরণে বাঙালিত্বের পরিবর্তে অন্য সংস্কৃতি প্রাধান্য পাবে।'
কবীর চৌধুরীর লেখা ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর সংখ্যা অনেক ও তার বিষয়বস্তুও বিচিত্র। তাঁর লেখা শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা ১৭, মৌলিক প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক এবং অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা বাংলায় ও ইংরেজিতে মিলিয়ে শতাধিক। কবীর চৌধুরী দীর্ঘায়ু ছিলেন। ৯০ বছরের দ্বারপ্রান্তে পেঁৗছে চিরবিদায় নিয়েছেন। দীর্ঘ আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকা তেমন কিছু নয়, কিন্তু সগৌরবে কীর্তিমান থেকে, শুধু তাই-ই নয়, সেটা নিরবচ্ছিন্ন থেকে বেঁচে থাকা আমাদের দেশে বিরল ঘটনা এবং এখানেই তাঁর দীর্ঘায়ুর সার্থকতা। না, আমি ভুল বলছি। কবীর চৌধুরী চিরজীবী। তাঁর লেখা দেড় শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন, বংশপরম্পরায় বাঙালিদের প্রেরণা দেবেন, উৎসাহ দেবেন : আমরা মৌলবাদমুক্ত একটি সমাজ গড়ব।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট
No comments