রাষ্ট্রপতির সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ-কণ্ঠস্বর by রাহাত খান
রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন সংলাপে বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি একজন মান্যবর ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে ইসি গঠন বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনো মীমাংসা দেওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার তার নেই। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে যে কোনো মীমাংসার জন্য বিএনপিসহ সংক্ষুব্ধ দলগুলোকে সংসদেই যেতে হবে। নতুন করে আলোচনা ও মীমাংসা সূত্র বের করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে
মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান কর্তৃক আহূত ইসি সংলাপে যোগ দিয়ে আরও দুটি ক্ষুদ্র দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গত ২ জানুয়ারি তাদের আলাদা প্রস্তাবে জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছে। এর আগের দিন সংলাপে বসে বর্ষীয়ান আইনজীবী ও রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে।
ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যটি উল্লেখ ও পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি তো শুধু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী নন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। আইন পেশা থেকে বঙ্গবন্ধুই তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। শ্বশুরবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে। ১৯৭১ সালে বাঙালির সেই জান-তোলপাড় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দেশে বা বিদেশে টুঁ শব্দটিও করেননি। করেছেন এমন কোনো প্রমাণ কোথাও নেই।
এরপরও যৌথ বাহিনীর হাতে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়, আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ এবং দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বিশ্ব জনমতের চাপে দুঃসহ কারাবাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার, তখন সৌজন্যবশে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের কাছে বন্ধুত্বসুলভ কোনো উপহার আশা করেন কিনা। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক জবাব ছিল : আমার কামালকে (ড. কামাল হোসেন) আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যেতে দিন।
বঙ্গবন্ধুর সেই স্নেহধন্য কামাল হোসেন লন্ডন ও দিলি্ল হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) একই প্লেনে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। আইনজীবী ও কূটনীতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক ছিলেন না ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বৃত হন।
তারপর রাজনীতিতে বহু রহস্যজনক এবং কোনোদিনই জবাব না পাওয়া বহু ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস ঘটনার ঠিক আগে আগে হঠাৎ উচ্চ পর্যায়ের একটি স্কলারশিপ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন কেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন সে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং রাজনীতিতে তাকে সংস্থিত করার ব্যাপারে ড. কামাল হোসেনের একটা ইতিবাচক সক্রিয় ভূমিকা ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই, সে সময় আওয়ামী লীগের একজন গর্ব করার মতো নেতা তিনি ছিলেন। কিন্তু তারপর কী ঘটল? কী ঘটেছিল? এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন সাফল্যের তুঙ্গে, হঠাৎ আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য 'আমার কামাল', রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন।
বিষয়টি সে সময়ে আমাকে এবং দেশের দল নির্বিশেষে বহু লোককে বিচলিত করেছিল। দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। সেই দুঃখের কথা জানিয়েও ছিলাম জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত এবং মনের দিক দিয়ে একটুও ভেঙে না পড়া আওয়ামী লীগ নেত্রী, বর্তমানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর তাৎক্ষণিক জবাবও আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনটি ফটোগ্রাফ দেখানো হয় আমাকে। একটি ফটোগ্রাফে দেখা যায়, কামাল হোসেন ও ঢাকায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূতকে নিচু টেবিলে খুব কাছাকাছি মুখোমুখি বসে কথা বলতে। দ্বিতীয় ছবিতে খুবই কাছাকাছি এবং মুখোমুখি বসা অবস্থায় দেখা যায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তখনও আওয়ামী লীগের খুবই প্রভাবশালী নেতা ড. কামাল হোসেনকে। তৃতীয় ফটোগ্রাফটি খুব কাছাকাছি গোল হয়ে বসে আলাপরত অবস্থায় দেখা যায় ঢাকার তদানীন্তন পাকিস্তানি হাইকমিশনার, ড. কামাল হোসেন ও খালেদা জিয়াকে। একই রকম নিচু টেবিলে। একই পোশাকে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে হয় : কি কথা তার সাথে? তাহার সাথে! তবে জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গের ইতি টেনে বলি, আওয়ামী লীগ থেকে ড. কামাল হোসেনের বহিষ্কারের জবাব আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। পলাশী যুদ্ধের আগে মেহেরপুরের নীলকুঠিতে নদীপথে বিশেষ বজরায় করে ঘসেটি বেগম, জগৎ সিং, রাজবল্লভ প্রমুখ লোকজন আসতেন রবার্ট ক্লাইভ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে দেখা করতে। এ ঘসেটি বেগমরা নিশ্চয় মেহেরপুর নীলকুঠিতে শুধু সুস্বাদু আম খেতে যেতেন না!
তবু এই আইনজীবী ও পার্টটাইম রাজনীতিকের নাম ড. কামাল হোসেন। এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক নন। খ্যাতির শীর্ষে ওঠা একজন আইনজীবী তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকও বটে। অত্যন্ত সম্মানিত। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। গত ১ জানুয়ারি সংলাপে বসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন তিনি। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি শুধু বিএনপির নয়, গোটা জাতির। গোটা জাতি বলতে ড. কামাল হোসেন কী বোঝাতে চান, তা তিনিই জানেন।
সত্য বটে, বিএনপি ছাড়াও কয়েকটি ছোট দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসে কিংবা বসার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে। বড় দলের মধ্যে বিএনপি তো আছেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও কোনো কোনো অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি করেন। আবার বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিলে এমন অবস্থায় এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখেন। বলেনও তিনি এসব কথা জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়। মহাজোটের প্রধান শরিক তারই নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। তিনি রাজনীতিতে সুবিধাবাদী হিসেবে নিজের স্থান এতদিনে পাকা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার প্রশ্নে তাই তার 'হ্যাঁ' বা 'না' আমার বিবেচনায় খুব একটা 'ওয়েট' বা রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না। একদিকে তার চোখ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া, অন্যদিকে প্রত্যাশা ও সান্ত্বনা বিএনপি নির্বাচনে না গেলে নির্বাচনে 'উল্লেখযোগ্য' আসনে জিতে কমপক্ষে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে পারা। এরশাদ সাহেব আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এককালে বিএনপির কায়দায় বিএনপিকে সরিয়ে ক্ষমতায় গেছেন বলে এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর তিনি ঘোর বিরোধী জেনে তাকে তার ক্ষমতারোহণকে সমর্থন করতাম। তিনি এবং তার স্ত্রী, সাবেক ফার্স্ট লেডি বেগম রওশন এরশাদেরও স্নেহধন্য ছিলাম। তবে রাজনীতিতে আমার যা দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতির যা বিশ্লেষণ সেটা তারই অংশ। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো সম্পর্ক নেই।
তারপর অবশ্য আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এরশাদ সাহেবের অবস্থানের মূল্য দিতে চাই। মূল্য দিতে চাই মহাজোটের অপর দুই অংশীদার বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের (ইনু) ভূমিকার। এই দুই দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আরও দুই টার্ম রাখার পক্ষে। এই দুই পার্টি সমাজবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। প্রায়োগিক ব্যর্থতা, ব্যুরোক্রেসি এবং আমিত্ব বিসর্জনহেতু বিশ্বে সমাজবাদী রাষ্ট্র বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। উত্তর কোরিয়ায় যে সমাজবাদ, সেটা আসলে কিম-ডাইনেস্টির একনায়কতন্ত্র। কিউবায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাস্ত্রো রাজবংশ। সমাজবাদ তাই এখন রাষ্ট্রবিহীন। বিশ্বের বহু ইতিবাচক ও মহান সংস্কারের কৃতিত্ব সমাজবাদের রয়েছে। পুঁজিবাদকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স পদ্ধতিতে সহনীয় স্তরে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিল সাম্যবাদ। এখন রাষ্ট্রবিহীন সমাজবাদ কিছু সুবিধাবাদী লোকের বাহনে পরিণত হয়েছে। সংগঠন বলতে এদের কিছু প্রায় নেই। তবে 'বিপ্লবী' কথাবার্তা বলে এরা এখনও কোথাও কোথাও কল্কে পায়। এই সুবাদে এরা ক্ষমতাসীনদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতার মজাও লোটে আবার বিরোধী দলের দাবির সঙ্গে সুবিধামতো একাত্মবোধের ঘোষণা দিয়ে প্রশংসার ভাগীদারও হয়। বিএনপি সরকারের আমলে চরম বাম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সোভিয়েতপন্থি বামেরা এই ভূমিকায় কমবেশি ন্যস্ত। খুবই 'আদর্শবান' বটে তারা_ ওপরেরটা খায়, তলেরটাও কুড়ায়।
একটু তেতো মনে হতে পারে আমার কথাগুলো। তবে অতীত ও বিদ্যমান রাজনীতির নিরিখে আমাদের দেশে কথাগুলোর সত্যতা অস্বীকার করার কি উপায় আছে!
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অর্থাৎ আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। হ্যাঁ, সত্য বটে, বেশ কিছু বড়-ছোট রাজনৈতিক দল ও কিছুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় পত্রিকা তাদের এই দাবি ক্রমাগত ভাষা দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একাংশ তো এই দাবির প্রশ্নে রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি আক্রমণাত্মক, সোচ্চার। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসমসাহসী বীরত্বের জন্য ইতিমধ্যে যিনি লিজেন্ড বা প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, রাজনীতিতে ঢুকে অসহিষ্ণুতা এবং দখল মনোবৃত্তির জন্য যার রাজনীতিতে একটি জীর্ণ গামছা ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছু নেই। সেই আমার ভ্রাতৃতুল্য কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অলি আহমদ বীরবিক্রম, যিনি ২০০৮ সালে বিএনপি ত্যাগ করার সময় তার 'মেন্টর' মেজর (পরে লে. জেনারেল) জিয়াকে 'মেজর রিট্রিট' বলে কটূক্তি করেছিলেন, প্রায়ই যিনি অমুক মাসে বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে বলে রাজনৈতিক জ্যোতিষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, চট্টগ্রামের সেই এমপি/বীরবিক্রমও আজকাল জোরালোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি তুলছেন। এ ছাড়াও দাবির পক্ষে আছেন সাত খুনের আসামি থেকে জিয়াউর রহমানের অনৈতিক বদান্যতায় রাজনীতি করতে পারা লোক, শ্বশুরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা ছদ্মবেশী মুফতি, এমন আরও অনেকে।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি যারা করছেন, তাদের কোনোরূপ কটাক্ষ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বিএনপি, সুশীল সমাজের একাংশ এবং প্রচারমাধ্যমের একাংশ যদি যথাসময় তাদের যথাযথ কর্তব্য সমাধা করতে পারতেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ সরকার আলোচ্য প্রশ্নে যথেষ্টই নমনীয় ও আগ্রহী ছিল, গ্রহণযোগ্য একটা মীমাংসা হয়ে যেতে পারত। আওয়ামী লীগ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছে। রায়ে 'ইচ্ছা করলে দুই টার্ম (তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি) বহাল রাখা যেতে পারে' কথাটা ছিল। ছিল বলে আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে বহু কাকুতি-মিনতি করেছে সংসদে যেতে। গিয়ে বিএনপির বক্তব্য সংসদে পেশ করতে। সংশোধনী বা নিজেদের বিকল্প প্রস্তাব দিতে। এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিএনপির পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিএনপিকে বারবার সংসদে যেতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপির বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
বিএনপি সংসদে যায়নি। তারা ক্ষমতায় না থাকলে যেন সংসদের এক পয়সার দাম নেই। তারা সংসদে গিয়ে নয়, হোটেল রূপসী বাংলায় গিয়ে বাজেট পেশ করেন। রাস্তায় নেমে সরকার পতনের ডাক দেন। সরকার ব্যর্থ বলে গলাবাজি করেন। এটা কি সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অসাংবিধানিক একটা আচরণ ছিল না? বিএনপি সংসদে গেলে যা ঘটত, তা তো দেশের মানুষই প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। তারাই বলতে পারতেন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সম্পর্কে কাদের যুক্তি সঠিক বা কারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেশিশক্তি দেখিয়ে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন কিনা। কিন্তু শত কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও বিএনপি তো সংসদেই গেল না।
গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল, উভয়েরই। শুধু আসন রক্ষার জন্য সংসদে কয়েক মিনিটের জন্য যাওয়ার নাম গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। এটা হলো জনগণের সঙ্গে নির্মম-নিষ্ঠুর ঠাট্টা করার শামিল। চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেওয়া।
ভাবতে ইচ্ছা করে কামাল হোসেন সাহেবরা, এক শ্রেণীর সুশীল সমাজ এবং প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ঈপ্সিত মাত্রায় কাজ না করার জন্য বিএনপিকে দায়ী বলে কখনও ভাবেন না কেন? এটা চিন্তার দীনতা এবং আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটা ভিত্তিহীন ক্ষোভ ও আক্রোশ ছাড়া আর কিছু নয়। গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল উভয়কে দায়িত্বজ্ঞানের সর্বোচ্চ মাত্রা নিয়ে কাজ করতে হবে।
বিএনপি গত তিন বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কিছুই জাতিকে 'উপহার' দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমি মনে করি, সংসদে গিয়ে এখনও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন সংলাপে বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি একজন মান্যবর ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে ইসি গঠন বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনো মীমাংসা দেওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার তার নেই। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে যে কোনো মীমাংসার জন্য বিএনপিসহ সংক্ষুব্ধ দলগুলোকে সংসদেই যেতে হবে। নতুন করে আলোচনা ও মীমাংসা সূত্র বের করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে। দ্বিতীয় কোনো পন্থার কথা আমার জানা নেই।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যটি উল্লেখ ও পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি তো শুধু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী নন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। আইন পেশা থেকে বঙ্গবন্ধুই তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। শ্বশুরবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে। ১৯৭১ সালে বাঙালির সেই জান-তোলপাড় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে দেশে বা বিদেশে টুঁ শব্দটিও করেননি। করেছেন এমন কোনো প্রমাণ কোথাও নেই।
এরপরও যৌথ বাহিনীর হাতে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়, আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ এবং দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বিশ্ব জনমতের চাপে দুঃসহ কারাবাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার, তখন সৌজন্যবশে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের কাছে বন্ধুত্বসুলভ কোনো উপহার আশা করেন কিনা। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক জবাব ছিল : আমার কামালকে (ড. কামাল হোসেন) আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যেতে দিন।
বঙ্গবন্ধুর সেই স্নেহধন্য কামাল হোসেন লন্ডন ও দিলি্ল হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) একই প্লেনে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। আইনজীবী ও কূটনীতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোক ছিলেন না ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বৃত হন।
তারপর রাজনীতিতে বহু রহস্যজনক এবং কোনোদিনই জবাব না পাওয়া বহু ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস ঘটনার ঠিক আগে আগে হঠাৎ উচ্চ পর্যায়ের একটি স্কলারশিপ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন কেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন সে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। ১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং রাজনীতিতে তাকে সংস্থিত করার ব্যাপারে ড. কামাল হোসেনের একটা ইতিবাচক সক্রিয় ভূমিকা ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই, সে সময় আওয়ামী লীগের একজন গর্ব করার মতো নেতা তিনি ছিলেন। কিন্তু তারপর কী ঘটল? কী ঘটেছিল? এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন সাফল্যের তুঙ্গে, হঠাৎ আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য 'আমার কামাল', রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন।
বিষয়টি সে সময়ে আমাকে এবং দেশের দল নির্বিশেষে বহু লোককে বিচলিত করেছিল। দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। সেই দুঃখের কথা জানিয়েও ছিলাম জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত এবং মনের দিক দিয়ে একটুও ভেঙে না পড়া আওয়ামী লীগ নেত্রী, বর্তমানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এর তাৎক্ষণিক জবাবও আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনটি ফটোগ্রাফ দেখানো হয় আমাকে। একটি ফটোগ্রাফে দেখা যায়, কামাল হোসেন ও ঢাকায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রদূতকে নিচু টেবিলে খুব কাছাকাছি মুখোমুখি বসে কথা বলতে। দ্বিতীয় ছবিতে খুবই কাছাকাছি এবং মুখোমুখি বসা অবস্থায় দেখা যায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তখনও আওয়ামী লীগের খুবই প্রভাবশালী নেতা ড. কামাল হোসেনকে। তৃতীয় ফটোগ্রাফটি খুব কাছাকাছি গোল হয়ে বসে আলাপরত অবস্থায় দেখা যায় ঢাকার তদানীন্তন পাকিস্তানি হাইকমিশনার, ড. কামাল হোসেন ও খালেদা জিয়াকে। একই রকম নিচু টেবিলে। একই পোশাকে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষায় বলতে হয় : কি কথা তার সাথে? তাহার সাথে! তবে জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গের ইতি টেনে বলি, আওয়ামী লীগ থেকে ড. কামাল হোসেনের বহিষ্কারের জবাব আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। পলাশী যুদ্ধের আগে মেহেরপুরের নীলকুঠিতে নদীপথে বিশেষ বজরায় করে ঘসেটি বেগম, জগৎ সিং, রাজবল্লভ প্রমুখ লোকজন আসতেন রবার্ট ক্লাইভ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে দেখা করতে। এ ঘসেটি বেগমরা নিশ্চয় মেহেরপুর নীলকুঠিতে শুধু সুস্বাদু আম খেতে যেতেন না!
তবু এই আইনজীবী ও পার্টটাইম রাজনীতিকের নাম ড. কামাল হোসেন। এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক নন। খ্যাতির শীর্ষে ওঠা একজন আইনজীবী তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকও বটে। অত্যন্ত সম্মানিত। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। গত ১ জানুয়ারি সংলাপে বসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন তিনি। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি শুধু বিএনপির নয়, গোটা জাতির। গোটা জাতি বলতে ড. কামাল হোসেন কী বোঝাতে চান, তা তিনিই জানেন।
সত্য বটে, বিএনপি ছাড়াও কয়েকটি ছোট দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসে কিংবা বসার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে। বড় দলের মধ্যে বিএনপি তো আছেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও কোনো কোনো অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি করেন। আবার বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে অংশ না নিলে এমন অবস্থায় এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখেন। বলেনও তিনি এসব কথা জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়। মহাজোটের প্রধান শরিক তারই নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। তিনি রাজনীতিতে সুবিধাবাদী হিসেবে নিজের স্থান এতদিনে পাকা করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার প্রশ্নে তাই তার 'হ্যাঁ' বা 'না' আমার বিবেচনায় খুব একটা 'ওয়েট' বা রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না। একদিকে তার চোখ বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়া, অন্যদিকে প্রত্যাশা ও সান্ত্বনা বিএনপি নির্বাচনে না গেলে নির্বাচনে 'উল্লেখযোগ্য' আসনে জিতে কমপক্ষে সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে পারা। এরশাদ সাহেব আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এককালে বিএনপির কায়দায় বিএনপিকে সরিয়ে ক্ষমতায় গেছেন বলে এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর তিনি ঘোর বিরোধী জেনে তাকে তার ক্ষমতারোহণকে সমর্থন করতাম। তিনি এবং তার স্ত্রী, সাবেক ফার্স্ট লেডি বেগম রওশন এরশাদেরও স্নেহধন্য ছিলাম। তবে রাজনীতিতে আমার যা দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনীতির যা বিশ্লেষণ সেটা তারই অংশ। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো সম্পর্ক নেই।
তারপর অবশ্য আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে এরশাদ সাহেবের অবস্থানের মূল্য দিতে চাই। মূল্য দিতে চাই মহাজোটের অপর দুই অংশীদার বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের (ইনু) ভূমিকার। এই দুই দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আরও দুই টার্ম রাখার পক্ষে। এই দুই পার্টি সমাজবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। প্রায়োগিক ব্যর্থতা, ব্যুরোক্রেসি এবং আমিত্ব বিসর্জনহেতু বিশ্বে সমাজবাদী রাষ্ট্র বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। উত্তর কোরিয়ায় যে সমাজবাদ, সেটা আসলে কিম-ডাইনেস্টির একনায়কতন্ত্র। কিউবায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাস্ত্রো রাজবংশ। সমাজবাদ তাই এখন রাষ্ট্রবিহীন। বিশ্বের বহু ইতিবাচক ও মহান সংস্কারের কৃতিত্ব সমাজবাদের রয়েছে। পুঁজিবাদকে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স পদ্ধতিতে সহনীয় স্তরে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছিল সাম্যবাদ। এখন রাষ্ট্রবিহীন সমাজবাদ কিছু সুবিধাবাদী লোকের বাহনে পরিণত হয়েছে। সংগঠন বলতে এদের কিছু প্রায় নেই। তবে 'বিপ্লবী' কথাবার্তা বলে এরা এখনও কোথাও কোথাও কল্কে পায়। এই সুবাদে এরা ক্ষমতাসীনদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতার মজাও লোটে আবার বিরোধী দলের দাবির সঙ্গে সুবিধামতো একাত্মবোধের ঘোষণা দিয়ে প্রশংসার ভাগীদারও হয়। বিএনপি সরকারের আমলে চরম বাম এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সোভিয়েতপন্থি বামেরা এই ভূমিকায় কমবেশি ন্যস্ত। খুবই 'আদর্শবান' বটে তারা_ ওপরেরটা খায়, তলেরটাও কুড়ায়।
একটু তেতো মনে হতে পারে আমার কথাগুলো। তবে অতীত ও বিদ্যমান রাজনীতির নিরিখে আমাদের দেশে কথাগুলোর সত্যতা অস্বীকার করার কি উপায় আছে!
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অর্থাৎ আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। হ্যাঁ, সত্য বটে, বেশ কিছু বড়-ছোট রাজনৈতিক দল ও কিছুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় পত্রিকা তাদের এই দাবি ক্রমাগত ভাষা দিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একাংশ তো এই দাবির প্রশ্নে রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি আক্রমণাত্মক, সোচ্চার। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসমসাহসী বীরত্বের জন্য ইতিমধ্যে যিনি লিজেন্ড বা প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, রাজনীতিতে ঢুকে অসহিষ্ণুতা এবং দখল মনোবৃত্তির জন্য যার রাজনীতিতে একটি জীর্ণ গামছা ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছু নেই। সেই আমার ভ্রাতৃতুল্য কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অলি আহমদ বীরবিক্রম, যিনি ২০০৮ সালে বিএনপি ত্যাগ করার সময় তার 'মেন্টর' মেজর (পরে লে. জেনারেল) জিয়াকে 'মেজর রিট্রিট' বলে কটূক্তি করেছিলেন, প্রায়ই যিনি অমুক মাসে বর্তমান সরকারের পতন ঘটবে বলে রাজনৈতিক জ্যোতিষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, চট্টগ্রামের সেই এমপি/বীরবিক্রমও আজকাল জোরালোভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি তুলছেন। এ ছাড়াও দাবির পক্ষে আছেন সাত খুনের আসামি থেকে জিয়াউর রহমানের অনৈতিক বদান্যতায় রাজনীতি করতে পারা লোক, শ্বশুরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা ছদ্মবেশী মুফতি, এমন আরও অনেকে।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবি যারা করছেন, তাদের কোনোরূপ কটাক্ষ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বিএনপি, সুশীল সমাজের একাংশ এবং প্রচারমাধ্যমের একাংশ যদি যথাসময় তাদের যথাযথ কর্তব্য সমাধা করতে পারতেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ সরকার আলোচ্য প্রশ্নে যথেষ্টই নমনীয় ও আগ্রহী ছিল, গ্রহণযোগ্য একটা মীমাংসা হয়ে যেতে পারত। আওয়ামী লীগ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছে। রায়ে 'ইচ্ছা করলে দুই টার্ম (তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি) বহাল রাখা যেতে পারে' কথাটা ছিল। ছিল বলে আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে বহু কাকুতি-মিনতি করেছে সংসদে যেতে। গিয়ে বিএনপির বক্তব্য সংসদে পেশ করতে। সংশোধনী বা নিজেদের বিকল্প প্রস্তাব দিতে। এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিএনপির পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিএনপিকে বারবার সংসদে যেতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপির বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
বিএনপি সংসদে যায়নি। তারা ক্ষমতায় না থাকলে যেন সংসদের এক পয়সার দাম নেই। তারা সংসদে গিয়ে নয়, হোটেল রূপসী বাংলায় গিয়ে বাজেট পেশ করেন। রাস্তায় নেমে সরকার পতনের ডাক দেন। সরকার ব্যর্থ বলে গলাবাজি করেন। এটা কি সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অসাংবিধানিক একটা আচরণ ছিল না? বিএনপি সংসদে গেলে যা ঘটত, তা তো দেশের মানুষই প্রত্যক্ষ করতে পারতেন। তারাই বলতে পারতেন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সম্পর্কে কাদের যুক্তি সঠিক বা কারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পেশিশক্তি দেখিয়ে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন কিনা। কিন্তু শত কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও বিএনপি তো সংসদেই গেল না।
গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল, উভয়েরই। শুধু আসন রক্ষার জন্য সংসদে কয়েক মিনিটের জন্য যাওয়ার নাম গণতান্ত্রিক আচরণ নয়। এটা হলো জনগণের সঙ্গে নির্মম-নিষ্ঠুর ঠাট্টা করার শামিল। চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেওয়া।
ভাবতে ইচ্ছা করে কামাল হোসেন সাহেবরা, এক শ্রেণীর সুশীল সমাজ এবং প্রচারমাধ্যম বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ঈপ্সিত মাত্রায় কাজ না করার জন্য বিএনপিকে দায়ী বলে কখনও ভাবেন না কেন? এটা চিন্তার দীনতা এবং আওয়ামী লীগের বিপক্ষে একটা ভিত্তিহীন ক্ষোভ ও আক্রোশ ছাড়া আর কিছু নয়। গণতন্ত্রের জন্য ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল উভয়কে দায়িত্বজ্ঞানের সর্বোচ্চ মাত্রা নিয়ে কাজ করতে হবে।
বিএনপি গত তিন বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ছাড়া আর কিছুই জাতিকে 'উপহার' দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আমি মনে করি, সংসদে গিয়ে এখনও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন সংলাপে বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি একজন মান্যবর ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তবে ইসি গঠন বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনো মীমাংসা দেওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার তার নেই। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে যে কোনো মীমাংসার জন্য বিএনপিসহ সংক্ষুব্ধ দলগুলোকে সংসদেই যেতে হবে। নতুন করে আলোচনা ও মীমাংসা সূত্র বের করা যায় কিনা সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে। দ্বিতীয় কোনো পন্থার কথা আমার জানা নেই।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments