অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচকের প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী by জাকির হোসেন

ডিসেম্বর সবে শেষ হলো। অর্থনীতির কোনো সূচকের ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য এখনও তৈরি হয়নি। বর্তমানের প্রায় সব পরিসংখ্যান তাই অক্টোবর ও নভেম্বরভিত্তিক। হালনাগাদ তথ্যের সঙ্গে গত বছরের একই সময়ের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক এখন নিম্নগামী। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছরের মধ্যে সম্প্রতি অর্থনীতিতে চাপ ও অস্বস্তি আগের তুলনায় বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ নানা পর্যায় থেকে বলা


হচ্ছে, অর্থনীতির বর্তমান যে গতিধারা তা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও সম্প্রতি ওই হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেছেন।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে রফতানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আয় বেড়েছিল ২৫ শতাংশ। গত
অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ১১২ কোটি মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল; চলতি অর্থবছরের একই সময়কালে
৩৭ কোটি ডলারের ঘাটতি হয়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির পাশাপাশি কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ২০১০ সালের নভেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গেল নভেম্বরে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে বেড়েছে ৮ শতাংশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ভালো। তবে নভেম্বরে একক মাস হিসেবে রেমিট্যান্স কমেছে ৯ শতাংশ। কৃষিঋণ বিতরণ সাধারণত কমতে দেখা যায় না; কিন্তু এবার জুলাই-নভেম্বর সময়কালে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। শিল্পের মেয়াদি ঋণ বিতরণ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসিতেও নিম্নমুখী প্রবণতা। তবে খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ সরবরাহসহ কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হারে তেজি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে নিকট মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ নীতি ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করছে। ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঝুঁকি বিবেচনায় চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়নের জন্য সংস্কার কার্যক্রমে ধীরগতি, অপর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ এবং সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতা স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো যায় এবং সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পায়, তাহলে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর তাদের আর্টিকেল-ফোর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিশেষ এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। জ্বালানি তেল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়ে যাওয়ার চাহিদা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যকে বেশ চাপের মুখে ফেলেছে । মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। আইএমএফ মনে করছে, এবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, অর্থনীতি একটা জটিল পরিস্থিতির ভেতর ঢুকছে। নীতিনির্ধারকদের এ পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বাড়ছে। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি ঋণ নিচ্ছে। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে অপরিপকস্ফতা রয়ে গেছে। বৈদেশিক সহায়তা ছাড় অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কমেছে ৫৭ শতাংশ। আরেকটি আশঙ্কার খবর হলো, প্রথম তিন মাসে প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে গেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দাতাদের উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক পিছিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা এবং আইএমএফের কাছ থেকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য সহায়তা প্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতি নেই।

No comments

Powered by Blogger.