স্মরণ-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : একজন ক্ষণজন্মা কথাসাহিত্যিক
একজন লেখকের কাছে সন্তানতুল্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টি। কোনো বাবার সন্তান যদি যোগ্যতায় মহান হয়, তাহলে সন্তানের সংখ্যা সেখানে বিচার্য হয় না। এক-দুই সন্তানও বাবার অহংকারের কারণ হয়। বাবাকে অনেক উচ্চাসনে স্থান করে দিতে সক্ষম হয়। বাংলা সাহিত্যের তেমন উদাহরণই হচ্ছেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি একজন স্বল্পপ্রজ লেখক ছিলেন। মাত্র দুটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন নিয়েই তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। ইতিহাস,
রাজনীতি, বাস্তবতার নিগূঢ় জ্ঞান_সব কিছু তিনি সহজ সরল ও কিছুটা কৌতুকবোধের মাধ্যমে শব্দবন্দি করেছেন তাঁর লেখনীতে। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ধরা হয় সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশি লেখক। মামার বাড়িতে জন্ম হয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। জন্ম ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা জেলার গেটিয়া গ্রামে। আর বাবার বাড়ি বগুড়া জেলায়। তাঁর ডাকনাম মঞ্জু। বাবা বদিউজ্জামান ইলিয়াস ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি। মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে আখতারুজ্জামান ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আর ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে। সবশেষে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করেন ১৯৬৪ সালে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক হিসেবে। তারপর তিনি মিউজিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপপরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুরাইয়া তুতুলকে তিনি বিয়ে করেন ১৯৭৩ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বহু মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করেন। এমনকি গোপনে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করেন। তাঁর লেখা_প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারী, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট ইত্যাদি গল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরের ইতিহাস ও সমাজ-বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। সরকারি কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই তখন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। আর ১৯৯৬ সালে পান আনন্দ পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনিও সারা জীবন লড়াই করেছেন রোগ-শোকের সঙ্গে। ডায়বেটিস ও জন্ডিস ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে আমাদের ছেড়ে চলে যান 'না ফেরার দেশে'। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে 'দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি'-এর মতো মাত্র সাতটি উপন্যাস লিখেই অচ্ছেদ্য ও অমর হয়ে আছেন ইংরেজি সাহিত্যে। আর বাংলা সাহিত্যে মাত্র দুটি উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭) এবং খোয়াবনামা (১৯৯৬) লিখেই অন্যতম ও অমর হয়ে আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
No comments