গোলাম আযমদের বিচার-সংক্রান্ত জটিলতা by ডা. এম এ হাসান

ন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করেছি। ওই সব লেখার উদ্দেশ্য ছিল আইনটিকে সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক করা। Elements of crimes-গুলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের জুরিসপ্রুডেন্স অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত করা। এতে আইনটি যেমন প্রাসঙ্গিক হতো, তেমনি কিছু আইন অধিকতর প্রায়োগিক হতো। সাম্প্রতিক সময়ে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগনামা সুবিন্যস্ত নয় বলে প্রসিকিউিশন


দায়েরকৃত মামলা (অভিযোগ) ফেরত দিয়েছেন আদালত। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা নিষ্প্রয়োজন, 'ভাগ্যিস তা বাতিল করতে বাধ্য হয়নি।' তারপর মনে রাখা উচিত, এসব প্রসিকিউশন নানা দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যবেক্ষিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে নানা মামলার উপাদান ও ঊীযরনরঃ হয়ে থাকবে। এতে কোনোভাবেই রাষ্ট্রের গৌরব বৃদ্ধি পাবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি বিশেষ কোটারিগোষ্ঠী ও কমিটির ফাঁদ থেকে বিমুক্ত না হওয়ার কারণেই আইন মন্ত্রণালয় স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখতে ব্যর্থ। এ ব্যর্থতার কারণ অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা, বাকসর্বস্ব লোকের সমাহারই বিপত্তির কারণ। অপরের সাহায্য গ্রহণের মতো মনমানসিকতার অভাব, বিশেষ করে আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সাহায্য নেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান সামগ্রিক বিচারকে কেবল লেজেগোবরে অবস্থায় নিমজ্জিত করেনি, বিচারকে দীর্ঘসূত্রতায় এবং নানা ব্যর্থতার আবর্তে নিমজ্জিত করেছে। নানা সিদ্ধান্তহীনতা এবং সঠিক আইনজ্ঞ নির্বাচনের অভাবে অনেক কিছু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে বিচারের ফলাফল ও পরিণতি নিয়ে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে সব কর্ম সুচারুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে সার্বিক অক্ষমতা, অজ্ঞতা এবং ভুল পথে চলার প্রবণতা। কেবল আবেগ ও শক্তিতে সব কিছু সম্পাদন করা যায় না, গালভরা কথা বলে মেঠো বক্তৃতা দেওয়া যায়, টেবিল উত্তপ্ত করা যায়, আসল কাজটি করা যায় না। কোনো ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয়। আসা যাক গোলাম আযমের বিষয়টিতে। এটাকে একটি Academic case বলা যেতে পারে। ব্যক্তি হিসেবে গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেউ ছিলেন না বা সরকারি কোনো পক্ষের ছিলেন না। এ কারণে তার বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা যায় না, তেমনি তাকে কোনো অবস্থাতেই Prime perpetrator হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। Prime perpetrator ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই তৈরি হয়েছে রাজাকার বাহিনী। (মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স, রাওয়ালপিন্ডি, ৭ সেপ্টেম্বর ১৮৭১, পাকিস্তান সরকার, নং ৪/৮/৫২/৫৪৩ পি এস-১/ক/৩৬৫৯/ডি-২ক)। এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এ বাহিনীতে Auxillary হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে রাজাকারদের। এদের ন্যস্ত করা হয়েছে E.P.C.A.F-এর প্রধান জেনারেল জামশেদের অধীনে। এদের কর্মকাণ্ড যেমন জেনারেল জামশেদ নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তেমনি জেনারেল নিয়াজিসহ অন্য পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কুখ্যাত আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনে কোনো গেজেট নোটিফিকেশন হয়নি এবং Official তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। অথচ আলবদর বাহিনী সৃষ্টি হয়েছে গোলাম আযমেরই পরামর্শে এবং এর প্রতিটি সদস্য ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। এদের নিয়ন্ত্রণ করেছে জেনারেল রাও ফরমান ও জেনারেল রহিম। এদের সব অপকর্ম আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ৯ ধরনে সুবিন্যস্ত করা যায়। (1. Genocide by killing, 2. Crimes against humanity of murder, 3. Crimes against humanity of extermination, 4. Crimes against humanity of torture, 5. Crimes against humanity of persecution, 6. Crimes against humanity of enforced disappearance of persons, 7. War crimes of attacking civilians, 8. War crimes of murder, 9. War crimes of mutilation) এসব অপরাধের প্রতিটিতে তাদের অংশগ্রহণ ছিল। বদর বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডার ও ট্রেইনার ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নানা অফিসার। যেমন_শেরপুরের কুখ্যাত সাকিব কামরানের ট্রেইনার ছিল মেজর রিয়াজ। বদর বাহিনীর সালাউদ্দিন ইউনিটের প্রধান আশরাফুজ্জামান খান তার নিত্যকার কর্মের জন্য পরামর্শ নিত বদরের ঢাকা প্রধান ব্রিগেডিয়ার বশীরের কাছ থেকে। তবে এরা বদর বাহিনীতে যোগ দেয় মতিউর রহমান গং-এর পরামর্শে ও নির্দেশে। মতিউর রহমান যা কিছু করেছেন তা দলীয় নির্দেশেই করেছেন। গোলাম আযম পাকিস্তানি সেনাপ্রধান টিক্কা ও নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন এবং জনবল দিয়ে সাহায্য করেছেন তথাকথিত দুষ্কৃত নামধারী বাঙালি নিধনে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধকর্ম সাধনে। তিনি আইয়ুব খানের কাছে অস্ত্র চেয়েছেন তার দলীয় লোকদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে। তিনি নানা প্রক্রিয়ায় তার দলীয় শত্রুসহ বাঙালি নিধনে সেই অস্ত্র প্রয়োগ করেন। এর সাক্ষী ও প্রমাণ রয়েছে নানা স্তরে। গোলাম আযম এবং জামায়াত দলগতভাবে পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও অভিন্ন মনে করেছে। এটা গোলাম আযমের মন্তব্য (সূত্র : ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)। তিনি ওই তারিখে এক ভাষণে বলেন, 'পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমের জন্য ইসলামের ঘর। কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে, তাহলে জামায়াতের কর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা মনে করে না।' জামায়াতপ্রধান বলেন, 'তাই জামায়াতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য কাজ করছে। দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি কমিটির মাধ্যমে ও অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মনে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করেছে। এবং একই উদ্দেশ্যে জামায়াত দুজন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছে।' গোলাম আযমই ১৯ জুন, '৭১-এ পিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানি আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য আহ্বান জানান। ওই সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নানা ঘটনা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে তিনি ১১ ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন। যে ১১ ধরনের অপরাধ তিনি করেন তা হলো_ 1. Genocide by killing, 2. Genocide by causing serious bodily or mental harm, 3. Crime against humanity of murder, 4. Crime against humanity of extermination, 5. Crime against humanity of enslavement, 6. Crime against humanity of deportation or forcible transfer of population, 7. Crime against humanity of imprisonment or other severe deprivation of physical liberty, 8. Crime against humanity of torture, 9. Crime against humanity of persecution, 10. Crime against humanity of enforced disappearance of persons, 11. Crime against humanity of other inhumane acts. তিনি এ অপরাধগুলো করেছেন যেমন একজন ব্যক্তি হিসেবে, তেমনি একটি দলের প্রধান হিসেবে। গণহত্যাকে বৈধতা দিয়ে এমন কর্মে প্রণোদনা সৃষ্টি করে তিনি '৭১-এ বাংলাদেশকে গণহত্যার নরকে পরিণত করেন। তার প্রণোদনায় এবং দলের লোকের অংশগ্রহণে যেসব নির্বিচার হত্যা ও গণহত্যা সাধিত হয়েছে বা অমানবিক নির্যাতনসহ গুম, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ এবং নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তার দায় তারই।
লেখক : আহবায়ক, ওয়ার ক্রাইম ফাইন্ডিং ফ্যাক্ট কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক

No comments

Powered by Blogger.