ব্যবস্থাপনার কালান্তর-গুগল গতিশীল ব্যবস্থাপনার একটি দৃষ্টান্ত by ইফতেখারুল ইসলাম

র্ব-৪ : একা অথবা কয়েকজন যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাজের সুবিধার জন্য একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়, যাতে একই ধরনের কাজগুলো বিন্যস্ত করা হয় একেকটি বিভাগ অথবা শাখায়। বিভাগীয় প্রধানের তত্ত্বাবধানে নানা উপবিভাগ ও ছোট ছোট দলে বিন্যস্ত হয়ে কর্মী ও ব্যবস্থাপকরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। প্রচলিত সাংগঠনিক নিয়মে এ রকম বিভাগগুলোর অভ্যন্তরে দায়িত্ব বণ্টন, জবাবদিহিতা এবং বার্ষিক মূল্যায়নের কাজগুলো পরিচালিত হয় পদের


ক্রম-উচ্চতা অনুযায়ী। ধরে নেওয়া হয়, একক কর্তৃত্ব ও নির্দেশনার ভিত্তিতে বিভাগীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ। এই প্রচলিত রীতিতে দ্বৈত কর্তৃত্ব, যুগ্ম তত্ত্বাবধান ইত্যাদি ধারণাকে প্রায় অসম্ভব, অনুপযুক্ত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু বিগত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে প্রতিযোগিতা প্রবলতা ও ব্যাপ্তির কারণে, প্রযুক্তি ও কৌশলগত পরিবর্তনের ফলে, পুরনো ধরনের কাঠামো এবং বিন্যাস ক্রমেই অসম্পূর্ণ, অকার্যকর ও অনুপযুক্ত প্রমাণিত হয়েছে।
ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে সাধ্যসীমার ভেতরে রাখার জন্য নূ্যনতম সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজন রয়েছে বলেই এই বিন্যাস-ব্যবস্থা আজও টিকে আছে; কিন্তু একে যথাসাধ্য সচল ও ফলপ্রসূ করার জন্য বিশেষত প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অন্যান্য ভোক্তা-অভিমুখী কর্মসূচিকে সফল করার জন্য প্রয়োজন হয়েছে বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ দল। ধরা যাক, একটি নতুন পণ্য বিপণনের বিশেষ দিনটিকে উপলক্ষ করে ক্রেতা ও ভোক্তাসাধারণের জন্য এটি বড় আকারের কর্মসূচি প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রচলিত নিয়মে এই কর্মসূচি তৈরি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিপণন বিভাগের। কিন্তু প্রতিটি কাজ সুচারুরূপে এবং সঠিক সময়ে সার্থকতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য অধিকতর উপযোগী সাংগঠনিক কাঠামো হবে বিপণন, বিক্রয়, বিতরণ, অর্থ, গণযোগাযোগ, এমনকি উৎপাদন ও মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অনুপ্রস্থ বা সর্ববিভাগীয় দল। তাই যথাসময় এ রকম একটি সর্ববিভাগীয় দল তৈরি করে তাঁদের ওপর এই আয়োজনের সব দায়িত্ব অর্পণ করাটাই সমকালীন ও বাস্তবসম্মত পন্থা। আজকের দিনে ক্রেতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে এবং প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সাফল্যের জন্য প্রায় প্রতিটি কাজে ব্যবস্থাপক-কর্মীদের পরস্পর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য। দোষারোপ, নিয়মশৃঙ্খলার আশ্রয় অথবা দায়িত্ব এড়ানোর সংস্কৃতির বিপরীতে এই পারস্পরিক সহযোগিতা যাঁরা অবাধে অর্জন করতে পারবেন, তাঁরাই ব্যবস্থাপনার জগতে নতুন জনপদ গড়ে তুলবেন।

গল্প নয় : দুটি উদাহরণ
গুগল নামক বিশ্বখ্যাত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সম্প্রতি সেখানে কিছু পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন। তিনি সভা-আলোচনায় সময়ক্ষেপণ তো করতেই চান না, এমনকি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অন্তহীন ই-মেইল আদান-প্রদানকেও অপছন্দ করেন। গত ১১ নভেম্বর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় এ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গুগল তার আধুনিক ও গতিশীল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির জন্য সুপরিচিত। ওয়েব থেকে তথ্য খুঁজে বের করার জন্য সন্ধান-যন্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। তারপর সন্ধান-ফলাফলের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন প্রচারের মডেলটি প্রয়োগ করে গুগল সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে শুরু করে। পরবর্তী সময় জিমেইল সেবা এবং এডসেন্স যুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিশালাকার ধারণ করে সব দিক থেকে। তবুও উদ্যোক্তারা সচেষ্ট ছিলেন এর ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মতো উষ্ণ ও প্রাণবন্ত ধারা বজায় রাখতে। ব্যবস্থাপনার স্তর কমিয়ে, নতুন চিন্তাকে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিয়ে গুগল সর্বদা সৃজনশীলতার শীর্ষে থাকতে চেয়েছে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কম্পানিতে এখন ৩১ হাজার কর্মী এবং বর্তমান সালে এখন পর্যন্ত তাঁদের রেভিনিউ ২৭.৩ বিলিয়ন ডলার। এখন মাত্র ১৫ বছর বয়সেই গুগল বেশ বড় এবং গুরুভার হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এর প্রধান নির্বাহী। তিনি এর বেশ কিছু নতুন প্রকল্প বাতিল করে দিচ্ছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার গতি বাড়াতে চেষ্টা করেছেন এবং যেকোনো বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তির ওপর জোর দিচ্ছেন।
আরেকটি চমকপ্রদ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্রাজিলের সেমকো। ২৩ বছর বয়সী রিকার্ডো সেমলার যখন ১৯৮২ সালে এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব নেন তখন তিনি প্রথমেই ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকদের মধ্য থেকে দুই-তৃতীয়াংশকে সরিয়ে দেন। এরপর থেকে তিনি যা করেছেন তা হলো কর্মচারীদের স্বব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপ্লবিক নিরীক্ষা। একপর্যায়ে সেমকোর একটি বিভাগে ৮০০ কর্মীর জন্য ছিলেন মাত্র একজন ব্যবস্থাপক। ১৯৮২ সালে ৯০ জন কর্মী নিয়ে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানে আজ কর্মরত আছেন তিন হাজার লোক। সেমকোর নব-উদ্ভাবিত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ভেতর অন্তর্ভুক্ত কিছু বিষয় নিম্নরূপ।
* সম্প্রতি তারা তাদের প্রধান কার্যালয় ভবনটিকে বাতিল করেছে। এখন একটি ছোট লাউঞ্জের মতো কক্ষে এর প্রধান কার্যালয়, যেখানে প্রয়োজনমতো কর্মকর্তারা আসেন-যান, কিন্তু কেউ সেখানে স্থায়ীভাবে বসেন না।
* সব কর্মী তাঁদের পছন্দমতো কাজের সময় নির্ধারণ করেন। কখন কাজ করবেন, কতটুকু করবেন_সব কিছুই তাঁদের ইচ্ছামতো। বলাবাহুল্য, কাজের সময় ও পরিমাণ অনুযায়ী তাঁদের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়।
* প্রতিষ্ঠানে কোনো অভ্যন্তরীণ হিসাব নিরীক্ষক নেই। কর্মীদের ব্যয়ের প্রতিবেদন কেউ পড়ে দেখেন না। এর বদলে সেমকো তার কর্মীদের মধ্যে গভীর বিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধ তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে।
* কর্মীদের একটি বড় অংশ তাঁদের নিজেদের বেতন নিজেরাই স্থির করেন। এ জন্য তাঁদের সেমকো এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক বেতন-ভাতার তথ্য দেওয়া হয়। কর্মীরা জানেন, এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ কমে যাবে, যেখানে তাঁদের একটা অংশ আছে।
* কর্মীদের ভ্রমণ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই। প্রতিষ্ঠানের কাজে ভ্রমণের সময় তাঁরা কোথায় থাকবেন, কোন বিমান সংস্থা ব্যবহার করবেন তা তাঁরা নিজেরাই স্থির করেন।
তাঁদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো বা চিত্র নেই। কোনো কৌশলপত্র বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। সেখানে কোনো কর্মীকে কোনো কাজ করার জন্য বাধ্য করা যায় না। কোনো কর্মী তাঁর নির্ধারিত কাজটি ভালো লাগলে তবেই তা বেছে নিতে পারেন। সারকথা হচ্ছে এই যে সেমকো তার কর্মীদের স্বাধীনতা দেয় নিজের কর্মজীবনের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে। তারপর তাঁদের ব্যক্তিগত সততা, প্রত্যেক কর্মীর নিজের আর্থিক স্বার্থ, সহকর্মীদের চাপ ও তথ্যের অবাধ প্রবাহের ওপর নির্ভর করে একটি নতুন নিরীক্ষাধর্মী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে। ধরে নেওয়া হয় যে কর্মী অপরিণত বয়সী নন; তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। সৃজনশীল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির একটি চরম উদাহরণ স্থাপন করেছে ব্রাজিলের এ প্রতিষ্ঠানটি।
আমরা হয়তো এখনো এতটা বৈপ্লবিক পদ্ধতি এবং উদ্ভাবনীশক্তি ব্যবহারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হইনি। তবে বাংলাদেশে ভৌতিক অবকাঠামো যখন অপ্রতুল, যানজট এবং অন্যান্য সমস্যা যখন উৎপাদনশীলতাকে দারুণভাবে ব্যাহত করছে তখন কেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মতিঝিল অথবা মহাখালীর প্রধান কার্যালয়ে শত শত কর্মীর জন্য ৯-৫টা শৃঙ্খল তৈরি করছে? এভাবে মানুষের জীবনীশক্তি, জ্বালানি এবং অন্য বহু সম্পদের অপচয় করে আমরা কার্যালয়-পরিচালনার শতবর্ষের প্রাচীন পদ্ধতির প্রতি নির্বোধ ও নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করছি। নতুন প্রযুক্তি এসে যে সীমানাপ্রাচীরগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেগুলো সক্রিয় রয়ে গেছে আমাদের মনের ভেতরে। অথচ আমাদের মতো দেশে কর্মপদ্ধতি আরো অনেক আগে থেকেই সম্পদসাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠা উচিত ছিল। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ কর্মকর্তা ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহার করেন, তাহলে কেন আমরা সপ্তাহের কোনো কোনো দিনে বাড়িতে বসে কাজ করতে পারি না? অথবা ২০০ মানুষের প্রধান কার্যালয়কে ভেঙে বিকেন্দ্রীকরণ করে উত্তরা, মিরপুর, পল্টনে তিনটি ছোট উপকেন্দ্র কেন স্থাপন করতে পারি না? স্ব-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের নবীন কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের নির্ভরযোগ্যতা বিষয়ে কোনো সংশয় থাকলে তা দূর করতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
(চলবে)

লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক
একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.