উৎসব-কুকরি-মুকরি বনে সূর্যোৎসব

ৎসব দলের লঞ্চটি তেঁতুলিয়া বেয়ে বুড়াগৌরাঙ্গ নদে বাঁক নিল, তখন সবাই হই-হুল্লোড় করে বলে উঠল, ‘আরে, এ তো আরেক “সুন্দর বন!”’ জায়গাটির নাম চর মানিকা বন। এখান থেকে শুরু করে দক্ষিণে জল আর বন। ১২তম ‘সূর্যোৎসব’ দল ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে যাত্রা শুরু করে ভোলার উদ্দেশে। বলছি ৩১ ডিসেম্বরের ঘটনা। দুই পাশে ঘন অরণ্য। নদীতে সারি সারি জেলে নৌকা। লঞ্চের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাটামাছের চঞ্চল সাঁতার। ঝাঁক বেঁধে উড়ে


যায় পাখির দল। কখনো বকের ঝাঁক, কখনো চক্কা, কখনো বালি হাঁস। একেক সময় একেক রকম পাখি। পাখি আর মাছের নাচন দেখে লঞ্চের সবার উচ্ছ্বাস বেড়ে যায়। তারা মাছের মতো নাচ-গান জুড়ে দেয়। এক দল ঘুড়িতে সুতা লাগাচ্ছে, অন্য দল ওড়াচ্ছে, বাতাসে রঙিন ঘুড়ি নীলাকাশে মিলিয়ে যায় আকাশ ছোঁয়ার আশায়। মেঘনা থেকে জোয়ার উঠছে, আর তেঁতুলিয়া থেকে ভাটা নামছে। জোয়ার-ভাটার মিলনস্থলে অপরূপ এক দৃশ্য, স্থানটি কচ্ছপিয়া। দুটি পানিকে আলাদা করা যাচ্ছে, রংও আলাদা। এ দৃশ্যও মানুষকে শিহরণ জাগাবে। পর্যটকদেরও আন্দোলিত করেছে। মধ্যাহ্নের পূর্বক্ষণে দেখা গেল কুকরি-মুকরি বনের ঠিকানা। চারদিকেই ঘন অরণ্য। এর মাঝে উত্তাল জলরাশি। যদিও শীতে সে নীরব, আপন মনে বয়ে যায়।
২.
ভোলার চরফ্যাশনের দক্ষিণে বিচ্ছিন্ন সাগর মোহনায় কুকরি-মুকরি বন। পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা এখানে। ১৮৫০ সালে চরে মানুষের বসবাস শুরু হয়। ছিল অত্যধিক ইঁদুর ও কুকুরের বসবাস। বরিশালের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বেভারিজ ওই চরে ভ্রমণ করতে গিয়ে নাম দেন কুকুরি-মুকুরি। সেটি এখন কুকরি-মুকরি। ১৯২২ সালে জার্মানির প্রিন্স ক্রাউন এ চরে বুনো মহিষ শিকারে আসেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভোলার দুই লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। তাদের অনেকেই কুকরি-মুকরি চরের। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দেখতে আসেন। তখন তিনি উপলব্ধি করেন, উপকূলীয় অঞ্চল ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বনায়ন করা দরকার। কুকরি-মুকরি চরে ‘মুজিব কিল্লা’ নামে একটি স্থানও আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু চরবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৯৭৩ সালে বনায়ন শুরু করে বন বিভাগ। ভাঙন-গড়নের আবর্তে পড়ে বর্তমান কুকরি-মুকরি চরে বনায়নের পরিমাণ ৮৫ হাজার ৬৫ হেক্টর, যার মধ্যে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ২১৭ হেক্টর। বসতি ও কৃষি আবাদ আছে প্রায় চার হাজার ৮১০ হেক্টরে। চরের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ও কাঁকড়া ধরা এবং পশুপালন ও কৃষিকাজ।
৩.
কুকরি-মুকরি বনের পাশ দিয়ে যখন উৎসব দলের জাহাজটি যাচ্ছে, তখন জেলে-বউ আর উদোম শিশুর দল নদীর তীরে ভিড় করে, যেন এমন বড় লঞ্চ কখনো দেখেনি। লঞ্চ বালুর ধুমে নোঙর করা হলো। এখানে সমুদ্রসৈকতের মতো পলি-বালুর সৈকত। তারপর খেজুর বন, নারকেল বন। এখানে সারা বছরই পাখি থাকে। গাংচিল, গাং-কবুতর, বক; শীতে আসে হাজার হাজার জলচর অতিথি পাখি। জলে জেলেরা জাল পেতে নৌকা নোঙর করে অপেক্ষা করেন। একটু ঢেউ পেলে মাছের ঝাঁক ডিগবাজি খায়, সে লোনা জলে বকের দল ধার্মিক সেজে করে মাছ শিকার।
২০১১ সালের শেষ সূর্যকে বিদায় জানাতে উৎসব দল নেমে আসে পলি-বালুর চরায়। তখন বিকেল। এক দল নীল জলে গোসল করে মনের আনন্দে। অন্য দল ব্যস্ত সূর্যকে বিদায় জানাতে। এদিকে উৎসব দলে উপস্থিত নাসিমা বেগম, বয়সে প্রবীণ হলেও মনে সবচেয়ে তরুণ। তিনি সবাইকে চকলেট বিলোচ্ছেন। একদল রঙিন ঠোঙায় ঢাকা ১২টি হারিকেনে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে বছরের শেষ সূর্যকে জানাল বিদায়। কেউ ইঞ্জিনের নৌকায় চলে যায় বনের ভেতর। গাছের সবুজ পাতার ছাউনির ফাঁক গলে চাঁদ-জ্যোৎস্না। জলের ছলাৎ ছলাৎ। শীত। বুনো মহিষের ডাক, কখনো শেয়াল। গা ছম-ছম। জ্যোৎস্না আলোয় কাঠের আগুন পোহায় জলে ভেজা দুষ্টের দল। সে উষ্ণতায় মায়ের কোলে ঘুমিয়ে যায় দুষ্ট-চঞ্চল শিশু।
৪.
হঠাৎ চাঁদের আলো নিভে যায়। তখন রাত ১২টা এক মিনিট। মাটির খোরায় (পাত্র) মোমবাতি জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। শত শত জ্বলন্ত প্রদীপ। চারপাশে অথৈ জলরাশি, জলে ছোট ছোট ঢেউ, সে ঢেউ মোমের ক্ষীণ আলোয় জ্বলছে, আলোকিত জল দোল খাচ্ছে। সাগর মোহনায় এমন সুন্দর দৃশ্য দেখেছে কেউ? এ পর্বের নাম দেওয়া হয়েছে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বালন। তখন জোয়ার শুরু হয়েছে। সমুদ্রতীর থেকে জনসমুদ্রের দিকে ভেসে যাচ্ছে আলোর মিছিল। ফিরে আসছে আলোকিত নতুন বছর ২০১২ সাল। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ১২তম সূর্যোৎসবের প্রধান সমন্বয়ক মেসবাহ য়াযাদ বললেন, বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মিলনস্থলে দণ্ডায়মান সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভোলার চরফ্যাশন চর কুকরি-মুকরি বন। কিন্তু এ প্রাকৃতিক সবুজ বনভূমি, বিস্তীর্ণ পলি-বালুর সৈকত, নারকেল বাগান আর বিশাল জলরাশির খবর খুব কম পর্যটকই জানে। এ অপরূপ সৌর্ন্দয পৃথিবীকে জানানোর জন্য এ সূর্যোৎসব। কুকরি-মুকরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসেম মহাজন বলেন, কুকরি-মুকরি বন বাংলাদেশের সেরা পর্যটন এলাকা হতে পারে। তবে এর যোগাযোগে আরও উন্নয়ন দরকার।
নেয়ামত উল্যাহ

No comments

Powered by Blogger.