শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-ধন্য মোরা ধন্য, ছাত্রলীগ তোমারই জন্য! by ফারুক ওয়াসিফ
নববর্ষে নতুন একগুচ্ছ বীর ও ছাত্রনেতার আবির্ভাবকে স্বাগতম। পাঠকদের অনুরোধ, এঁদের মনে রাখবেন। দেখবেন, অচিরেই এঁদের কয়েকজন বড় নেতা হয়ে উঠবেন। ঢাকার বুয়েট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার কুয়েট এবং নোয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা গত কয়েক দিনে এঁদের হাতে মার খেয়ে শুয়ে পড়েছেন, খোঁড়াচ্ছেন, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে অধোবদনে আছেন, আপনারা দুঃখ করবেন না। আপনাদের ত্যাগ সার্থক হবে।
আপনারা ছাত্রলীগের একগুচ্ছ সোনার ছেলেদের তেজস্ক্রিয় উত্থানের জ্বালানি মাত্র। আপনাদের অপমান আর নীপিড়নের আগুনে পুড়েই না এই সোনার ছেলেরা খাঁটি হয়ে উঠবেন। সৃষ্টির এই প্রসব বেদনা উপভোগ করাই আপনাদের জীবনের সার্থকতা। আপনাদের পরিবার এবং এলাকাবাসীও আপনাদের নিয়ে গর্ব করবে, বলবে ‘না না না, তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।’ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ঋণও ‘কোনো দিন শোধ হবে না’, এই ঘোষণা তো গান গেয়েই জানানো হয়েছে। এই গান আপনাদেরও সান্ত্বনা দেবে।
কিন্তু ওই উদীয়মান বীরপুঙ্গবদের ঋণ আমরা শোধ করে যাব— প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, জাতীয়ভাবে। এই ঋণশোধের শিক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে। ১৯৯৭ সালের এক মধ্যরাতে আপনাদের মতোই আমরাও ছাত্রলীগের নবীন নেতাদের যোগ্যতার উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের নবীন ক্যাডার মানিকের নেতৃত্বে পাঁচটি পুরুষ হলে সারা রাত ধরে বামপন্থী পেটানো কর্মসূচি চলে। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ ক্যাম্পাসের প্রায় সব প্রগতিশীল সংগঠনের ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সে রাতে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়। এই ঘটনার পরেই মানিক হয়ে ওঠে জাবি ছাত্রলীগের মহানায়ক।
এর কোনো শাস্তি হয় না। বরং ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রসমাজে এদের ভাবমূর্তি তুমুল জোরদার হয়। সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেয় এরাই ক্যাম্পাসের নেতা, এরাই জাবি ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ পূর্ণ চেহারায় ধরা দেয় এক বছর পর। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয়ে পড়ে, মানিক গ্রুপের সোনার ছেলেরা ক্যাম্পাসের পুরুষ ছাত্রদের জয়ের পর এবার নারী-শিকারে নেমেছে। এখন তারা আরও ক্ষমতাবান, ’৯৭ সালের অখ্যাত মানিক এখন ছাত্রলীগের জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক, তার ভাই-বেরাদররাও বড় নেতা তত দিনে। আগের যুদ্ধের অস্ত্র ছিল লাঠি, স্ট্যাম্প, রামদা, কাটা রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি। নারীর শরীরের বিরুদ্ধে এবারের যুদ্ধের অস্ত্রটা মানুষের পয়দা ছিল না, তা ছিল প্রকৃতির সৃষ্টি এবং তাদের শরীরেরই অংশ। কিন্তু প্রকৃতিতে ধর্ষণ না থাকলেও মানিকের মতো পুরুষেরা এই যন্ত্রের অপব্যবহার ভালোই রপ্ত করেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য সেটা ছিল এক যন্ত্রণাদায়ক কালো অধ্যায়। এই ধর্ষণ-যুদ্ধে বিজয়ের পরই মানিককে তার ধর্ষক বন্ধুরা ‘সেঞ্চরিয়ান মানিক’ খেতাবে সম্মানিত করে যদিও বাস্তবে ঘটনা ঘটেছিল সাত-আটটি। এর পরেও মানিকের পদ অটুট থাকে।
এই কাহিনির শিক্ষা এই: যদি ১৯৯৭ সালেই সন্ত্রাসী মানিকদের দমানো যেত, তাহলে ’৯৮ সালে ধর্ষক মানিকদের উত্থান ঘটত না এবং ছাত্রলীগ তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মুখেও তারা চুনকালি মাখাতে পারত না।
ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির ব্যাকরণই এমন, আজ যে যতটা দাপটে সন্ত্রাস-দুর্নীতি করতে পারবে, কাল তার ওপরই নির্ভর করবে কায়েমি মহল। যে সাপের বিষ নেই, তাকে কেউ ভয় করে না। আর যেখানে কায়েমি রাজনীতির চরিত্রই হলো ‘তেড়ে মেরে ডাণ্ডা. করে দেব ঠাণ্ডা’, সেখানে ডাণ্ডাধারীরাই পুরস্কৃত হয়। বিএনপি আমলে এটা ঘটেছে, এই আমলেও ঘটছে। বিএনপির আমলের ছাত্রলীগের তাণ্ডব ও সন্ত্রাস, ছাত্র-শিক্ষক পীড়নকে আমলে নিচ্ছে না সরকার। তারা কি তাহলে এদের থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব আশা করে?
একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল আলম প্রধান খুনের দায়ে দণ্ডিত অপরাধী ছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁকে মুক্ত করে দল করার সুযোগ দেন। এরশাদের ট্যান্ডন অভিও ক্যাম্পাসের ত্রাস ছিলেন, পরে তিনি এমপি হন। ছাত্রলীগ নেতা আওরঙ্গ, লিয়াকতেরাও সন্ত্রাসী যোগ্যতায় নেতা বনে যান। অনেকের অভিযোগ, ছাত্রদলের ইলিয়াস আলীর বিকাশও এই পথেই হয়। এ রকম আরও আছেন যাঁরা টিকটিকির লেজ খসানোর কায়দায় সন্ত্রাসী অতীত ধামাচাপা দিয়ে সেই ধামায় চড়ে বড় নেতা হয়েছেন, এমপি হয়েছেন।
শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুপারিশ অনেকে একসময় করতেন। কিন্তু বন্ধ করার মতো ছাত্ররাজনীতি কি আসলে আছে? নব্বই দশকের শুরু থেকে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের হাতেই কি সত্যিকার ছাত্ররাজনীতির দম বন্ধ হনি? গণতান্ত্রিক ও অধিকারমুখী ছাত্র আন্দোলনকে কোণঠাসা করে এদের মাধ্যমেই কি দখল-দুর্নীতি ও নির্যাতনকেন্দ্রিক কায়কারবার শিক্ষাঙ্গনকে জিম্মি করে ফেলেনি? জনপ্রিয় বা ছাত্রমুখী নেতৃত্বের জায়গায় সে সময়ই কি ক্যাডাররা দল-লীগের প্রধান শক্তি হয়ে ওঠেনি? এদের কারণেই কি প্রগতিশীল ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে মার খেতে খেতে সংকুচিত হয়ে যেতে হয়নি? শিক্ষাঙ্গনে আলোচনা-বিতর্ক, পত্রিকা প্রকাশ, নাটক-গান-উৎসবের মতো প্রাণবন্ত চর্চার পরিবেশও এদের হাতে ধ্বংস হয়। তারুণ্যের উদ্দীপনা ও সৃজনশীলতাকে এভাবে শুকিয়ে মারার পথেই শিক্ষাঙ্গনগুলো দিনে দিনে বন্ধ্যা হতে থাকে, দেশ হারায় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সতেজ বীজতলা। তার ফল সমাজ ও রাজনীতিতে অতি প্রকট। ছাত্র রাজনীতি যদি কদাচ বন্ধ হয়ও, দেখা যাবে, বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতি, কিংবা অমুক-তমুক স্মৃতি পরিষদের নামে এই একই কাজ হচ্ছে। সমগ্র রাজনীতিটাই না বদলালে, মানুষ এদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান না করলে এরকমই তাই চলবে।
এক অর্থে নব্বই দশকেই দল-লীগ ছাত্রশিবিরের পথ ধরে। একসময় ছাত্রশিবির বা জাতীয় ছাত্রসমাজ যা করত, সেসব অনাচার দল-লীগও রপ্ত করে। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক রাজনীতি কখনোই করত না, বৃহত্তর ছাত্রসমাজের দাবি-দাওয়ার দিকেও তাদের নজর ছিল না। গণতন্ত্রের সংগ্রামেও তাদের থাকার কথা নয় এবং থাকলেও ছিল লোকদেখানো। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যুদ্ধাপরাধীদের সহায়ক রাজনৈতিক দাপট সৃষ্টিই ছিল তাদের লক্ষ্য ও কর্মসূচি। ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের মাধ্যমেই অস্ত্র-বোমার ছড়াছড়ি শুরু হয়। তাদের খুরেই অজস্র প্রগতিশীল ছাত্রের রক্তের নহর বয়ে যায়।
হল দখল, অস্ত্রবাজি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, দলীয়করণ, ক্যাম্পাসগুলোকে মুরগির খোঁয়াড় বানানো, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলতে-ফিরতে দমিয়ে রাখা ছিল শিবিরের বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হলেও সেই কাজই সে দিনের দল আর আজকের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দক্ষতার সঙ্গে করছে। দিন তাদেরই, রাতটাও তাদের। কিন্তু এই দিনই দিন নয়, আরও দিন আছে।
মানিকের করুণ পরিণতি হয়েছিল জাবির শিক্ষার্থীদেরই হাতে। উত্থানের দুই বছরের মাথায় বিরাট ছাত্র আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগের মানিক ও তার ধর্ষক গ্রুপকে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কৃত ও বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে তার গ্রুপের ধর্ষকেরা আবার অস্ত্রের জোরে হল দখল করার দুই দিনের মাথায় পুলিশি সহায়তা সত্ত্বেও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর গণধাওয়ার মুখে পলায়ন করে। দিনটা ছিল ২ আগস্ট। জাবির শিক্ষার্থীদের, বিশেষত মেয়েদের প্রবল প্রতিরোধের কারণে পরের দুই বছরও ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্জিত ও ধিকৃতই থাকে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এ রকম বিতাড়ন নব্বই দশকের পরের একমাত্র ঘটনা। আওরঙ্গ, প্রধান, লিয়াকত কিংবা অভিদের পরিণতিও ভালো হয়নি।
গত কয়েক দিনে যাঁরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের তাণ্ডব বইয়ে দিচ্ছেন, বামপন্থী ছাত্রকর্মীদের মারের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা হয়তো সাময়িকভাবে নেতৃত্বের পদ পাবেন। কিন্তু ইতিহাস জিগার আঠার মতো, এই কলঙ্ক তাদের ছাড়বে না।
গোঁফ দেখে বিড়াল চেনার মতো এখন অস্ত্র দেখে চেনা যায় কে কোন দলের ক্যাডার। দলীয় ক্যাডারদের ব্র্যান্ড এখন নানান জাতের অস্ত্র। ছাত্রলীগের রামদা-চাপাতি, ছাত্রদলের কাটা রাইফেল-পাইপগান, শিবিরের রগ কাটা ক্ষুর-কুড়াল। অস্ত্র যেখানে ঝনঝন করে, রক্ত যেখানে যখন-তখন যার-তার দেহ থেকে ঝরে, তখন ন্যায়নীতি-মনুষ্যত্ব কর্পূরের মতো উবে যায়। বলপ্রয়োগ যখন রাজনীতির উপায়, তখন সাধারণ ছাত্ররা নিরুপায়।
মিছিল না করার অপরাধে কনকনে শীতে মাঠের মধ্যে ঢাবির ৪৪ ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে রাখা, ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে মার খেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ, গত জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপাতির কোপে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের পায়ের ও ঘাড়ের রগ কাটা, ২০১০ সালের জুলাই মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া; দলের মধ্যে এবং দলের বাইরে কী করা বাদ রেখেছে ছাত্রলীগ!
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকেও বুঝতে হবে, এসিড পান করা যায় না। এই এসিড দলের ও সমাজের গলা-পেট-পাকস্থলী দিয়ে পোড়াতে পোড়াতে নামতে থাকবে, সঙ্গে নিয়ে যাবে জীবনীশক্তিটাও। ছাত্রলীগের ৬৪ বছর পূর্তির এই দিনে নববর্ষের এই সন্ত্রাসী উপহার হাতে নিয়ে এই কথা আমাদের বলতে হচ্ছে। আরব-ইউরোপ-আমেরিকায় তরুণেরা যখন অধিকারের জন্য লড়ছে, বাড়াচ্ছে জাতীয় গৌরব, তখন আপনাদের কাছে চাওযা একটাই: নিজেদের গৌরবটা অন্তত রক্ষা করুন। আজকের তরুণেরা মাথা হেঁট করে থাকতে রাজি নয়, ছাত্রাবাসগুলোয় খোঁয়াড়ের মুরগির মতো ‘কখন ধরবে, কখন মারবে’ এমন ভয়ে তটস্থ থাকাও সম্ভব নয়। দিন আপনারা না বদলান, মানুষ তাদের দিন বদলিয়ে নেবেই।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
কিন্তু ওই উদীয়মান বীরপুঙ্গবদের ঋণ আমরা শোধ করে যাব— প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, জাতীয়ভাবে। এই ঋণশোধের শিক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে। ১৯৯৭ সালের এক মধ্যরাতে আপনাদের মতোই আমরাও ছাত্রলীগের নবীন নেতাদের যোগ্যতার উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি হয়েছিলাম। ছাত্রলীগের নবীন ক্যাডার মানিকের নেতৃত্বে পাঁচটি পুরুষ হলে সারা রাত ধরে বামপন্থী পেটানো কর্মসূচি চলে। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশনসহ ক্যাম্পাসের প্রায় সব প্রগতিশীল সংগঠনের ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সে রাতে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়। এই ঘটনার পরেই মানিক হয়ে ওঠে জাবি ছাত্রলীগের মহানায়ক।
এর কোনো শাস্তি হয় না। বরং ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রসমাজে এদের ভাবমূর্তি তুমুল জোরদার হয়। সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেয় এরাই ক্যাম্পাসের নেতা, এরাই জাবি ছাত্রলীগের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎ পূর্ণ চেহারায় ধরা দেয় এক বছর পর। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয়ে পড়ে, মানিক গ্রুপের সোনার ছেলেরা ক্যাম্পাসের পুরুষ ছাত্রদের জয়ের পর এবার নারী-শিকারে নেমেছে। এখন তারা আরও ক্ষমতাবান, ’৯৭ সালের অখ্যাত মানিক এখন ছাত্রলীগের জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক, তার ভাই-বেরাদররাও বড় নেতা তত দিনে। আগের যুদ্ধের অস্ত্র ছিল লাঠি, স্ট্যাম্প, রামদা, কাটা রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি। নারীর শরীরের বিরুদ্ধে এবারের যুদ্ধের অস্ত্রটা মানুষের পয়দা ছিল না, তা ছিল প্রকৃতির সৃষ্টি এবং তাদের শরীরেরই অংশ। কিন্তু প্রকৃতিতে ধর্ষণ না থাকলেও মানিকের মতো পুরুষেরা এই যন্ত্রের অপব্যবহার ভালোই রপ্ত করেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য সেটা ছিল এক যন্ত্রণাদায়ক কালো অধ্যায়। এই ধর্ষণ-যুদ্ধে বিজয়ের পরই মানিককে তার ধর্ষক বন্ধুরা ‘সেঞ্চরিয়ান মানিক’ খেতাবে সম্মানিত করে যদিও বাস্তবে ঘটনা ঘটেছিল সাত-আটটি। এর পরেও মানিকের পদ অটুট থাকে।
এই কাহিনির শিক্ষা এই: যদি ১৯৯৭ সালেই সন্ত্রাসী মানিকদের দমানো যেত, তাহলে ’৯৮ সালে ধর্ষক মানিকদের উত্থান ঘটত না এবং ছাত্রলীগ তথা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মুখেও তারা চুনকালি মাখাতে পারত না।
ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির ব্যাকরণই এমন, আজ যে যতটা দাপটে সন্ত্রাস-দুর্নীতি করতে পারবে, কাল তার ওপরই নির্ভর করবে কায়েমি মহল। যে সাপের বিষ নেই, তাকে কেউ ভয় করে না। আর যেখানে কায়েমি রাজনীতির চরিত্রই হলো ‘তেড়ে মেরে ডাণ্ডা. করে দেব ঠাণ্ডা’, সেখানে ডাণ্ডাধারীরাই পুরস্কৃত হয়। বিএনপি আমলে এটা ঘটেছে, এই আমলেও ঘটছে। বিএনপির আমলের ছাত্রলীগের তাণ্ডব ও সন্ত্রাস, ছাত্র-শিক্ষক পীড়নকে আমলে নিচ্ছে না সরকার। তারা কি তাহলে এদের থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব আশা করে?
একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল আলম প্রধান খুনের দায়ে দণ্ডিত অপরাধী ছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁকে মুক্ত করে দল করার সুযোগ দেন। এরশাদের ট্যান্ডন অভিও ক্যাম্পাসের ত্রাস ছিলেন, পরে তিনি এমপি হন। ছাত্রলীগ নেতা আওরঙ্গ, লিয়াকতেরাও সন্ত্রাসী যোগ্যতায় নেতা বনে যান। অনেকের অভিযোগ, ছাত্রদলের ইলিয়াস আলীর বিকাশও এই পথেই হয়। এ রকম আরও আছেন যাঁরা টিকটিকির লেজ খসানোর কায়দায় সন্ত্রাসী অতীত ধামাচাপা দিয়ে সেই ধামায় চড়ে বড় নেতা হয়েছেন, এমপি হয়েছেন।
শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুপারিশ অনেকে একসময় করতেন। কিন্তু বন্ধ করার মতো ছাত্ররাজনীতি কি আসলে আছে? নব্বই দশকের শুরু থেকে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের হাতেই কি সত্যিকার ছাত্ররাজনীতির দম বন্ধ হনি? গণতান্ত্রিক ও অধিকারমুখী ছাত্র আন্দোলনকে কোণঠাসা করে এদের মাধ্যমেই কি দখল-দুর্নীতি ও নির্যাতনকেন্দ্রিক কায়কারবার শিক্ষাঙ্গনকে জিম্মি করে ফেলেনি? জনপ্রিয় বা ছাত্রমুখী নেতৃত্বের জায়গায় সে সময়ই কি ক্যাডাররা দল-লীগের প্রধান শক্তি হয়ে ওঠেনি? এদের কারণেই কি প্রগতিশীল ও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোকে মার খেতে খেতে সংকুচিত হয়ে যেতে হয়নি? শিক্ষাঙ্গনে আলোচনা-বিতর্ক, পত্রিকা প্রকাশ, নাটক-গান-উৎসবের মতো প্রাণবন্ত চর্চার পরিবেশও এদের হাতে ধ্বংস হয়। তারুণ্যের উদ্দীপনা ও সৃজনশীলতাকে এভাবে শুকিয়ে মারার পথেই শিক্ষাঙ্গনগুলো দিনে দিনে বন্ধ্যা হতে থাকে, দেশ হারায় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সতেজ বীজতলা। তার ফল সমাজ ও রাজনীতিতে অতি প্রকট। ছাত্র রাজনীতি যদি কদাচ বন্ধ হয়ও, দেখা যাবে, বিভিন্ন আঞ্চলিক সমিতি, কিংবা অমুক-তমুক স্মৃতি পরিষদের নামে এই একই কাজ হচ্ছে। সমগ্র রাজনীতিটাই না বদলালে, মানুষ এদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান না করলে এরকমই তাই চলবে।
এক অর্থে নব্বই দশকেই দল-লীগ ছাত্রশিবিরের পথ ধরে। একসময় ছাত্রশিবির বা জাতীয় ছাত্রসমাজ যা করত, সেসব অনাচার দল-লীগও রপ্ত করে। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক রাজনীতি কখনোই করত না, বৃহত্তর ছাত্রসমাজের দাবি-দাওয়ার দিকেও তাদের নজর ছিল না। গণতন্ত্রের সংগ্রামেও তাদের থাকার কথা নয় এবং থাকলেও ছিল লোকদেখানো। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যুদ্ধাপরাধীদের সহায়ক রাজনৈতিক দাপট সৃষ্টিই ছিল তাদের লক্ষ্য ও কর্মসূচি। ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের মাধ্যমেই অস্ত্র-বোমার ছড়াছড়ি শুরু হয়। তাদের খুরেই অজস্র প্রগতিশীল ছাত্রের রক্তের নহর বয়ে যায়।
হল দখল, অস্ত্রবাজি, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, দলীয়করণ, ক্যাম্পাসগুলোকে মুরগির খোঁয়াড় বানানো, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের চলতে-ফিরতে দমিয়ে রাখা ছিল শিবিরের বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হলেও সেই কাজই সে দিনের দল আর আজকের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দক্ষতার সঙ্গে করছে। দিন তাদেরই, রাতটাও তাদের। কিন্তু এই দিনই দিন নয়, আরও দিন আছে।
মানিকের করুণ পরিণতি হয়েছিল জাবির শিক্ষার্থীদেরই হাতে। উত্থানের দুই বছরের মাথায় বিরাট ছাত্র আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগের মানিক ও তার ধর্ষক গ্রুপকে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কৃত ও বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে তার গ্রুপের ধর্ষকেরা আবার অস্ত্রের জোরে হল দখল করার দুই দিনের মাথায় পুলিশি সহায়তা সত্ত্বেও বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর পাশাপাশি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর গণধাওয়ার মুখে পলায়ন করে। দিনটা ছিল ২ আগস্ট। জাবির শিক্ষার্থীদের, বিশেষত মেয়েদের প্রবল প্রতিরোধের কারণে পরের দুই বছরও ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্জিত ও ধিকৃতই থাকে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এ রকম বিতাড়ন নব্বই দশকের পরের একমাত্র ঘটনা। আওরঙ্গ, প্রধান, লিয়াকত কিংবা অভিদের পরিণতিও ভালো হয়নি।
গত কয়েক দিনে যাঁরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের তাণ্ডব বইয়ে দিচ্ছেন, বামপন্থী ছাত্রকর্মীদের মারের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা হয়তো সাময়িকভাবে নেতৃত্বের পদ পাবেন। কিন্তু ইতিহাস জিগার আঠার মতো, এই কলঙ্ক তাদের ছাড়বে না।
গোঁফ দেখে বিড়াল চেনার মতো এখন অস্ত্র দেখে চেনা যায় কে কোন দলের ক্যাডার। দলীয় ক্যাডারদের ব্র্যান্ড এখন নানান জাতের অস্ত্র। ছাত্রলীগের রামদা-চাপাতি, ছাত্রদলের কাটা রাইফেল-পাইপগান, শিবিরের রগ কাটা ক্ষুর-কুড়াল। অস্ত্র যেখানে ঝনঝন করে, রক্ত যেখানে যখন-তখন যার-তার দেহ থেকে ঝরে, তখন ন্যায়নীতি-মনুষ্যত্ব কর্পূরের মতো উবে যায়। বলপ্রয়োগ যখন রাজনীতির উপায়, তখন সাধারণ ছাত্ররা নিরুপায়।
মিছিল না করার অপরাধে কনকনে শীতে মাঠের মধ্যে ঢাবির ৪৪ ছাত্রকে দাঁড় করিয়ে রাখা, ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে মার খেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ, গত জুন মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাপাতির কোপে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের পায়ের ও ঘাড়ের রগ কাটা, ২০১০ সালের জুলাই মাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া; দলের মধ্যে এবং দলের বাইরে কী করা বাদ রেখেছে ছাত্রলীগ!
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকেও বুঝতে হবে, এসিড পান করা যায় না। এই এসিড দলের ও সমাজের গলা-পেট-পাকস্থলী দিয়ে পোড়াতে পোড়াতে নামতে থাকবে, সঙ্গে নিয়ে যাবে জীবনীশক্তিটাও। ছাত্রলীগের ৬৪ বছর পূর্তির এই দিনে নববর্ষের এই সন্ত্রাসী উপহার হাতে নিয়ে এই কথা আমাদের বলতে হচ্ছে। আরব-ইউরোপ-আমেরিকায় তরুণেরা যখন অধিকারের জন্য লড়ছে, বাড়াচ্ছে জাতীয় গৌরব, তখন আপনাদের কাছে চাওযা একটাই: নিজেদের গৌরবটা অন্তত রক্ষা করুন। আজকের তরুণেরা মাথা হেঁট করে থাকতে রাজি নয়, ছাত্রাবাসগুলোয় খোঁয়াড়ের মুরগির মতো ‘কখন ধরবে, কখন মারবে’ এমন ভয়ে তটস্থ থাকাও সম্ভব নয়। দিন আপনারা না বদলান, মানুষ তাদের দিন বদলিয়ে নেবেই।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments