অরণ্যে রোদন-হিসাবটা মেলান দেখি! by আনিসুল হক
আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সেও। আমাদের বছর দুয়েকের ছোটই হবে। ভীষণ ভালো ছাত্র ছিল সে। বুয়েটের ছেলেরা সাধারণত ভালো ছাত্রই হয়। সে যে মেধাবী তার একটা প্রমাণ, সে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। এরপর সে বাংলাদেশ সরকারের চাকরি করছে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে। আমাদের পাড়ায় তাকে দেখলাম। কী ব্যাপার, তুমি এখানে। ও বলল, ‘টিউশনি করতে এসেছি। এখানে আমি
একটা বাসায় ছাত্র পড়াই।’ আমি বললাম, এখনো ছাত্র পড়াও? সে বলল, ‘কী করব আনিস ভাই, কয় টাকা বেতন পাই, বোঝেনই তো। ঘুষ খেতে না চাইলে আপনার চাকরির বাইরে কিছু একটা করতেই হবে।’ আমি একটু খোঁজখবর করলাম। ওর বেতন হাজার তিরিশেক টাকার মতো হতে পারে। দুটো বাচ্চা, স্ত্রী, গৃহপরিচারক মিলিয়ে পাঁচজনের সংসার হয়তো তার। বাড়িতে মা-বাবাকে টাকা পাঠানোর প্রশ্নই আসে না। ৩০ হাজার টাকায় তার সংসার কীভাবে চলবে। বাসাভাড়া কমপক্ষে ১৫ হাজার। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, টেলিফোন বিল, বাচ্চাদের স্কুলের বেতন—হাজার ছয়েক টাকা চলে যাবেই। বাকি নয় হাজার টাকায় সে খাবে কী, চলাচল করবে কী, কাপড়চোপড় কিনবে কী, আর যদি অসুখ-বিসুখ হয়, চিকিৎসার টাকা তার আসবে কোত্থেকে। একটা টেলিভিশন, একটা কম্পিউটার, একটা রেফ্রিজারেটর যদি সে কিনতে চায়, টাকাটা জোগাড় হবে কী করে?
আর বাচ্চাদের যদি কোচিংয়ে দিতে হয়, গিন্নি যদি একটা শাড়ি কিনতে চান?
আমি যার কথা বলছি, সে বুয়েট থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বেরিয়েছে। সে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলের সে একজন।
ঘুষ সে খাবে না, সুযোগ থাকলেও না, এটা আমি জানি। তাকে চলতে তো হবে।
আমার আরেক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। সেও বুয়েটেরই। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ঘুষ খাবে না বলে সে তার সরকারি চাকরির পোস্টিং নিয়েছিল তাদের কম্পিউটার সেন্টারে। যখন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, তখনো তার বাড়িতে কোনো গৃহপরিচারিকা ছিল না। তার স্ত্রী ঘর মোছেন শুনে আমি বললাম, ‘এই, তুমি কী বলো, এই শেষ পর্যায়ে এসে তিনি কেন ঘর মুছবেন!’ সে বলেছিল, ‘ছয় হাজার টাকা বেতন পাই। চার হাজার টাকা বাড়িভাড়া দিই। এখন তুমি হিসাব মিলিয়ে দাও, আমি মেইড রাখব কী করে।’
আমার বন্ধুটি একটা উপায় বের করল। সে সফটওয়্যারের কাজটায় খুব ভালো দক্ষতা অর্জন করল। এখন সে দারুণ আয় করে। ভালো আছে।
আমি যাদের মাসিক আয় নির্ধারিত, তাদের হয়ে তাদের কথা ভাবতে বসেছি।
মাত্র গতকাল শুনলাম আমাদের গ্রামের বাড়ির খবর। ধানের দাম কম, কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি। কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে।
প্রথম আলো ২ জানুয়ারি লিখেছে, ‘জ্বালানির অপর্যাপ্ততা ও উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে বিদায়ী বছর ভালো যায়নি। নিত্যপণ্যের বাজার ছিল বেসামাল, বাড়িভাড়া বেড়েছে লাগামহীন। গুপ্তহত্যার কারণে মানবাধিকার-পরিস্থিতিও ছিল উদ্বেগজনক। নতুন বছরে এসব নিয়ে কোনো বাণী নেই। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে মানুষকে আশার কথা শোনাতে চেয়েছিল সরকার। আগামী তিন বছরে বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে জেনে নতুন বছরের প্রথম দিনও উদ্বেগহীন হলো না।’
মুদ্রাস্ফীতি যে ঘটছে, সেটা সবাই জানে। জিনিসপাতির দাম বাড়ছে। বাড়ছে বাড়িভাড়া। বাড়ছে গাড়িভাড়া। বাড়ছে বিভিন্ন সার্ভিসের ভাড়া। এখন যে লোকটা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন পান, তিনি এই পাগলাঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে থাকবেন কী করে, টিকবেন কী করে?
বাংলাদেশে আপনারা যাঁরা অঙ্ক ভালো বোঝেন, তাঁরা দয়া করে হিসাবটা মেলান দেখি, সীমিত আয়ের মানুষজন এই বাজারে সংসারটা চালাবে কী করে?
তবুও বাংলাদেশের মানুষ যে টিকে আছে, তার কারণ, বেশির ভাগ মানুষই দুটো কিংবা তিনটা কাজ করেন। শেকসিপয়ারের ভাষায়, আমার মোমবাতির দুদিকেই আগুন জ্বলছে। এটা সারা রাত টিকবে না। আমরা আমাদের প্রাণশক্তি, আমাদের আয়ু—দুদিক দিয়েই জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমরা প্রত্যেকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করি। সরকারি অফিস থেকে বেরিয়ে লোকে আরেকটা চাকরিতে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যোগ্যতা অনুসারে কোচিং সেন্টার থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা এনজিওতে ছোটেন। কেউ বা হাতের কাজ করেন, কেউ বা হাতে বানানো পিঠা নিয়ে দোকানে যান এবং ছাত্ররাও কিছু না কিছু করে। টিউশনি করে, পার্টটাইম কাজ করে। পরিবারের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আয়ের চেষ্টা করে। কৃষক-শ্রমিকের পরিবারের ছোট্ট শিশুটি বাদাম বেচে, ফুল বেচে, গৃহকর্ম করে, দোকানে কাজ করে। বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির হিসাবে এক বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ ভাগ। তার মানে যে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে এক বছর আগে প্রতি মাসে, এ বছর তাকে ব্যয় করতে হচ্ছে সাত হাজার টাকার বেশি। এই টাকাটা তাকে হয় আয় করতে হবে, নয়তো তার বাজেট কমাতে হবে। প্রথম আলোয় খবর বেরিয়েছিল, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিচ্ছে, বেড়ানো বা কেনাকাটা করার মতো সামান্য শখগুলো তাদের বিসর্জন দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে কর্মসংস্থানের নতুন খবর নেই, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বাড়বে—এ ধরনের কোনো সুসংবাদ নেই; বরং কোনো কোনো দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা পণ্য হয়ে গেছে, টাকা দিয়ে শিক্ষা কিনতে হয়। স্বাস্থ্যও তা-ই। বাসাভাড়া বাড়ছে। গ্যাস, বিদ্যুতের নতুন সংযোগ দেওয়া স্বাভাবিক নিয়মে বন্ধ। ঢাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, সারা দেশেই যাচ্ছে। বস্তুত ১০ বছর পরে ঢাকায় পানি উঠবে কোন পাতাল থেকে, কে জানে।
পেটে খেলে পিঠে সয়। পেটে খাবার নেই, তবুও পিঠে কিলটি দেওয়ার গোসাঁইয়ের অভাব নেই। গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটছে। গুপ্তহত্যায় স্বজন হারানো একজন বিলাপ করে বলেছেন, ‘এর চেয়ে ক্রসফায়ার ভালো ছিল, অন্তত জানা যেত, লোকটা মারা গেছে।’ কিন্তু এ তো মহা অনিশ্চয়তা। যে দেশে বিনা বিচারে মানুষ মারার পরে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়, সে দেশে লোকেরা আইনের শাসনের ওপর আস্থা রাখবে কী করে! কাজেই চলছে গণপিটুনি। ডাকাত সন্দেহে নিরীহ তরুণদের হত্যা তো আমাদের শাসন-নীতিরই প্রতিক্রিয়া মাত্র এবং গুপ্তহত্যা যদি চলতে থাকে, তাহলে ভুয়া র্যাবের সংখ্যা বাড়বে, পুলিশ বা র্যাবের সোর্স পরিচয় দেওয়া প্রতারকদের সংখ্যাধিক্য দেখা দেবে, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক বা পারিবারিক দ্বন্দ্বে ক্রসফায়ার বা গুপ্তহত্যার মহৌষধ প্রয়োগের ঘটনা বাড়বে এবং অপরাধীরা এ-ওকে খুন করে গুপ্তহত্যা বলে চালিয়ে দেবে। সৃষ্টি হবে এক মহানৈরাজ্য। তার ওপর আছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-মাস্তানি। গানের অনুষ্ঠানে কে সামনে চলে এসেছে কিংবা বার্ষিক ভোজের আয়োজনের ত্রুটি বের করতে গেলি কেন, এ নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা চড়াও হচ্ছে সহপাঠীদের ওপর, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে, হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে আহত ছাত্ররা, কাগজে ছবি বেরিয়েছে।
এসব দুশ্চিন্তা, সমস্যা ও সংকট নিয়ে নববর্ষ এসেছে আমাদের দ্বারে। অথচ গত একটা বছরে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি, কোনো সন্ত্রাসী বোমা হামলা হয়নি, পাকিস্তানের চেয়ে সে সব দিক থেকে আমরা কত ভালোই না আছি। তাই বলি, আমাদের শোকর করতে হবে যে অবস্থা এর চেয়ে খারাপ হয়নি। রাজপথে মারামারি-হানাহানি সামনের বছর অবশ্যম্ভাবী, বিগত বছরে সরকার সেধে সেই পথ তৈরি করেছে। ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো লক্ষণও নেই। অথচ এই একটা ক্ষেত্রে সমাধানটা সরকারের জানা।
আমাদের কয়লাসহ বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করতে পারতেই হবে। আর আমাদের কূটনীতি হওয়া উচিত জনশক্তি রপ্তানিকেন্দ্রিক, প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণই হওয়া উচিত কূটনীতির প্রধান লক্ষ্য। সরকার অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য একটা সহজ পথ অবলম্বন করতে পারে। প্রবাসীদের জন্য একটা আবাসন প্রকল্প তৈরি করে প্রবাসীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করতে পারে। কিন্তু এ বড়ই টোটকা পদ্ধতি।
আসলে এই সরকারের প্রধান শত্রু তার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাকে আত্মম্ভর করেছে। তার যে স্বাভাবিক মিত্র ছিল, মিত্রদের মধ্যে যে বিশেষজ্ঞরা ছিলেন, তাঁদের সবাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে সরকার একলা পথ চলতে চেয়েছে এবং কখনো কখনো মিত্রদের শত্রুতে পরিণত করেছে। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই তো বেশি। তাদের মধ্যে যোগ্য, দক্ষ মানুষও প্রচুর। সরকার ভেবেছে তার কারও সহযোগিতার দরকার নেই। সে একলাই চলতে পারে।
এ অবস্থায় নতুন বছরের শুরুতে আশার কোন খবরটা আপনাদের আমরা দিতে পারি। একটা খবর দেখলাম। আমাদের সমুদ্র-অঞ্চলকে জলদস্যুতার অতিঝুঁকির তালিকা থেকে সম্প্রতি বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিনন্দন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments