আন্দোলন-বিএনপির অনেক লক্ষ্য by ফ. র. আল-সিদ্দিক

তাই তো জামায়াত ও বিএনপি মুখে যা-ই বলুক, মনে মনে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে তুলে দিক। মহাজোট সরকারের উচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তুলে না দিয়ে এমন একটি উপায় বের করা,


যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে শক্তিশালী এবং জনকল্যাণকর গণতন্ত্র বিনির্মাণের জন্য একটা হাতিয়ার এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে


জামায়াত ও বিএনপি অনেক দিন ধরেই বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছিল। কিন্তু সে আন্দোলনের জন্য তারা তেমন একটা জুতসই কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। যেসব কারণে জামায়াত ও বিএনপি আন্দোলন শুরু করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, এর একটি হলো যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং আরেকটি খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের বিচার।
জামায়াত ও বিএনপি চাইছিল এমন একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে, যাতে এ সরকারের পতন হয়। যার ফলে এ বিচারগুলোর কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়বেই। আর পরবর্তী নির্বাচনে তারা যদি সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে তো কেল্লাফতে! তখন দেখা যাবে, কে কোন অপরাধের বিচার করে!
কিন্তু জামায়াত-বিএনপির জন্য মুশকিল হয়েছে, আন্দোলন শুরু করতে চাইলেই তো হয় না। জনগণকে সেই আন্দোলনের পক্ষে শামিল করতে চাইলে, সেই আন্দোলনের যৌক্তিকতা বোঝানোর জন্য সরকারের কিছু খুঁত বের করতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কথা বলে অবশ্য তারা জনগণকে তাদের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু এ ইস্যুতে তারা জনগণকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ততটা উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। এর কারণ জনগণ দেখেছে, সব সরকারের আমলেই দ্রব্যমূল্যের কিছু না কিছু ঊর্ধ্বগতি হয়েই থাকে। তা ছাড়া বিগত জামায়াত-বিএনপি সরকারের আমলে কি দ্রব্যমূল্যের কম ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল? বরং এখনকার চেয়ে এ ঊর্ধ্বগতি তখন অনেক বেশি হয়েছিল।
এ কারণে দ্রব্যমূল্যের কথা বলে, শত চেষ্টা করেও জামায়াত-বিএনপি এ দেশে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলার মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারছিল না।
ঠিক এমনই সময়ে যেন অনেকটা আকাশ থেকে আন্দোলন করার পক্ষে একটা অজুহাত তাদের সামনে এসে পতিত হলো। সে অজুহাতটি সৃষ্টি হলো আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে এ দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেওয়া। এ রায়ের পরপরই আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে পদ্ধতিটি তুলে দিলে জামায়াত-বিএনপি বেশ খুশি হয়ে ওঠে। তখন তারা ভাবল, আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আরও একটা অজুহাত পাওয়া গেল।
এরপর জামায়াত ও বিএনপি তাদের আন্দোলনের প্রধান কারণ হিসেবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ইস্যুই বড় করে তুলে ধরতে শুরু করে। ওদিকে আসলে যে কারণগুলোর জন্য তারা আন্দোলন করতে চাইছে, সেগুলো তারা বলছেই না বা বললেও ক্ষীণস্বরে বলছে।
এখন মনে হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার দাবি জনগণের কাছে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। কারণ পদ্ধতিটি এ দেশের মানুষ অনেক আন্দোলন করে অর্জন করেছে। তা ছাড়া ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এ দেশে যে কয়টি সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কেবল একটি ছাড়া আর কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। আর সেটিও হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে মুসলিম লীগ শাসনামলে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময়।
বিএনপি আসলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চায়। প্রশ্ন উঠবে, এ পাখিগুলোর মধ্যে দুটির তো নাম পাওয়া গেল, যার একটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আরেকটি হলো খালেদা জিয়ার দুই ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগের বিচার। এ ছাড়া আরও পাখি আছে নাকি, যেগুলোকে বিএনপি তার একটি মাত্র ঢিল ছুড়ে মারতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, এ রকম ছোটখাটো পাখি তো অনেক আছে; কিন্তু সবচেয়ে বড় যে পাখিটা আছে, সেটা আপাতত দৃশ্যমান হচ্ছে না। সেটা দৃশ্যমান হবে কোনো একদিন জামায়াত-বিএনপি জোট আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে এলে। সে পাখিটির নাম হলো গণতন্ত্র।
সবাই জানে, জামায়াত ও বিএনপি দুটি দলেরই প্রধান শত্রু হলো গণতন্ত্র। তাই সুযোগ পেলেই এ দল দুটি গণতন্ত্রকে সমূলে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করবে। তাই মহাজোট সরকার যদি আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে তুলে দেয়, তাহলে জামায়াত-বিএনপি সরকার যখন আবার ক্ষমতায় আসবে, তখন তাদের পক্ষে এ দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা আরও সহজ হয়ে পড়বে।
তাই তো জামায়াত ও বিএনপি মুখে যা-ই বলুক, মনে মনে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে তুলে দিক। এরপর তারা আবার যখন সরকার গঠন করবে তখন তারা এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করবে, যাতে আওয়ামী লীগ আবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়।
মহাজোট সরকারের উচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তুলে না দিয়ে এমন একটি উপায় বের করা, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে শক্তিশালী ও জনকল্যাণকর গণতন্ত্র বিনির্মাণের জন্য একটা হাতিয়ার এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।

ফ. র. আল-সিদ্দিক : পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
 

No comments

Powered by Blogger.