রাজনীতি-মিছিলে ধর্মগ্রন্থ ও শিশুদের ব্যবহার কেন? by মশিউল আলম

কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে বা মাথায় বেঁধে বিক্ষোভ মিছিল করা এ দেশে নতুন নয়। রাজনীতির ময়দানে যাঁরা এই কৌশলটি প্রয়োগ করেন, তাঁরা দেখাতে চান যে দাবি আদায়ের সংগ্রামে তাঁরা প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। প্রাণ দিয়ে হলেও দাবি আদায় করে ছাড়ব—এই তাঁদের বার্তা।
কিন্তু তাঁরা যখন মিছিলে যান পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে, তখন তার কী মানে হয়? এভাবে তাঁরা সরকারকে, জনগণকে, এমনকি নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের কী বার্তা পৌঁছাতে চান?
যাঁরা নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করতে গিয়ে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই সঙ্গে কাঁধে করে এনেছিলেন নাবালক শিশুদের, তাঁদের কাছে এসবের কী ব্যাখ্যা আছে জানি না। তাঁদের সত্যিকারের মনের কথাটা হয়তো জানা সম্ভবও নয়। তাঁরা তো রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক কলাকৌশলের গূঢ় উদ্দেশ্য-অভিসন্ধিগুলো তাঁরা জনগণকে জানতে দিতে চান না। কয়েক দিন ধরে একটু একটু করে কথা বলার চেষ্টা করলাম সাধারণ মানুষের সঙ্গে। পথে-ঘাটে, দোকানে, বাজারে—যখন যেখানে যেটুকু সুযোগ মেলে। এমন একজন মানুষেরও দেখা পেলাম না, যিনি মিছিলে পবিত্র কোরআন বা শিশুদের নিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করেন।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে গেলাম বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায়। ছোটখাটো একটা জরিপের মতো চালিয়ে দেখা যাক। লোকবল মাত্র এক। তাই এটাকে সেই অর্থে জনমত জরিপ বলে দাবি করা ঠিক হবে না। মাত্র দেড় দুই ঘণ্টায় কজন মানুষের মতামত সংগ্রহ করা সম্ভব!
বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় টুপি, তসবি, জায়নামাজ ইত্যাদি বিক্রি হয় যেসব দোকানে, প্রথমে গেলাম সেই সারিতে। তাঁরা আমাকে খদ্দের ভাবলেন, একটি দোকানে আমি নিজের সাংবাদিক পরিচয়টুকু জানালাম। ‘কী জানতে চান?’ জিজ্ঞাসা করলেন সেই দোকানের দুজন বিক্রেতার একজন। মধ্যবয়সী পুরুষ, মাথায় সাদা গোল টুপি, পরনে হলদে পাঞ্জাবি, কপালে নিয়মিত নামাজ পড়ার দাগ। মিছিলে পবিত্র কোরআন বহনের প্রসঙ্গটি তুললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন, ‘না না, এইটা ঠিক না। উচিত না। মিছিলের মধ্যে কেন কোরআন নিয়ে যাবে?’ তাঁর পাশের যুবক, তাঁর মাথায় টুপি নেই, কিন্তু কপাল দেখে বোঝা যায় নিয়মিত নামাজ পড়েন, তিনি বললেন, ‘আগে তো কখনো শুনি নাই যে মিছিলে কোরআন নিয়া যায়। এবারই প্রথম দেখলাম। ঠিক করে নাই উনারা।’ সারি ধরে এগিয়ে গেলাম, একের পর এক দোকানিদের সঙ্গে কথা চলল একই প্রসঙ্গে।
ঘড়ি মেরামতির এক দোকানে কথা শুরু করলে দোকানি বললেন, ‘আমি কিছু জানি না, কিছু বুঝি না। মুরুখকু মানুষ।’ উল্টো দিকের সারিতে কয়েক দোকান পরের এক দোকানের দিকে আঙুল তুলে তিনি বললেন, ‘ওই মুরব্বিরে জিগান, উনি বলতে পারবে।’ সেই মুরব্বির সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। মুখভর্তি মেহেদিরাঙা দাড়ি, গোঁফ সযত্নে ছাঁটা, মাথায় টুপি, পরনে আলখাল্লার মতো সাদা পাঞ্জবি। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, ‘মানুষ তো খারাপ হয়ে গেছে। দিন দিন আরও বেশি খারাপ হয়ে যাইতেছে।’ মনে হলো, তিনি আমার প্রশ্নটির উত্তর সরাসরি দিতে চান না। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোরআন শরিফ নিয়ে মিছিল করা কি আপনি সমর্থন করেন?’ কিন্তু মুরব্বি আগের সুরেই বলে চললেন, ‘পুলিশের সঙ্গে মারামারি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, গোলাগুলি, বোমাবাজি, টিয়ার গ্যাস—মিছিলে কত কিছু হয়, হয় না? ওই দিন আমি মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলাম, ওরে বাপরে, টিয়ার গ্যাসের গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, দৌড়ে বার হয়া আসলাম। নামাজটা আর ওখানে পড়তেই পারলাম না। ইয়ামেনি মসজিদে গিয়া পড়লাম।’
আরেক দোকানে একজন বললেন, ‘কোরআনবিরোধী আইন করলে মিছিল তো হবেই। পুলিশ বাধা দেয় ক্যান?’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোরআনবিরোধী আইন হয়েছে আপনি কোথায় শুনলেন?’ তিনি বললেন, ‘পেপারে লেখতেছে, টিভিতে কইতেছে, ওয়াজ মাহফিলে আলেমরা কইতেছে।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘কোনো আইন হয়নি, একটা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে, নীতি আর আইন এক জিনিস নয়।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনে কোন পেপারের লোক?’ আমি আমাদের সংবাদপত্রের নাম বললাম। তিনি বললেন, ‘আপনারা তো সব খবর ঠিকমতো লেখেন না।’ আমি জানতে চাইলাম, কোন সংবাদপত্র সব খবর ঠিকমতো লেখে। তিনি দুটি দৈনিক সংবাদপত্রের নাম বললেন। আমি বললাম, ‘পত্রিকা দুটি যদি লিখে থাকে সরকার কোরআনবিরোধী আইন করেছে, তাহলে মিথ্যা লিখেছে। যে বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা হলো নারী উন্নয়ন নীতি। এই নীতিতে বলা হয়েছে, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া, চিকিৎসা এসব ক্ষেত্রে মেয়েদেরও পুরুষের মতো সমান অধিকার থাকবে।’ তিনি আপত্তি করে বললেন, ‘তা কেমনে হয়? পুরুষ আর মহিলা সমান? এটাই তো ইসলামবিরোধী কথা।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘এই মত আপনি সমর্থন করতে না পারেন, কিন্তু ইসলামে কোথাও বলা নেই, নারী আর পুরুষ সমান হতে পারবে না। শুধু উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ছেলেসন্তান যা পাবে, মেয়েসন্তান পাবে তার অর্ধেক। নারীনীতিতে এই বিষয়ে কোনো কথাই বলা হয়নি। তার মানে, যেমন আছে তেমনই থাকবে। উত্তরাধিকারের সম্পত্তির ভাগ মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেকই পাবে।’ তিনি আর কিছু বললেন না। তবে তাঁর মুখ দেখে মনে হলো না তিনি আমার কথাগুলো শুনে সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, আপনার কথা যদি ঠিকও হয়, তবু কোরআন শরিফ আর শিশুদের নিয়ে রাস্তায় মিছিল করা কি আপনি সমর্থন করেন?’ তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘এইটা কেউই সাপোর্ট করবে না।’
মোট ৩৫ জনের সঙ্গে কথা বললাম। দোকানদার, ক্রেতা, পথচারী, রিকশাচালক ও হকার। একজনকেও পাওয়া গেল না যিনি মিছিলে কোরআন ও শিশুদের ব্যবহার করার রাজনৈতিক কৌশলটাকে সমর্থন করেন। মসজিদের মূল ফটকের সামনের চত্বরে পথচারী একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কৌশলটি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: ‘পেপারে মাঝেমধ্যে খবর পাওয়া যায়, বিদেশে কিছু লোক দাবি আদায়ের জন্য অস্ত্র, বোমা এইসব নিয়ে ইশকুলের বাচ্চাদের জিম্মি করে। আল্লার কালাম নিয়ে মিছিল করা সেই রকম একটা অপকৌশল। মুসলমানের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে জিম্মি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা। পুলিশের সঙ্গে মারামারি লাগবে, পবিত্র কোরআন শরিফ রাস্তায় পড়ে যাবে, পেপারে সেই ছবি ছাপা হবে, টিভিতে দেখা যাবে। লোকে বলবে, দ্যাখো দ্যাখো সরকার কত খারাপ।’ একটু থেমে বললেন, ‘তারা মসজিদের মধ্যে লাঠিসোঁটা, ইটপাটকেল জড়ো করে রাখে। মসজিদ থেকে মিছিল বের করে পুলিশের সঙ্গে মারপিট বাধায়, পুলিশ তাদের ধাওয়া করতে করতে মসজিদের ভেতরে ঢুকে পড়ে। সাধারণ মানুষ নামাজ পড়বে কী? জানের ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। জিম্মি, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার রাজনীতি...।’
একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, যত জনের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রত্যেকেই শুনেছেন বা সংবাদমাধ্যমে জেনেছেন যে সরকার ইসলামবিরোধী আইন করেছে। যে নারীনীতি নিয়ে এত কথা, সেটির প্রধান বক্তব্যগুলো সম্পর্কে প্রায় কেউই জানেন না। কিছু ধর্মভিত্তিক দল ও গ্রুপ প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-সমাবেশের বক্তৃতায় বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পাড়ায়-মহল্লায় ওয়াজ মাহফিলগুলোতেও বিভ্রান্তিকর অনেক কথা বলা হচ্ছে। কোনো কোনো ধর্মীয় বক্তা সংবিধান, সংসদ, আদালত—সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অন্যদিকে নারীনীতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানানোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কয়েক দিন আগে ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন, ঘোষিত নারীনীতির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে এখন ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝানো উচিত।
কিন্তু ক্ষমতাসীন দল, তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো যেন এ বিষয়ে নির্বিকার। তাদের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর আসছে তাতে মনে হয়, তারা দলের ওপর ভর করে ব্যক্তিগত ভাগ্যোন্নয়নেই বেশি ব্যস্ত।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.