ক্ষতিপূরণের দাবিতে সড়ক অবরোধ-যশোরে হাইব্রিড ধানের বীজে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক!

হাইব্রিড ধানের বীজ ব্যবহার করে যশোরের তিন শতাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ক্ষতিপূরণের দাবিতে কৃষকেরা গতকাল শনিবার অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে কৃষকেরা যশোর সদর উপজেলার বারীনগর বাজারে যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক অবরোধ করেন।


এ সময় কৃষকেরা সড়কের ওপর কাঠের গুঁড়ি ফেলে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান। এতে সড়কের দুই দিকে অন্তত ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত অসংখ্য যানবাহন আটকা পড়ে। পরে বেলা একটার দিকে যশোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুর রউফ ও কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফ হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলে কৃষকেরা অবরোধ তুলে নেন।
কৃষকেরা অভিযোগ করেন, তেজ, ঝলক, মধুমতী নামের ধানবীজ ব্যবহার করে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আকিদুল ইসলাম বলেন, তিনি ১৮ বিঘা জমিতে তেজ ধানবীজ ব্যবহার করেছেন। তাঁর ধানের ৮০ শতাংশ চিটা হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা আবদুর রউফ বলেন, বীজের কারণে বোরো আবাদে চিটা হলে সরকারের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে কোনো কোম্পানি কৃষকদের কাছে নিম্নমানের ভেজাল বীজ বিক্রি করে প্রতারণা করতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল যশোর সদর উপজেলার নওদা গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড) ধানের গাছে যে শিষ বের হয়েছে, তা দেখতে অনেকটা সাদাটে।
কৃষক আমিরুল ইসলাম বলেন, তিনি চার বিঘা জমিতে উচ্চফলনশীল ধানবীজ তেজ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁর সব ধান চিটা হয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় তাঁর খরচ হয়েছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু এখন খড় ছাড়া আর কিছুই ঘরে যাবে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর কার্যালয় থেকে ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক শেখ হেমায়েত হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, মাঠে বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ধান, বিশেষ করে তেজ, ঝলক, মধুমতী নামে বাজারজাত করা ধানে শিষ বের হওয়ার পর কিছু কিছু এলাকায় সেসব সম্পূর্ণ শিষ চিটা হয়ে গেছে। কৃষকদের এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ধান বিশেষজ্ঞদের মাঠ পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হলো।
এ ব্যাপারে উপপরিচালক হেমায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের অন্তত ৩০০ কৃষকের মোট ১০৬ হেক্টর জমির ধান চিটা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ৪ এপ্রিল রাত আটটা থেকে সোয়া নয়টা পর্যন্ত যশোরের ওপর দিয়ে যে ঝোড়ো বাতাস বয়ে যায়, ওই বাতাসের তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরাগায়ন ঘটার আগমুহূর্তে এ ধরনের গরম বাতাস বয়ে যাওয়ায় ঠিকমতো পরাগায়ন ঘটেনি, যার জন্য চিটা হতে পারে।
শুকিয়ে যাচ্ছে মধুমতীর শিষ!: যশোরের অভয়নগর উপজেলার কালিশাকুল গ্রামের ভবেশ হালদার এবার ২২ কাঠা জমিতে উচ্চফলনশীল ধান মধুমতী-২ চাষ করেছেন। ধানের গাছ হয়েছে ভালো। শিষও বেরিয়েছে অনেক বড়। কিন্তু ভবেশ হালদার বলেন, একটি ধানও তিনি ঘরে তুলতে পারবেন না। কারণ, শিষ শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভবেশের মতো উপজেলার শতাধিক কৃষক মধুমতী-২ ধান চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলা উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুরোনো বীজ থেকে এ রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগে ধানগাছের কাণ্ড শুকিয়ে যায় এবং গাছ কোনো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। ফলে ধানের শিষ বের হয় ঠিকই, কিন্তু চাল আসে না। রোগ দেখা দিলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেও খুব বেশি কাজে আসে না।’
সূত্র জানায়, উপজেলায় এবার প্রায় ৫০০ বিঘা জমিতে মধুমতী-২ ধানের চাষ হয়েছে। এ পর্যন্ত শতাধিক বিঘা জমিতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। দিনের পর দিন বাড়ছে আক্রান্ত জমির পরিমাণ।
কালিশাকুল গ্রামের কৃষক হরিদাস বিশ্বাস বলেন, ‘আমার আড়াই বিঘা জমির ধান সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে।’
মধুমতী-২ ধানবীজের বিক্রয় প্রতিনিধি আবদুল লতিফ বলেন, ‘আমি খেতে ঘুরে দেখেছি, ধানের বেশ ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টি আমদানিকারককে জানিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে তিনি চীনের ওই বীজ কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। চীন থেকে কোম্পানির একটি দল শিগগিরই সরেজমিনে আসবে। তারাই কৃষকদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধুমতী-২ জাতের ধান চাষ করে কৃষক খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’

No comments

Powered by Blogger.