গাজীপুরে স্থবির কলকারখানা by শরীফ আহ্‌মেদ শামীম

গাজীপুর সদরের মালেকের বাড়ি শিল্প এলাকার রপ্তানিমুখী স্ট্যান্ডার্ড সিরামিক কারখানার দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৩ টন। গ্যাসের অভাবে মেশিন চালাতে না পারায় বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন কমে গেছে ২৫ ভাগ। কারখানার জেনারেল ম্যানেজার মো. ফরিদ উদ্দিন জানান, আট পিএসআই চাপের মধ্যে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্যাসের


চাপ তিন-চার পিএসআইয়ে ওঠানামা করে। এ কারণে তিন 'কিলইন ফার্নেস' মেশিন একসঙ্গে চালানো যাচ্ছে না। লোডশেডিংয়ের কারণে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৫-১৬ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে না। এসব কারণে মান নষ্ট হয়ে সার্বিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। এতে ৩০ ভাগ ক্ষতির মুখে পড়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তিনি জানালেন, দেশের সিরামিক কারখানার ৯৫ ভাগই গাজীপুরে। সব কারখানাতেই চলছে এমন অচলাবস্থা।
কালিয়াকৈরের সফিপুরে রয়েছে যমুনা গ্রুপের শামিম স্পিনিং, যমুনা নিটিং ডাইং অ্যান্ড গার্মেন্ট, যমুনা স্পিনিং ও শামিম কম্পোজিট কারখানা। এসব কারখানায় সাত পিএসআইয়ের স্থানে দুই-তিন পিএসআই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান শামিম স্পিনিংয়ের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) মোহাম্মদ হোসেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, গ্যাসের অভাবে সব জেনারেটর চালু করা যায় না। তাই এক ইউনিট বন্ধ রেখে অন্য ইউনিট চালিয়ে কারখানা চালু রাখা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রমিকের উৎপাদন মজুরিও কমে গেছে। এতে শ্রমিকদের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে। জানানো হলেও তিতাস গ্যাস কিছুই করতে পারছে না, বরং সমস্যা প্রকট হচ্ছে।
একই উপজেলার চান্দরা শিল্প এলাকার অ্যাপেক্স হোল্ডিংয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজুল মোমিন কাদরী জানান, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সংকট চলছে কালিয়াকৈরে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই এলাকায় ২০ ঘণ্টাই গ্যাস পাওয়া যায় না। তাঁদের গ্রুপের অ্যাপেক্স স্পিনিং অ্যান্ড নিটিং, অ্যাপেক্স ইয়াং ডাইং ও অ্যাপেক্স টেক্সটাইল প্রিন্টিং মিলে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ প্রয়োজন। এখন চাপ পাওয়া যায় এক পিএসআই। উৎপাদন ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে কয়েক মাস আগে ছয় মেগাওয়াটের ডিজেল জেনারেটর বসানো হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ আট থেকে ১০ গুণ বেড়ে গেছে। তিনি জানালেন, একদিকে গ্যাস নেই, অন্যদিকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের মূল্য দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। এতে কারখানার মালিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাঁর মতে, দ্রুত গ্যাস সমস্যার সমাধান না হলে অনেক মালিকের কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
কারখানা মালিক ও কর্মকর্তারা জানান, শুধু এসব কারখানাতেই নয়, গ্যাস সংকটের জন্য কালিয়াকৈরের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার ইন্টারস্টফ টেক্স, ডিভাইন টেক্সটাইল, চন্দ্রার নুরুল ওয়্যার, নায়াগ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ ডেনিমস, ফারইস্ট, ফেয়ারট্রেড, নিটএশিয়া, সাদমা ফ্যাশন, করতোয়া স্পিনিং মিল, জমজম স্পিনিং মিল, বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম, এমএসএ স্পিনিং, লিবাস টেক্সটাইলসহ শত শত কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
নিটএশিয়ার শ্রমিক এবাদদ হোসেন (২৮) জানান, এ কারখানায় শ্রমিকদের বেতন উৎপাদনের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। পুরোমাত্রায় কাজ চলাকালে তিনি ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা মজুরি পেতেন। কিন্তু গ্যাস সংকটে কাজ কমে যাওয়ায় এখন পাচ্ছেন সাত-আট হাজার টাকা। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যসহ সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, গ্যাস না থাকায় চুলা না জ্বলায় বাসায় ফিরে রান্নাও করা যাচ্ছে না। অনেকে চড়া দামে লাকড়ি ও কেরোসিন কিনে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছে।
জানা গেছে, গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে টঙ্গী শিল্প নগরীর কলকারখানাও। ওই এলাকার আবাসিক গ্রাহকরাও গ্যাস সংকটে পড়েছেন। অনেক এলাকায় রাত ১০টার পর ছাড়া চুলা জ্বলে না। এসব নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে চলছে তীব্র অসন্তোষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টঙ্গী ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন প্রকৌশলী জানান, গ্যাস সংকটের কারণে কেন্দ্রটির সব ইউনিট চালু করা যাচ্ছে না। একটি ইউনিট চালু করে কেন্দ্র থেকে মাত্র ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।
টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরী কারখানা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং সেলিম রাবার ও প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় গ্যাস সংকটের কারণে শত শত কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন চালানো যাচ্ছে না। ডিজেল দিয়ে উৎপাদন চালু রেখে অনেকেই লোকসান গুনছেন। তিনি দ্রুত এ সংকট সমাধানের দাবি করেন।
সরেজমিনে ঘুরে এবং জয়দেবপুর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন আঞ্চলিক বিপণন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, টঙ্গী ও কালিয়াকৈর ছাড়াও গাজীপুর সদরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, মির্জাপুর, ভোগড়া, বাসন ও গাছা এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকটে উৎপাদন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এসব এলাকার তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, স্পিনিং, নিট কম্পোজিট, ওষুধ, সিরামিক, লেদার, রি-রোলিংসহ সাত সহস্রাধিক বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান রয়েছে। উৎপাদন ও মজুরি কমে যাওয়ায় মালিক ও শ্রমিক উভয়ের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। রপ্তানিমুখী বড় বড় প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলেও ছোট কারখানার মালিকদের বিনিয়োগ হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস কম্পানির প্রধান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) প্রকৌশলী রানা আকবর হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ঘোড়াশালের দুটি এবং আশুগঞ্জের একটি সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। তিনি জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গাজীপুরে গ্রিডে ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। নতুন স্থাপিত ধনুয়া গ্রিড লাইন এ মাসেই চালুর কথা রয়েছে। এ লাইন চালু হলে দৈনিক কমপক্ষে আরো ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ হবে। এতে সমস্যার সমাধান হবে।

No comments

Powered by Blogger.