সামাজিক যোগাযোগ-ব্যক্তি, বিচ্ছিন্নতা ও ফেসবুক by জুনান নাশিত

সেদিন আমার এক আত্মীয় ভদ্রলোক বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, ‘টিভি, মোবাইলের অত্যাচারেই বাঁচা দায়, তার ওপর ফেসবুক! ছেলেমেয়ে দুটো যে ওতে কী পায় বুঝি না! কেবল ফেসবুক নিয়ে সময় কাটায়।’ আমি ওনার কথায় একটু বিব্রত হলাম। কারণ, আমি নিজেও একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী।
এ তো গেল আমার আত্মীয় ভদ্রলোকের কথা। অফিসে, আড্ডায়ও ফেসবুক ভালো কি মন্দ এ নিয়ে মুখর তর্কে মেতে উঠতে দেখি অনেককেই। এসব কারণে আমার মতো যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—জাগা স্বাভাবিক—সত্যিই কি ফেসবুক আমাদের জীবনে আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে? ফেসবুক কি কেবল আমাদের মূল্যবান সময়ই ধ্বংস করছে?
বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের জীবন যে এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, এ কথায় কারও সম্ভবত দ্বিমত থাকার কথা নয়। বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে পরিবার থেকে। বিচ্ছিন্ন হচ্ছে সমাজ থেকে, এমনকি নিজের সত্তা থেকেও। যৌথ পরিবারপ্রথা ভেঙে পড়ছে। বাড়ছে নিউক্লিয়ার পরিবার। বিকল্প পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিচ্ছিন্নতা নানা ধরনে এবং নানা কারণে আমাদের গ্রাস করছে। বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা। বাড়ছে জীবনবিমুখতা। আর জীবনবিরোধিতা সহজেই নানা ধরনের ব্যক্তিক ও সামাজিক অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নতা আমাদের আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপরও করে তুলছে। তৈরি করছে দূরত্ব। আর দূরত্ব তৈরি করছে অনান্তরিকতা। আন্তরিকতাহীন মানুষ বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয় অতি সহজে। এতে করে বাড়ে হিংস্রতা। বাড়ে হানাহানি। হানাহানি নতুন করে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। মানুষ ডুবে যায় নৈঃসঙ্গের অন্ধকার ভুবনে। নিঃসঙ্গ মানুষ ক্ষয়ে যায় অনবরত। ক্ষয়িষ্ণু জীবন তাকে খণ্ডিত চেতনায় ডুবিয়ে দেয়। সে তখন আর মহত্ত্বকে বড় কিছু ভাবতে পারে না। ক্ষুদ্রত্বের সীমাকেই জীবন ও গন্তব্য বলে ভেবে নেয়। আর এ ক্ষুদ্রত্বের সীমা বাড়িয়ে দেয় সীমাহীন দ্বিধাবিভক্তি; পথ ও মতের পার্থক্যকে করে প্রসারিত। তাই একক বিশ্বে মানুষ আজ শতধাবিভক্ত। যদিও পৃথিবী আজ অনেক বেশি একক ও অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু মানুষ বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়েছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
আমাদের জীবনে আছে হরেক রকম ব্যস্ততা। কি সকাল কি সন্ধ্যা, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে হয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে পিষ্ট হতে হতে আমরা ভুলতে বসি বন্ধুর মুখ। আতিথেয়তার কোমল সম্ভাষণে মনকে সিক্ত করার মতো ফুরসত আজ আমাদের কতটুকু আছে? এ বাস্তবতায় আমি আমার নিজের কাছে করা নিজের প্রশ্নের সহজ সমাধান খুঁজি। বলতে দ্বিধা নেই, সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ফেসবুক আমাদের বিচ্ছিন্ন জীবনপ্রবাহকে কিছুটা হলেও অবিচ্ছিন্নতার সূত্রে গাঁথতে সমর্থ হয়েছে। এ কথায় আমার ওই আত্মীয় ভদ্রলোকটির মতো অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন, আমি জানি। কিন্তু তাঁদের আশ্বস্ত করে বলতে পারি, আসলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে হু হু করে। দিন দিনই তা বাড়ছে। অগণিত লোক আজ মোবাইল ফোনের গ্রাহক। এরও কি নেতিবাচক দিক নেই? আছে। তা সত্ত্বেও মানুষ এর ভালো দিকটিই গ্রহণ করেছে। তেমনি ক্রমবিচ্ছিন্ন মানুষ ফেসবুককেও সঙ্গী করে নিতে দ্বিধা করছে না। যদিও এ দেশে এর প্রসার এখনো ততটা নয়, কিন্তু এর ব্যবহার বাড়ছে। বিশ্বে এখন ৫০ কোটির বেশি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেই ব্যবহারকারীর এ সংখ্যা ৭০ শতাংশ। ফেসবুকে যারা সক্রিয়, তাদের ২০ কোটি মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে ফেসবুক ব্যবহার করে। সুতরাং, বাংলাদেশেও এর ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটবে নিঃসন্দেহে।
যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক টুইটারসহ অন্যান্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। মাধ্যমটি যত জনপ্রিয়, তত এর সমালোচনাকারীর সংখ্যাও। পক্ষে যেমন মত পাওয়া যাবে ঢের, তেমনি বিপক্ষে বলার লোকেরও অভাব নেই। অনেকেই বলেন, ফেসবুক দাম্পত্য জীবন থেকে শুরু করে নানা সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু এ দোষে কি কেবল ফেসবুকই দুষ্ট? সব প্রযুক্তিরই যেমন ভালো দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে মন্দ দিক। ভালো-মন্দের বিষয়টি নির্ভর করে এর ব্যবহারকারীর ওপর। কে কেমন করে ব্যবহার করছে, তার ওপর। আর কোনো কিছু ব্যবহারে যে সচেতনতা বাঞ্ছনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে ফেসবুকের বিরোধিতা করে কী লাভ? আমরা অন্ধ হলেই কি আর প্রলয় বন্ধ থাকবে?
আধুনিক জীবনে দ্রুত ও সহজলভ্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফেসবুক অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বহু দূরের কোনো বন্ধু কিংবা আত্মীয়ের সঙ্গে মুহূর্তে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি। আমরা সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত হচ্ছি। আনন্দ, দুঃখ, বেদনা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করার সুযোগ পাচ্ছি; জীবনে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিংবা দীর্ঘদিনের যোগাযোগহীনতায় যে বন্ধুটিকে আমরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি, তাকেও ফেসবুকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হতে পারছি। নিরাশার দোলাচলে দুলতে থাকা এ জীবনে এটা খুব একটা কম পাওয়া বলে আমার মনে হয় না। এ ছাড়া ইদানীং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ফেসবুকের ইতিবাচক ব্যবহারের খবর আমরা হামেশাই পাচ্ছি। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মধ্যপ্রাচ্যের গণবিপ্লব এবং জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামির কথা; যেখানে দুর্যোগ-দুুর্বিপাকে মানুষ ফেসবুককে আশার আলো হিসেবে ব্যবহার করছে। আমি আগেই বলেছি, যেকোনো বিষয়েরই ভালো ও মন্দ দিক রয়েছে। কিন্তু আমরা কেন মন্দের কথা ভেবে ফেসবুকের ভালো দিকটা অবজ্ঞা করব? কেন নিজেদের বঞ্চিত করব প্রযুক্তির আধুনিক সিঁড়িতে পা রাখার সুবর্ণ সুযোগ থেকে?
জুনান নাশিত: কবি ও সাংবাদিক।
nashit_junan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.