ভয়ংকর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি by শাহজাহান মিয়া
অবস্থা ভয়াবহ। ভয়ংকর। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লোডশেডিং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। দিনে-রাতে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং। এলাকাভেদে কোনো কোনো জায়গায় আরো বেশি। জনজীবন একেবারে পর্যুদস্ত। বিদ্যুতের তাণ্ডবের সঙ্গে পানি ও গ্যাস সংকট রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের অধিবাসী ও সারা দেশের
জনগণের এখন নিত্যসঙ্গী। অনেক জায়গায় আবার বিদ্যুৎ থাকলে গ্যাস নেই, গ্যাস থাকলে পানি নেই। শহর-নগর-বন্দরসহ সারা দেশে প্রায় একই চিত্র। তীব্র দাবদাহে মানুষের ভোগান্তি ছাড়াও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ঘটছে বিঘ্ন। ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের দুর্দশার সীমা নেই। সারা দেশে ৯ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থীর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি শেষ করতে অনেককে মোমবাতি জ্বালিয়েই পড়তে হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালে বিদ্যুৎ থাকবে কি না, সে কথা চিন্তা করেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। স্বাভাবিক তীব্রতা নিয়ে গ্রীষ্মকাল স্বরূপে আবির্ভূত হওয়ার আগেই বিদ্যুতের এ অবস্থা ভোক্তাদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে অব্যাহতভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ শেষ পর্যন্ত এমন গুরুতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা চিন্তাই করেনি। তদুপরি সরকারের তরফ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নতি হওয়ার কথা শুনে জনগণও আশান্বিত হয়ে উঠছিল। কিন্তু দিন দিন পরিস্থিতির ক্রমাবনতি দেখে তারা আশাহত।
নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুযায়ী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়। দেশের বিরাজমান মারাত্মক বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে গত তিন বছরে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সমর্থ হয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট অর্জন। গত কয়েক মাসে দেওয়া ২০ লাখ নতুন সংযোগেও অনেক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। গত ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে মোট ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসহ আরো তিনটি অনুরূপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সার্বিকভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু উন্নতি না হয়ে বরং উল্টো অবনতি ঘটছে। লোডশেডিংয়ে নাকাল হচ্ছে দেশবাসী। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কল-কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। জনগণ জানে যে বছরের এই সময়ে ইরি-বোরো চাষে সেচকাজ নিশ্চিত করতে শহরে লোডশেডিং বৃদ্ধি করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। এ মর্মে সেচ মৌসুম শুরুর আগে সরকারি ঘোষণাও হয়। মানুষ বিষয়টিতে অভ্যস্তও হয়ে পড়েছিল। গত বছরও অবস্থা তেমন অসহনীয় ছিল না। এবার যে অবস্থা এতটা মারাত্মক হবে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। ইরি-বোরো ধানের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানেও সেচকাজের জন্য কৃষকরা ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তাই শুধু বিরোধী দলই নয়, জনগণের মনেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অবশ্য হাতের কাছে মওকা পেয়ে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী-সমর্থকরা এ খাতে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে নানারূপ বিরূপ মন্তব্য করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। অবশ্য সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলার আগে তাঁরা বেমালুম ভুলে যান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন হয়নি। জোট সরকারের পাঁচ বছরে লাখ পাঁচেক খাম্বা কিনে বসানো হয়েছিল বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরার জন্য। বহুল আলোচিত-সমালোচিত ওই খাম্বাগুলো এখনো হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, যা দেখে গ্রামগঞ্জের মানুষ হাসাহাসি করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস উৎপাদন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন গ্যাসভিত্তিক। বর্তমানে গ্যাস সংকটও একটি বাস্তবতা। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা। উপরন্তু ছোট আকৃতির এবং জ্বালানি তেলচালিত এসব কেন্দ্রে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রচুর জ্বালানি তেলের অপচয়ও হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে ভাড়াভিত্তিক এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে প্রায় ১২০ কোটি টাকার জ্বালানি তেল বেশি ব্যবহার করেছে। এগুলোর জন্য বেশি পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয় বলে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এ কারণেই আবারও বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। বর্তমান সরকারের আমলে এ নিয়ে মোট পাঁচবার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সার্বিকভাবে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে। কল-কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে অবধারিতভাবে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়বে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না করে বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ধরে নিলাম, সরাসরি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বা তাদের দুঃখ-দুর্দশার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এমন কোনো কাজ করার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনবিচ্ছিন্ন উপদেষ্টাদের ওই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, প্রকৃত অর্থেই জনদরদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এবং জনস্বার্থ রক্ষায় বিশেষভাবে সদা সতর্ক ও সজাগ, তিনি বিদ্যুৎ সেক্টরে বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে এটা বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় জনগণ হতাশ হয়েছে। বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে পর পর দুই মাসে দুবার মূল্য বৃদ্ধিতেও হয়তো কেউ তেমন আপত্তি করত না বলেই সবার ধারণা। কিন্তু ব্যাপারটি হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। লোডশেডিংয়ের জ্বালায় জ্বলেও বাড়তি পয়সা দিতে হবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে! বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলেই মানুষের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বলা হলেও বিদ্যুৎ চুরি বা এর অপব্যবহার রোধে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই বলে এ বিষয়টিতেও জ্বালানি উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো তৎপরতা নেই। তাই দেশের মানুষ জ্বালানি উপদেষ্টাকে 'জনগণ জালাইন্না উপদেষ্টা' বলে ডাকতে শুরু করেছে। যেমন সারা বিশ্বের ১৪৭টি দেশের পাঁচ হাজার ৪১১টি শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গত ৩১ মার্চ রাত সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা 'আর্থ আওয়ার' পালন হওয়ার কথা। কিন্তু প্রচারণার অভাব এবং পরের দিন থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে রাজধানী ঢাকায় এ কর্মসূচি পালনে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। লোডশেডিংয়ের জ্বালায় অতিষ্ঠ কাউকে কাউকে বলতেও শোনা গেছে, এমনিতেই বিদ্যুৎ থাকে না তার ওপর আবার 'আর্থ আওয়ার' পালন! উপরন্তু টেলিভিশনে কর্মসূচি পালনে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরীর আহ্বান শুনেই অনেকে এ কর্মসূচি পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। পরিবেশবাদী সংগঠন ডাবি্লউডাবি্লউএফের উদ্যোগে ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে এ দিনটি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর প্রথম এ কর্মসূচি পালন করে।
পিডিবি থেকে লোডশেডিংয়ের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ সাত হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। জ্বালানির অভাবে ছয় হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন হয় না বলে দৈনিক ঘাটতি থাকে দেড় হাজার মেগাওয়াট। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে গ্যাসভিত্তিক ২১টি কেন্দ্রের আট শতাধিক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পিডিবি পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস নিতে পারছে না বলেই কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। পেট্রোবাংলা ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ করতে পারলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পিডিবি জ্বালানি সংকটকে লোডশেডিংয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের যান্ত্রিক ত্রুটিই এর কারণ বলে জানা গেছে। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সংকট হতে পারে জেনেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার শুরু থেকে কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে যতটা আন্তরিক ছিল, পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বড় পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণে ততটা আন্তরিক ও মনোযোগী ছিল না। কারণ কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনে স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ঢিমেতালে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্যও ঢাকায় বিদ্যুৎ আনা সম্ভব হচ্ছে না। এক সূত্রে জানা গেছে, যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এখন প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের সঞ্চালন লাইনের কারণেও এক এলাকার গ্যাস অন্য এলাকায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেমন পিডিবি চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের প্রত্যাশামাফিক গ্যাস পাচ্ছে না। আবার সিলেট এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস থাকার পরও তারা তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পারছে না। তাই অভিযোগ উঠেছে, পিডিবি, পেট্রোবাংলা ও পাওয়ারগ্রিড কম্পানির চরম সমন্বয়হীনতাই এর জন্য দায়ী। তিনটি সংস্থা একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়েও সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত কর্মপন্থা ও উদ্যোগ বিদ্যুৎ খাতে সুফল আনতে সহায়ক হতে পারে। জ্বালানির অভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। যত কথাই বলা হোক, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়টি অবশ্যই মনে রেখে কাজ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুযায়ী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে বিশেষভাবে নজর দেয়। দেশের বিরাজমান মারাত্মক বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে গত তিন বছরে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সমর্থ হয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট অর্জন। গত কয়েক মাসে দেওয়া ২০ লাখ নতুন সংযোগেও অনেক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। গত ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে মোট ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসহ আরো তিনটি অনুরূপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেন। সার্বিকভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু উন্নতি না হয়ে বরং উল্টো অবনতি ঘটছে। লোডশেডিংয়ে নাকাল হচ্ছে দেশবাসী। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কল-কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। জনগণ জানে যে বছরের এই সময়ে ইরি-বোরো চাষে সেচকাজ নিশ্চিত করতে শহরে লোডশেডিং বৃদ্ধি করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। এ মর্মে সেচ মৌসুম শুরুর আগে সরকারি ঘোষণাও হয়। মানুষ বিষয়টিতে অভ্যস্তও হয়ে পড়েছিল। গত বছরও অবস্থা তেমন অসহনীয় ছিল না। এবার যে অবস্থা এতটা মারাত্মক হবে, তা কেউ ভাবতেও পারেনি। ইরি-বোরো ধানের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানেও সেচকাজের জন্য কৃষকরা ঠিকমতো বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তাই শুধু বিরোধী দলই নয়, জনগণের মনেও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অবশ্য হাতের কাছে মওকা পেয়ে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী-সমর্থকরা এ খাতে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে নানারূপ বিরূপ মন্তব্য করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। অবশ্য সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলার আগে তাঁরা বেমালুম ভুলে যান, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন হয়নি। জোট সরকারের পাঁচ বছরে লাখ পাঁচেক খাম্বা কিনে বসানো হয়েছিল বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরার জন্য। বহুল আলোচিত-সমালোচিত ওই খাম্বাগুলো এখনো হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, যা দেখে গ্রামগঞ্জের মানুষ হাসাহাসি করে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস উৎপাদন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন গ্যাসভিত্তিক। বর্তমানে গ্যাস সংকটও একটি বাস্তবতা। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধির একটি বড় কারণ রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা। উপরন্তু ছোট আকৃতির এবং জ্বালানি তেলচালিত এসব কেন্দ্রে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রচুর জ্বালানি তেলের অপচয়ও হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে ভাড়াভিত্তিক এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে প্রায় ১২০ কোটি টাকার জ্বালানি তেল বেশি ব্যবহার করেছে। এগুলোর জন্য বেশি পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয় বলে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এ কারণেই আবারও বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। বর্তমান সরকারের আমলে এ নিয়ে মোট পাঁচবার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সার্বিকভাবে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে। কল-কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে অবধারিতভাবে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়বে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না করে বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। ধরে নিলাম, সরাসরি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বা তাদের দুঃখ-দুর্দশার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এমন কোনো কাজ করার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনবিচ্ছিন্ন উপদেষ্টাদের ওই বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, প্রকৃত অর্থেই জনদরদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এবং জনস্বার্থ রক্ষায় বিশেষভাবে সদা সতর্ক ও সজাগ, তিনি বিদ্যুৎ সেক্টরে বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করে এটা বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় জনগণ হতাশ হয়েছে। বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে পর পর দুই মাসে দুবার মূল্য বৃদ্ধিতেও হয়তো কেউ তেমন আপত্তি করত না বলেই সবার ধারণা। কিন্তু ব্যাপারটি হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। লোডশেডিংয়ের জ্বালায় জ্বলেও বাড়তি পয়সা দিতে হবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে! বিষয়টি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলেই মানুষের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বলা হলেও বিদ্যুৎ চুরি বা এর অপব্যবহার রোধে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই বলে এ বিষয়টিতেও জ্বালানি উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো তৎপরতা নেই। তাই দেশের মানুষ জ্বালানি উপদেষ্টাকে 'জনগণ জালাইন্না উপদেষ্টা' বলে ডাকতে শুরু করেছে। যেমন সারা বিশ্বের ১৪৭টি দেশের পাঁচ হাজার ৪১১টি শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গত ৩১ মার্চ রাত সাড়ে আটটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা 'আর্থ আওয়ার' পালন হওয়ার কথা। কিন্তু প্রচারণার অভাব এবং পরের দিন থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে রাজধানী ঢাকায় এ কর্মসূচি পালনে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। লোডশেডিংয়ের জ্বালায় অতিষ্ঠ কাউকে কাউকে বলতেও শোনা গেছে, এমনিতেই বিদ্যুৎ থাকে না তার ওপর আবার 'আর্থ আওয়ার' পালন! উপরন্তু টেলিভিশনে কর্মসূচি পালনে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরীর আহ্বান শুনেই অনেকে এ কর্মসূচি পালন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। পরিবেশবাদী সংগঠন ডাবি্লউডাবি্লউএফের উদ্যোগে ২০০৭ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে এ দিনটি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর প্রথম এ কর্মসূচি পালন করে।
পিডিবি থেকে লোডশেডিংয়ের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়, প্রকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ সাত হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। জ্বালানির অভাবে ছয় হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন হয় না বলে দৈনিক ঘাটতি থাকে দেড় হাজার মেগাওয়াট। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে গ্যাসভিত্তিক ২১টি কেন্দ্রের আট শতাধিক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পিডিবি পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস নিতে পারছে না বলেই কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। পেট্রোবাংলা ঠিকমতো গ্যাস সরবরাহ করতে পারলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পিডিবি জ্বালানি সংকটকে লোডশেডিংয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের যান্ত্রিক ত্রুটিই এর কারণ বলে জানা গেছে। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সংকট হতে পারে জেনেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার শুরু থেকে কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে যতটা আন্তরিক ছিল, পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং বড় পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণে ততটা আন্তরিক ও মনোযোগী ছিল না। কারণ কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনে স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ঢিমেতালে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্যও ঢাকায় বিদ্যুৎ আনা সম্ভব হচ্ছে না। এক সূত্রে জানা গেছে, যান্ত্রিক সমস্যার কারণে এখন প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের সঞ্চালন লাইনের কারণেও এক এলাকার গ্যাস অন্য এলাকায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেমন পিডিবি চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের প্রত্যাশামাফিক গ্যাস পাচ্ছে না। আবার সিলেট এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস থাকার পরও তারা তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পারছে না। তাই অভিযোগ উঠেছে, পিডিবি, পেট্রোবাংলা ও পাওয়ারগ্রিড কম্পানির চরম সমন্বয়হীনতাই এর জন্য দায়ী। তিনটি সংস্থা একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়েও সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত কর্মপন্থা ও উদ্যোগ বিদ্যুৎ খাতে সুফল আনতে সহায়ক হতে পারে। জ্বালানির অভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের কোনো বিকল্প নেই। যত কথাই বলা হোক, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়টি অবশ্যই মনে রেখে কাজ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments