চারদিক-‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ by ড. কাশফিয়া আহমেদ
‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ময়মনসিংহ’ স্থাপিত হয় ১৯১১ সালে। ময়মনসিংহের শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী মরহুম আলীমুদ্দিন খাঁন সাহেব তৎকালীন অনগ্রসর মুসলিম নারীদের শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে নিজস্ব ভূ-সম্পত্তির ওপর এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা শতবর্ষ ধরে জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে।
স্কুলটিতে কলেজ শাখা সংযোজিত হয় ১৯৯৫ সালে। তখন থেকে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, ময়মনসিংহ’। গত ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো স্কুলটির শতবর্ষ পূর্তি উৎসব।
শতবর্ষের গৌরবগাথায় দীপ্তিমান স্কুলটিতে এসেছিলেন ১৯৪২ সালে অধ্যয়নরত ছাত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান শিক্ষার্থীরাও। সম্মাননা দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন কৃতী ছাত্রীদেরও। বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়া প্রাক্তন ছাত্রীরা উজ্জীবিত করেছেন বর্তমান প্রজন্মকে। তাঁরা জানিয়েছেন, কীভাবে সে সময়ের শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষা দিতেন। সে সময় তাঁদের দরকার হয়নি গৃহশিক্ষক, বাবা-মায়েরা তাঁদের নিয়ে ছোটেননি কোচিং সেন্টারগুলোতে। অযাচিত পড়ার চাপে পিষ্ট হতে হয়নি কখনো, তার পরও তাঁরা হয়ে উঠেছেন সুশিক্ষিত; কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ বা শিক্ষক বা পারিবারিক ব্যবসার কর্ণধার। খুব দূরের কথা নয়, আশির দশকের ছাত্রীরাও বলেছেন শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের প্রাণঢালা পাঠদানের কথা। স্কুলের অফ পিরিয়ডেও ছাত্রীরা ইংরেজি গ্রামার বা গণিত চর্চা করেছেন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। যখন খুশি স্যার-আপাদের কাছে ছুটে গেছেন পড়াশুনায় সাহায্য চাইতে, যা বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার যাঁতাকলে যখন শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস উঠছে, যখন শিক্ষাদান হয়ে উঠেছে পুরোপুরিই বাণিজ্যিক, তখন এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মনে করিয়ে দিয়েছেন অতীতে আনন্দের সঙ্গে পাঠ্যস্মৃতির কথা। শিক্ষকদের অকৃত্রিম আর প্রাণঢালা পরিশ্রমের কথা, যার ফলে এখানের ছাত্রীরা উজ্জ্বল ফলাফলের ধারাবাহিকতায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত আজ। তাঁরা সবাই তাঁদের সাফল্যের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
শতবর্ষ উৎসবে বারবার যাঁর নামটি উঠে এসেছে, তিনি এই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা ভাষাসৈনিক সুফিয়া খান। ১৯৬২ সাল থেকে একাধারে ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়া ছাত্রীরা সুফিয়া আপার অবদানের কথাই বর্ণনা করেছেন। শুধু শিক্ষা নয়, মেধা, মনন, চরিত্র এবং সার্বিকভাবে একটি মেয়েকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার যে শিক্ষা সুফিয়া আপা দিয়েছিলেন, তা অতুলনীয়, অনুকরণীয়। একজন প্রধান শিক্ষিকা কীভাবে পুরো স্কুলের শিক্ষার্থীদের মন জয় করে যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার বন্ধনে অম্লান থাকতে পারেন, সুফিয়া খান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। শতবর্ষে এসেছিলেন ছাত্রীদের প্রিয় রতনকুমার ভৌমিক স্যার, যাঁর ভালোবাসায় জাদু ছিল। শুধু তাঁর জাদুতেই অনেক ছাত্রী জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। এসেছিলেন বারী স্যার, ফাতেমা আপা, মাহমুদা আপা, জোবেদা আপাদের মতো নন্দিত শিক্ষকেরাও। শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রীরা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা জানিয়েছেন।
‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, ময়মনসিংহ’-এর শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষা-দীক্ষায় নয়, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, গার্ল গাইডস, খেলাধুলা আর সমাজসেবামূলক নানা কাজেও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেয়েছেন। শিক্ষানগর হিসেবে খ্যাত ময়মনসিংহ শহরের সেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শতবর্ষে পা রেখেও সুনামের সঙ্গে শিক্ষাদানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রীরা গর্ব বোধ করেন এই স্কুলকে নিয়ে। স্কুলটির অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ফুলের বাগান, বিস্তৃত খেলার মাঠ এখনও অটুট।
জীবনের পথপরিক্রমায় কত স্বর্ণালি স্মৃতি পেছনে ফেলে রেখে এসেছি আমরা। ‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের’ শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ যেন ফিরে এসেছিল সবার মাঝে। এক দিনের জন্য হলেও প্রাক্তনীরা সবাই ফিরে গিয়েছিলেন সোনালী অতীতে, যেখানে ভরে আছে শুধুই পূর্ণতা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। জীবনের যে ভিত রচিত হয়েছিল এই স্কুলের আঙিনা থেকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ডালপালা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে চতুর্দিকে। নানান চড়াই উৎরাই আর উত্থান-পতনে কতই না পরিবর্তন এসেছে সবার জীবনেই। তার পরও সুফিয়া আপার আদর্শ, প্রিয় স্যার-আপাদের দেওয়া শিক্ষা আর ভালোবাসা সারা জীবনের জন্য পাথেয় হয়ে আছে যেন। প্রাক্তনীরাসহ বর্তমান প্রজন্ম সবারই শুভাশীষ আর স্বপ্ন এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে, যেন প্রতিষ্ঠানটি অতীতের মতো গৌরবান্বিত মহিমায় সামনের দিনগুলো পাড়ি দিতে পারে।
ড. কাশফিয়া আহমেদ
শতবর্ষের গৌরবগাথায় দীপ্তিমান স্কুলটিতে এসেছিলেন ১৯৪২ সালে অধ্যয়নরত ছাত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান শিক্ষার্থীরাও। সম্মাননা দেওয়া হয়েছে প্রাক্তন কৃতী ছাত্রীদেরও। বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়া প্রাক্তন ছাত্রীরা উজ্জীবিত করেছেন বর্তমান প্রজন্মকে। তাঁরা জানিয়েছেন, কীভাবে সে সময়ের শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষা দিতেন। সে সময় তাঁদের দরকার হয়নি গৃহশিক্ষক, বাবা-মায়েরা তাঁদের নিয়ে ছোটেননি কোচিং সেন্টারগুলোতে। অযাচিত পড়ার চাপে পিষ্ট হতে হয়নি কখনো, তার পরও তাঁরা হয়ে উঠেছেন সুশিক্ষিত; কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ বা শিক্ষক বা পারিবারিক ব্যবসার কর্ণধার। খুব দূরের কথা নয়, আশির দশকের ছাত্রীরাও বলেছেন শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের প্রাণঢালা পাঠদানের কথা। স্কুলের অফ পিরিয়ডেও ছাত্রীরা ইংরেজি গ্রামার বা গণিত চর্চা করেছেন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। যখন খুশি স্যার-আপাদের কাছে ছুটে গেছেন পড়াশুনায় সাহায্য চাইতে, যা বর্তমান শিক্ষার্থীদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার যাঁতাকলে যখন শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস উঠছে, যখন শিক্ষাদান হয়ে উঠেছে পুরোপুরিই বাণিজ্যিক, তখন এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মনে করিয়ে দিয়েছেন অতীতে আনন্দের সঙ্গে পাঠ্যস্মৃতির কথা। শিক্ষকদের অকৃত্রিম আর প্রাণঢালা পরিশ্রমের কথা, যার ফলে এখানের ছাত্রীরা উজ্জ্বল ফলাফলের ধারাবাহিকতায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত আজ। তাঁরা সবাই তাঁদের সাফল্যের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
শতবর্ষ উৎসবে বারবার যাঁর নামটি উঠে এসেছে, তিনি এই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা ভাষাসৈনিক সুফিয়া খান। ১৯৬২ সাল থেকে একাধারে ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে নেওয়া ছাত্রীরা সুফিয়া আপার অবদানের কথাই বর্ণনা করেছেন। শুধু শিক্ষা নয়, মেধা, মনন, চরিত্র এবং সার্বিকভাবে একটি মেয়েকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার যে শিক্ষা সুফিয়া আপা দিয়েছিলেন, তা অতুলনীয়, অনুকরণীয়। একজন প্রধান শিক্ষিকা কীভাবে পুরো স্কুলের শিক্ষার্থীদের মন জয় করে যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার বন্ধনে অম্লান থাকতে পারেন, সুফিয়া খান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। শতবর্ষে এসেছিলেন ছাত্রীদের প্রিয় রতনকুমার ভৌমিক স্যার, যাঁর ভালোবাসায় জাদু ছিল। শুধু তাঁর জাদুতেই অনেক ছাত্রী জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। এসেছিলেন বারী স্যার, ফাতেমা আপা, মাহমুদা আপা, জোবেদা আপাদের মতো নন্দিত শিক্ষকেরাও। শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রীরা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মাননা জানিয়েছেন।
‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, ময়মনসিংহ’-এর শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষা-দীক্ষায় নয়, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, গার্ল গাইডস, খেলাধুলা আর সমাজসেবামূলক নানা কাজেও উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেয়েছেন। শিক্ষানগর হিসেবে খ্যাত ময়মনসিংহ শহরের সেরা এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শতবর্ষে পা রেখেও সুনামের সঙ্গে শিক্ষাদানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রীরা গর্ব বোধ করেন এই স্কুলকে নিয়ে। স্কুলটির অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ফুলের বাগান, বিস্তৃত খেলার মাঠ এখনও অটুট।
জীবনের পথপরিক্রমায় কত স্বর্ণালি স্মৃতি পেছনে ফেলে রেখে এসেছি আমরা। ‘মুসলিম বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের’ শতবর্ষ পূর্তি উৎসবে ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ যেন ফিরে এসেছিল সবার মাঝে। এক দিনের জন্য হলেও প্রাক্তনীরা সবাই ফিরে গিয়েছিলেন সোনালী অতীতে, যেখানে ভরে আছে শুধুই পূর্ণতা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। জীবনের যে ভিত রচিত হয়েছিল এই স্কুলের আঙিনা থেকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ডালপালা শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে চতুর্দিকে। নানান চড়াই উৎরাই আর উত্থান-পতনে কতই না পরিবর্তন এসেছে সবার জীবনেই। তার পরও সুফিয়া আপার আদর্শ, প্রিয় স্যার-আপাদের দেওয়া শিক্ষা আর ভালোবাসা সারা জীবনের জন্য পাথেয় হয়ে আছে যেন। প্রাক্তনীরাসহ বর্তমান প্রজন্ম সবারই শুভাশীষ আর স্বপ্ন এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে, যেন প্রতিষ্ঠানটি অতীতের মতো গৌরবান্বিত মহিমায় সামনের দিনগুলো পাড়ি দিতে পারে।
ড. কাশফিয়া আহমেদ
No comments