আমলি-ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি-নারী নির্যাতন মামলায় ফরিয়াদির ভোগান্তি by সোহেল রানা
‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর অধীনে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলো গঠিত হয়েছে, যেখানে কমবেশি ১২ ধরনের অপরাধের বিচার হয়। দ্রুত বিচারের প্রয়াস হিসেবে আইনটি প্রণীত হলেও বাস্তবে ট্রাইব্যুনালে মামলার সফলতা অর্থাৎ প্রমাণের হার আশানুরূপ নয়।
তা ছাড়া ট্রাইব্যুনালে এসে বিচার চাওয়ার জন্যই ভিকটিমপক্ষকে অপরিসীম হয়রানি বা ভোগান্তি পোহাতে হয়।
এমনিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভিযোগকারী থানায় গিয়ে পুলিশি মামলা কিংবা আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা করতে পারেন। নালিশি মামলার ক্ষেত্রে আদালত অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিতে বা আমলে নিতে (অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ, অর্থাৎ অভিযুক্ত ঘটনার ভিত্তিতে কাউকে আসামি গণ্য করে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করা) পারেন কিংবা প্রয়োজন মনে করলে এর আগে উপযুক্ত কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান বা তদন্তও করিয়ে নিতে পারেন; এমনকি ক্ষেত্রমতে নালিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য থানার পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারেন। নালিশের ভিত্তিতে সরাসরি অপরাধ আমলে নেওয়ার ওইরূপ ক্ষমতা একটি বিশেষায়িত দায়রা আদালত হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেরও ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে আইনটিতে বড় ধরনের সংশোধনী এনে ট্রাইব্যুনালের সেরূপ আমলি-ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এখন আইনটিতে বর্ণিত কোনো অপরাধমূলক কার্যের ফলে মামলা করতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে থানায়, সরাসরি ট্রাইব্যুনালে আসার সুযোগ নেই। থানার পুলিশকে কাকুতি-মিনতি ও দেনদরবার (আইনে ব্যবহূত ‘অনুরোধ’ শব্দটির পুলিশি চর্চা বাস্তবে এমনটিই হয়) করে সন্তুষ্ট করতে পারলে মামলা রুজু হবে, না হয় ভিকটিমপক্ষকে ফরিয়াদি হয়ে ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হতে হবে। এখানে ফরিয়াদিকে নালিশের সঙ্গে এরূপ হলফনামাও দিতে হবে যে তিনি থানায় গিয়েও মামলা রুজু করাতে সক্ষম হননি। ফরিয়াদিকে শুনানি করে ট্রাইব্যুনাল যদি দাবি করা বিষয়ে ‘সন্তুষ্ট’ (এ স্তরে ট্রাইব্যুনালের সন্তুষ্টি ঠিক কিসের ওপর, অর্থাৎ থানায় গিয়েও মামলা করতে ব্যর্থ হওয়া নাকি অপরাধমূলক ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা; তা আইনটিতে স্পষ্ট নয়) না হন, তাহলে অভিযোগ ওইখানেই নাকচ করে দেবেন। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলে আবার অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট বা উপযুক্ত কাউকে দিয়ে অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) করিয়ে নিতে হবে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যদি দুুটি বিষয়েরই (ভিকটিমপক্ষ থানায় গিয়েও মামলা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অপরাধমূলক ঘটনার সপক্ষে প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে) সত্যতা থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেবেন; তা না থাকলে অভিযোগ নাকচ করে দেবেন অর্থাৎ ভিকটিমপক্ষের আর মামলা করা হবে না।
অর্থাৎ, নারী ও শিশু মামলার ক্ষেত্রে ভিকটিমপক্ষকে যেমন বিচার পাওয়ার আগেই ‘অযথা কিন্তু ক্ষতিকর’ বেশ কিছু হয়রানি পোহানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তেমনি ট্রাইব্যুনালের সহজাত ক্ষমতার সঙ্গেও ‘খেলো’ আচরণ করা হচ্ছে। নালিশ দাখিল করার পর ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হয়ে গেলেও তা আবার অধস্তন বা অনভিজ্ঞ কারও কর্তৃক অনুসন্ধানে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা খেলো আচরণেরই শামিল। প্রাথমিকভাবে নিজে সন্তুষ্ট হয়েও অন্য কর্তৃক অনুসন্ধান না করিয়ে যদি অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের না-ই থাকে, তাহলে অসন্তুষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই (অনুসন্ধানে না পাঠিয়েই) অভিযোগ নাকচ করে দিতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য থাকবেন কেন? অনুসন্ধান কার্য যদি বাধ্যতামূলকভাবে করাতেই হয়, তাহলে দুটির জন্যই (অভিযোগ নাকচ বা আমলে নেওয়া) তা করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় এ বিষয়ে আইনে কোনো কিছু বাধ্যতামূলক না করা; কারণ কেউ নালিশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে ট্রাইব্যুনালই ঠিক করবেন অভিযোগের সত্যতা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে কি না। আবার, অভিযোগ অনুসন্ধানে পাঠানো হলে ভিকটিমপক্ষকে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে অনুসন্ধানকারীর কাছে এক বা একাধিক দিন হাজির হতে হয় (অজ্ঞতার দরুন অনেক অনুসন্ধানকারী অভিযুক্তপক্ষের বক্তব্যও শ্রবণ বা রেকর্ড করেন, কিন্তু অনুসন্ধান কার্যে অপরপক্ষের বক্তব্য শ্রবণের সুযোগ নেই)। এ কাজ অপরিসীম কষ্টের তো বটেই, এসব করতে গিয়ে যে সময় পার হয়ে যায় তাতে অভিযুক্ত ঘটনার অনেক আলামত বা প্রমাণ নষ্ট কিংবা হালকা হয়ে যায় এবং তাতে বিচার পাওয়ার মানসিক ধৈর্য বা আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে আর থাকে না। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা থাকলেও তার ভিত্তিতে কিন্তু বিচার সম্পন্ন হয় না; ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিত হওয়া পরিপূর্ণ বিচারের সময়ও ফরিয়াদিকে ঠিকই সাক্ষীদের উপস্থাপন করতে হয়।
পদ্ধতিগত কারণেই এটা সত্য যে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মামলা করার সুযোগ থানার চেয়ে আদালতে বেশি এবং ঘটনার আলামত বা সাক্ষ্যাদি সংগ্রহের সুযোগ নালিশি মামলার চেয়ে পুলিশি মামলায় বেশি থাকে। নালিশের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের সরাসরি আমলি ক্ষমতা খর্ব করে ফেলার যুক্তি হয়তো এটিই ছিল যে তাতে ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এখন যে ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মামলার সংখ্যা একেবারেই কম তা নয়। এমন অভিযোগও কানে আসে যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট না রাখলে নাকি সত্য মামলায়ও সঠিক অভিযোগপত্র পাওয়া যায় না বা সন্তুষ্ট রাখতে পারলে নাকি মিথ্যা মামলায়ও অভিযোগপত্র দেওয়ানো অসম্ভব কিছু নয়। এই অভিযোগের যদি কিঞ্চিৎ সত্যতাও থেকে থাকে, তাহলে নারী নির্যাতন মামলা এর বাইরে থাকবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর এটা তো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে এজাহারের বক্তব্য ‘মনমতো’ না হলেও পুলিশ অনেক সময় মামলা নিতে চায় না; লিখিত এজাহার নিয়ে থানায় গেলে মামলা সুদৃঢ় করার নামে এজাহারের বক্তব্যে সংশোধন বা পরিবর্তনের পরামর্শ দেবে বা নিজেরাই করিয়ে নেবে। কিন্তু এর ফলে অনেক সময়ই মামলা সুদৃঢ় না হয়ে বরং দুর্বল হয়ে যায়, যার সুযোগে তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে সত্য ঘটনায়ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কিংবা বিচারের সময় আসামি যাতে অন্যায্য সুবিধা পায় তার আগাম ব্যবস্থা করে রাখতে পারেন। একটি পুলিশি মামলায় এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে সাক্ষ্য উপস্থাপন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই পুলিশের এমন কিছু করার (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) সুযোগ বা ক্ষেত্র রয়েছে যার দরুন সত্য মামলায়ও আসামিকে খালাস দিতে আদালত বাধ্য হন। আর এটা স্বতসিদ্ধ যে মামলার মূল ভিত্তি হিসেবে এজাহারের বক্তব্যই যদি স্পষ্ট বা সুদৃঢ় না হয়, তাহলে সেই মামলায় অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া নিরাপদ হয় না। অথচ আইনটির নানা পূর্বশর্ত ও আনুষ্ঠানিকতায় ট্রাইব্যুনালে মামলা করা এখন কঠিন ও শ্রমসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থানা পুলিশকেই সর্বেসর্বা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু এটা বাস্তবতা যে একটি মামলা পুলিশি হলেও তার সাফল্য নিশ্চিত নয় (ঘটনা সত্য হলেও), সেহেতু নারী ও শিশু মামলার ক্ষেত্রে থানার পুলিশকে সর্বেসর্বা বানিয়ে রাখার অবস্থা থেকে এখন বেরিয়ে আসতে হবে। নারী ও শিশু অপরাধের ভিকটিমপক্ষের সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকা উচিত তার পছন্দমতো থানায় বা ট্রাইব্যুনালে মামলা করার। ট্রাইব্যুনালে আসার আগে থানায় ঘুরে আসার বাধ্যবাধকতা বিলোপ করা এবং নালিশের ভিত্তিতে সরাসরি অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। নালিশের ভিত্তিতে মামলা নেওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের যদি মনে হয় যে তাতে অতিরঞ্জন বা মিথ্যাচার রয়েছে, তাহলে আসামিদের সহজে জামিন দেওয়ার মাধ্যমেই এর তাৎক্ষণিক প্রতিকার দিতে পারেন, চূড়ান্ত প্রতিকারের সুযোগ তো বিচারান্তে রয়েছেই। কেউ যাতে মিথ্যা নারী ও শিশু মামলা দায়ের না করেন, সে জন্য ওই আইনেই (ধারা-১৭) বড় রক্ষাকবচ রয়েছে যার বলে মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় মামলার বাদী বা পরামর্শদাতাদের শাস্তিদানের সুযোগ রয়েছে। তবে মিথ্যা মামলার আসামিপক্ষকে এর প্রতিকার নিতে হলে আলাদা নালিশি মামলা করার বিদ্যমান বিধানটি সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালকে মূল মামলায়ই তা করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, যেরূপ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী চালিত অন্যান্য মামলায় বিচারিক হাকিমরা এখন করছেন।
লেখক সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।
এমনিতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভিযোগকারী থানায় গিয়ে পুলিশি মামলা কিংবা আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা করতে পারেন। নালিশি মামলার ক্ষেত্রে আদালত অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিতে বা আমলে নিতে (অপরাধ বিচারার্থ গ্রহণ, অর্থাৎ অভিযুক্ত ঘটনার ভিত্তিতে কাউকে আসামি গণ্য করে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করা) পারেন কিংবা প্রয়োজন মনে করলে এর আগে উপযুক্ত কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান বা তদন্তও করিয়ে নিতে পারেন; এমনকি ক্ষেত্রমতে নালিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার জন্য থানার পুলিশকে নির্দেশও দিতে পারেন। নালিশের ভিত্তিতে সরাসরি অপরাধ আমলে নেওয়ার ওইরূপ ক্ষমতা একটি বিশেষায়িত দায়রা আদালত হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেরও ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে আইনটিতে বড় ধরনের সংশোধনী এনে ট্রাইব্যুনালের সেরূপ আমলি-ক্ষমতা খর্ব করা হয়। এখন আইনটিতে বর্ণিত কোনো অপরাধমূলক কার্যের ফলে মামলা করতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে থানায়, সরাসরি ট্রাইব্যুনালে আসার সুযোগ নেই। থানার পুলিশকে কাকুতি-মিনতি ও দেনদরবার (আইনে ব্যবহূত ‘অনুরোধ’ শব্দটির পুলিশি চর্চা বাস্তবে এমনটিই হয়) করে সন্তুষ্ট করতে পারলে মামলা রুজু হবে, না হয় ভিকটিমপক্ষকে ফরিয়াদি হয়ে ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হতে হবে। এখানে ফরিয়াদিকে নালিশের সঙ্গে এরূপ হলফনামাও দিতে হবে যে তিনি থানায় গিয়েও মামলা রুজু করাতে সক্ষম হননি। ফরিয়াদিকে শুনানি করে ট্রাইব্যুনাল যদি দাবি করা বিষয়ে ‘সন্তুষ্ট’ (এ স্তরে ট্রাইব্যুনালের সন্তুষ্টি ঠিক কিসের ওপর, অর্থাৎ থানায় গিয়েও মামলা করতে ব্যর্থ হওয়া নাকি অপরাধমূলক ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা; তা আইনটিতে স্পষ্ট নয়) না হন, তাহলে অভিযোগ ওইখানেই নাকচ করে দেবেন। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলে আবার অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন না, অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট বা উপযুক্ত কাউকে দিয়ে অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) করিয়ে নিতে হবে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যদি দুুটি বিষয়েরই (ভিকটিমপক্ষ থানায় গিয়েও মামলা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অপরাধমূলক ঘটনার সপক্ষে প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে) সত্যতা থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নেবেন; তা না থাকলে অভিযোগ নাকচ করে দেবেন অর্থাৎ ভিকটিমপক্ষের আর মামলা করা হবে না।
অর্থাৎ, নারী ও শিশু মামলার ক্ষেত্রে ভিকটিমপক্ষকে যেমন বিচার পাওয়ার আগেই ‘অযথা কিন্তু ক্ষতিকর’ বেশ কিছু হয়রানি পোহানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তেমনি ট্রাইব্যুনালের সহজাত ক্ষমতার সঙ্গেও ‘খেলো’ আচরণ করা হচ্ছে। নালিশ দাখিল করার পর ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হয়ে গেলেও তা আবার অধস্তন বা অনভিজ্ঞ কারও কর্তৃক অনুসন্ধানে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা খেলো আচরণেরই শামিল। প্রাথমিকভাবে নিজে সন্তুষ্ট হয়েও অন্য কর্তৃক অনুসন্ধান না করিয়ে যদি অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের না-ই থাকে, তাহলে অসন্তুষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই (অনুসন্ধানে না পাঠিয়েই) অভিযোগ নাকচ করে দিতে ট্রাইব্যুনাল বাধ্য থাকবেন কেন? অনুসন্ধান কার্য যদি বাধ্যতামূলকভাবে করাতেই হয়, তাহলে দুটির জন্যই (অভিযোগ নাকচ বা আমলে নেওয়া) তা করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় এ বিষয়ে আইনে কোনো কিছু বাধ্যতামূলক না করা; কারণ কেউ নালিশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে ট্রাইব্যুনালই ঠিক করবেন অভিযোগের সত্যতা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য অনুসন্ধান বা তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে কি না। আবার, অভিযোগ অনুসন্ধানে পাঠানো হলে ভিকটিমপক্ষকে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে অনুসন্ধানকারীর কাছে এক বা একাধিক দিন হাজির হতে হয় (অজ্ঞতার দরুন অনেক অনুসন্ধানকারী অভিযুক্তপক্ষের বক্তব্যও শ্রবণ বা রেকর্ড করেন, কিন্তু অনুসন্ধান কার্যে অপরপক্ষের বক্তব্য শ্রবণের সুযোগ নেই)। এ কাজ অপরিসীম কষ্টের তো বটেই, এসব করতে গিয়ে যে সময় পার হয়ে যায় তাতে অভিযুক্ত ঘটনার অনেক আলামত বা প্রমাণ নষ্ট কিংবা হালকা হয়ে যায় এবং তাতে বিচার পাওয়ার মানসিক ধৈর্য বা আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে আর থাকে না। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা থাকলেও তার ভিত্তিতে কিন্তু বিচার সম্পন্ন হয় না; ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিত হওয়া পরিপূর্ণ বিচারের সময়ও ফরিয়াদিকে ঠিকই সাক্ষীদের উপস্থাপন করতে হয়।
পদ্ধতিগত কারণেই এটা সত্য যে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মামলা করার সুযোগ থানার চেয়ে আদালতে বেশি এবং ঘটনার আলামত বা সাক্ষ্যাদি সংগ্রহের সুযোগ নালিশি মামলার চেয়ে পুলিশি মামলায় বেশি থাকে। নালিশের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের সরাসরি আমলি ক্ষমতা খর্ব করে ফেলার যুক্তি হয়তো এটিই ছিল যে তাতে ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এখন যে ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মামলার সংখ্যা একেবারেই কম তা নয়। এমন অভিযোগও কানে আসে যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সন্তুষ্ট না রাখলে নাকি সত্য মামলায়ও সঠিক অভিযোগপত্র পাওয়া যায় না বা সন্তুষ্ট রাখতে পারলে নাকি মিথ্যা মামলায়ও অভিযোগপত্র দেওয়ানো অসম্ভব কিছু নয়। এই অভিযোগের যদি কিঞ্চিৎ সত্যতাও থেকে থাকে, তাহলে নারী নির্যাতন মামলা এর বাইরে থাকবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আর এটা তো আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যে এজাহারের বক্তব্য ‘মনমতো’ না হলেও পুলিশ অনেক সময় মামলা নিতে চায় না; লিখিত এজাহার নিয়ে থানায় গেলে মামলা সুদৃঢ় করার নামে এজাহারের বক্তব্যে সংশোধন বা পরিবর্তনের পরামর্শ দেবে বা নিজেরাই করিয়ে নেবে। কিন্তু এর ফলে অনেক সময়ই মামলা সুদৃঢ় না হয়ে বরং দুর্বল হয়ে যায়, যার সুযোগে তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে সত্য ঘটনায়ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কিংবা বিচারের সময় আসামি যাতে অন্যায্য সুবিধা পায় তার আগাম ব্যবস্থা করে রাখতে পারেন। একটি পুলিশি মামলায় এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে সাক্ষ্য উপস্থাপন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই পুলিশের এমন কিছু করার (ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়) সুযোগ বা ক্ষেত্র রয়েছে যার দরুন সত্য মামলায়ও আসামিকে খালাস দিতে আদালত বাধ্য হন। আর এটা স্বতসিদ্ধ যে মামলার মূল ভিত্তি হিসেবে এজাহারের বক্তব্যই যদি স্পষ্ট বা সুদৃঢ় না হয়, তাহলে সেই মামলায় অভিযুক্তকে সাজা দেওয়া নিরাপদ হয় না। অথচ আইনটির নানা পূর্বশর্ত ও আনুষ্ঠানিকতায় ট্রাইব্যুনালে মামলা করা এখন কঠিন ও শ্রমসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থানা পুলিশকেই সর্বেসর্বা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু এটা বাস্তবতা যে একটি মামলা পুলিশি হলেও তার সাফল্য নিশ্চিত নয় (ঘটনা সত্য হলেও), সেহেতু নারী ও শিশু মামলার ক্ষেত্রে থানার পুলিশকে সর্বেসর্বা বানিয়ে রাখার অবস্থা থেকে এখন বেরিয়ে আসতে হবে। নারী ও শিশু অপরাধের ভিকটিমপক্ষের সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকা উচিত তার পছন্দমতো থানায় বা ট্রাইব্যুনালে মামলা করার। ট্রাইব্যুনালে আসার আগে থানায় ঘুরে আসার বাধ্যবাধকতা বিলোপ করা এবং নালিশের ভিত্তিতে সরাসরি অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে ফিরিয়ে দেওয়া জরুরি। নালিশের ভিত্তিতে মামলা নেওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের যদি মনে হয় যে তাতে অতিরঞ্জন বা মিথ্যাচার রয়েছে, তাহলে আসামিদের সহজে জামিন দেওয়ার মাধ্যমেই এর তাৎক্ষণিক প্রতিকার দিতে পারেন, চূড়ান্ত প্রতিকারের সুযোগ তো বিচারান্তে রয়েছেই। কেউ যাতে মিথ্যা নারী ও শিশু মামলা দায়ের না করেন, সে জন্য ওই আইনেই (ধারা-১৭) বড় রক্ষাকবচ রয়েছে যার বলে মিথ্যা ও অপ্রয়োজনীয় মামলার বাদী বা পরামর্শদাতাদের শাস্তিদানের সুযোগ রয়েছে। তবে মিথ্যা মামলার আসামিপক্ষকে এর প্রতিকার নিতে হলে আলাদা নালিশি মামলা করার বিদ্যমান বিধানটি সংশোধন করে ট্রাইব্যুনালকে মূল মামলায়ই তা করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, যেরূপ ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী চালিত অন্যান্য মামলায় বিচারিক হাকিমরা এখন করছেন।
লেখক সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।
No comments