পর্যটন-বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে এই শিল্প কী পেল by তৌফিক রহমান

বিশ্বকাপ ক্রিকেট আয়োজন শেষ। ২ এপ্রিল ফাইনাল খেলা হলেও ২৫ মার্চ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার মধ্য দিয়ে প্রায় দুই মাসের এ আয়োজন সফলভাবে শেষ করল বাংলাদেশ। বহু বিদেশি মিডিয়া, যারা সব সময়ই বাংলাদেশের নেতিবাচক খবরে উৎসাহী ছিল, তারাও ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং অন্য সব আয়োজনের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসায়


পঞ্চমুখ ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ক্রীড়ার ক্ষেত্রে এত বড় আয়োজন বাংলাদেশে এই প্রথম। সেদিক দিয়ে সবাই সুষ্ঠু আয়োজন নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ আবারও প্রমাণ করল, প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং কর্মক্ষমতায় সবই সম্ভব।
এবারে মূল প্রসঙ্গ। সাধারণত একটি দেশে যখন এত বড় ক্রীড়া আয়োজন হয়, তার সিংহভাগই ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সমান অংশীদার হয় সে দেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়। কারণ, ওই সব অনুষ্ঠান আয়োজন করে একটি দেশের প্রথমত ইতিবাচক ভাবমূর্তির উন্নয়ন এবং পরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়, যা সর্বশেষে পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন এবং প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণ হিসেবে নিকট-অতীতে অনুষ্ঠিত হওয়া দুটি ক্রীড়া অনুষ্ঠানের উল্লেখ করা যায়। এর একটি হচ্ছে চীনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং আরেকটি হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবল। চীনে যখন অলিম্পিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তখন স্টেডিয়াম, মাঠ, গ্যালারি তৈরির পাশাপাশি প্রচুর হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, স্যুভেনির দোকান, ফাস্টফুড শপও তৈরি হয়। উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো প্রচুর বিদেশি দর্শক, যাঁরা খেলা উপলক্ষে সে দেশে গেছেন, তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ সেবা দেওয়া। চীন অলিম্পিকের সফল আয়োজনই শুধু করেনি, সে সময়ে পর্যটনশিল্প থেকে খরচের তিন-চার গুণ অর্থও তুলে আনে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় দক্ষিণ আফ্রিকা বিখ্যাত পপশিল্পী শাকিরাকে দিয়ে ‘ওয়াকা ওয়াকা’ থিম সং গাইয়ে বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফলে সে সময় প্রচুর দর্শক ও পর্যটক দেশটি ভ্রমণ করে এবং সে দেশের পর্যটনশিল্পের দ্বারা দেশটি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। সে সময় শাকিরার পাশাপাশি আরও বেশ কজন আফ্রিকান শিল্পী সংগীত পরিবেশন করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘একন’। তিনি যে গানগুলো গেয়েছিলেন, তার কথাগুলো ছিল পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। চীনের মতো দক্ষিণ আফ্রিকাও তার ব্যয়কৃত অর্থের সবটুকু পর্যটন খাত থেকে তুলে ফেলে। এর পেছনে ছিল সে দেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন বোর্ড, সর্বোপরি বেসরকারি পর্যটন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত প্রয়াস।
বাংলাদেশে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াও মোট আটটি খেলা সম্পন্ন হয়েছে। বিদেশি খেলোয়াড়, আম্পায়ার, অফিশিয়ালস এবং ইএসপিএনের কর্মী বাদ দিলে শুধু খেলা দেখতে কজন পর্যটক বাংলাদেশে এসেছেন? মিরপুর ও চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে কজন বিদেশি তাঁদের নিজের দেশকে সমর্থন করে মাঠে খেলা দেখেছেন? আর আমাদের মতো বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলোও সর্বসাকল্যে কতজন বিদেশি ক্রীড়া পর্যটককে সেবা দিতে পারলাম, এর হিসাব কি কারও কাছে আছে? বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাদের খেলোয়াড়, অফিশিয়ালস এদের নিয়েই মূলত ব্যস্ত ছিল এবং তারা সফলভাবেই আয়োজন সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু পর্যটন মন্ত্রণালয় কিংবা নবগঠিত পর্যটন বোর্ড কী করল? মাঠে শুধু বড় করে ‘লোগো’ ব্যবহারেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল।
পত্রপত্রিকা আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখেছি, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ আমলার কথা, ‘১০-১৫ হাজার দর্শক খেলা দেখতে আসবেন এ দেশে এবং তাঁদের থাকার কোনো সমস্যাই নেই দেশে।’ বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর আগে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে ১০-১৫ হাজার দর্শক আসবেন, আপনার মন্তব্য কী?’ বলেছিলাম ঢাকাতে যে কটি পাঁচ, তিন, দুই ও এক তারকাবিশিষ্ট হোটেল, গেস্টহাউস আছে, তাতে সব মিলিয়েও আমাদের সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা হচ্ছে (Per Room Night) সাড়ে তিন থেকে চার হাজার। সুতরাং ১০-১৫ হাজার দর্শক যদি সত্যি সত্যি আসে, তাহলে এত লোককে জায়গা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত হোটেল নেই এ মুহূর্তে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, ‘কোনো অসুবিধা নেই, সবাই থাকতে পারবে।’ কী আশ্চর্য কথা! কোনো সার্ভে নেই, কোনো গবেষণা নেই শুধুই মুখে যত কথা। আর এ কারণেই গত দুই বছরে আমাদের পর্যটনশিল্পের এক চিলতেও অগ্রগতি হয়নি।
সেদিন পত্রিকায় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পড়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে পৌনে ৫০০ কোটি টাকা। আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য সংখ্যাটি নিশ্চয়ই ছোট নয়। অথচ সত্যি সত্যিই যদি ১৫ হাজার দর্শক চলে আসতেন এবং গড়ে এক হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে, তাহলে সংখ্যাটি কত হতো? আমাদের পর্যটনশিল্পের জন্য অনেক বড় সংখ্যা নয় কি? সে জন্য যেটি করতে হতো, তা হচ্ছে বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করা, যেটি শ্রীলঙ্কা করেছিল। আর এ জন্য প্রয়োজন ছিল বেসরকারি পর্যটনে অভিজ্ঞ লোকদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা। সেটি কি হয়েছিল? সর্বোপরি যে সমস্যাটি প্রবলভাবে দেখা দেয়, বেসরকারি পর্যটন সংস্থাগুলোর মধ্যে তা হলো ম্যাচ টিকিটের অভাব। আমরা প্রতিটি ম্যাচেরই বেশ কিছু বুকিং পেয়েছিলাম। কিন্তু বিদেশি দর্শকদের একটাই কথা—হোটেল আর পরিবহনের সঙ্গে ম্যাচ টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৫ হাজার দর্শক আসবেন বলে আপনি ভাবছেন আর তাঁদের ম্যাচ টিকিটের কথা ভাববেন না? অথচ বিশ্বকাপের অন্যান্য দুই আয়োজক দেশ শ্রীলঙ্কা আর ভারতের ট্যুর অপারেটররা সমানে ম্যাচ টিকিটসহ বিশ্বকাপ প্যাকেজ বিক্রি করে চলেছে।
পর্যটনশিল্পকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিনির্মাণের ভবিষ্যৎ প্রচার ও প্রসারের যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, বিশ্বকাপ চলাকালে তা আমরা হেলায় হারিয়েছি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যে অতীত রেকর্ড রয়েছে, তা মোটেও সুখকর নয়। পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পর্যটন বোর্ড নিশ্চয়ই সেটি জরুরি ভিত্তিতে ভাববে, যাতে ভবিষ্যতে আমাদের পর্যটনশিল্প, পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্রে স্বমহিমায় জায়গা করে নিতে পারে।
তৌফিক রহমান: পর্যটনকর্মী।
journeyplus@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.