ব্যাংকে তারল্যসংকট: ৩-আমদানি অর্থায়নের টাকা শেয়ারবাজারেও গেছে by মনজুর আহমেদ

৯০ দিনের আস্থার বিপরীতে ঋণের (এলটিআর) একটা অংশ ব্যাংকে ফিরে না এসে সরাসরি শেয়ারের বেনিফিশিয়ারি হিসাবে (বিও) ঢুকে পড়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তাঁর শাখার তথ্য দিয়ে এটা নিশ্চিত করেন।


ব্যাংক ও নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের শাখার প্রায় ৬০ কোটি টাকার এলটিআর অর্থায়ন ব্যাংকে ফেরত না এসে শেয়ারবাজারে গেছে। কিন্তু বিও হিসাব পরীক্ষা করার আইনি অধিকার তাঁদের নেই। সে কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
ঢাকার ব্যাংক থেকেও এলটিআর ঋণের অপচর্চার এমন তথ্য মিলেছে। সূত্র জানায়, বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের প্রায় ৪০ কোটি টাকার এলটিআর অর্থায়ন শেয়ারবাজারে ঢুকেছে—এমন তথ্য-প্রমাণ ব্যাংকটির কাছে রয়েছে।
ব্যাংকের নগদ টাকা কোথায় গেল, কেনই বা তারল্যসংকট—এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঢাকার বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, মৌলভীবাজার, বাবুবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদে দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বতালাশ এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে ব্যাংকঋণের অপব্যবহারের বিচিত্র সব তথ্য পাওয়া যায়।
তবে সূত্র জানায়, শেয়ারবাজারে এই ঋণ ঢুকলেও অনেক ব্যবসায়ী শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে বাজার থেকে বের হতে পারেননি। তার আগেই বাজারে বিপর্যয় হয়েছে। আবার কেউ কেউ শেষ সময়ে অর্থাৎ ২০১০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে বাজারে বিনিয়োগ করে আটকে পড়েছেন। তাঁদের টাকা এখন অনেকটাই লোকসানের খাতায়।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সদস্য ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ৯০ বা ৪৫ দিনের ঋণ সময়মতো যে ব্যাংকে আসছে না, আবার মালামালও গুদামে পাওয়া যাচ্ছে না—এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী শেয়ারবাজারে খাটিয়েছেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, স্বচ্ছতা না থাকলে তো যাবেই।
এর আগে ২০১০ সালের মাঝামাঝি ব্যাংক থেকে শিল্পের নামে নেওয়া চলতি মূলধন ঋণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছিল।
স্থানীয় এলসির খেলা: শুধু এলটিআর অর্থায়নই নয়, স্থানীয় ঋণপত্রের (লোকাল এলসি) মাধ্যমে অর্থ বের করে সেই টাকাও শেয়ারবাজারে খাটানো হয়েছে ২০১০ সালের মাঝামাঝিতে। জানা যায়, দেশের একটি বড় শিল্প গ্রুপের এক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান (হোল্ডিং কোম্পানি) বেসরকারি খাতের এক ব্যাংকে স্থানীয় ঋণপত্র খোলে। এ প্রতিষ্ঠানটি ঋণপত্র খোলে গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইয়ার্ন বা সুতা কেনার জন্য। রাষ্ট্রমালিকানাধীন দুটি ব্যাংক ইয়ার্ন বা সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক দুটি এই কেনাবেচা-প্রক্রিয়া শেষ করতে বেসরকারি ব্যাংকের কাছে এলসির স্বীকৃতিপত্র (এক্সেপটেন্স) চায় ও পেয়ে যায়। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষে বেসরকারি ব্যাংকটি তার গ্রাহক হোল্ডিং কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারেনি। ফলে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকের তিন শতাধিক কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এটা নিয়ে এখন মধ্যস্থতা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্রগুলো বলছে, এক গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুই ব্যাংকে এভাবে এলসি দেওয়া ও স্বীকৃতি দিয়ে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা বিনিয়োগ হয়েছিল ২০১০ সালের ফুলেফেঁপে ওঠা শেয়ারবাজারে।
নানা ধরনের অর্থায়ন-প্রক্রিয়ায়, বিশেষত শেয়ারবাজার থেকে বড় অঙ্কের মুদ্রা বিদেশে পাচার হওয়ার কথাও অনুসন্ধানে জানা যায়। দেশের বৈদেশিক লেনদেন হিসাবে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এরর অ্যান্ড অমিশন অর্থাৎ ভ্রান্তি ও বাদ খাতে পার্থক্য ছিল ৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সাধারণভাবে বলা হয়, এ ধরনের ভ্রান্তি বা বাদ মুদ্রা পাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানের সার্বিক তথ্য নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রধানত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত হতে হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এলটিআর বা আমদানি অর্থায়নের অর্থ ৯০ দিনের পরিবর্তে আরও এক মাস বেশি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই তা মেয়াদি ঋণে পরিণত করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘এটা যদি হয়েই থাকে, তা কেবল ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনাতেই সমস্যা করবে না, এর প্রভাব স্থানীয় নিত্যপণ্যের বাজারেও গিয়ে পড়বে।’ (শেষ)

No comments

Powered by Blogger.