বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-মামলার তদন্ত ও জট : বিস্ময়, প্রশ্ন আর হতাশা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
'জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনাইড'- ইংরেজি এই বাক্যটি বহু পুরনো এবং অতি সত্যও বটে। এর বাংলা দাঁড়ায়, বিচারকাজ যত বিলম্ব হবে, ন্যায়বিচার ততটাই ব্যাহত হবে। এর সপক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণও আছে। এ দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত এবং উদ্বেগজনক এমন নজিরও আছে, মামলায় লড়তে লড়তে অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হয়ে
গেছে। আবার অনেক মামলা হারিয়েও গেছে সময়ের অতল গহ্বরে। আর বিচারের বাণী নীরবে, নিভৃতে কাঁদে, এর সত্যতাও এ দেশে মেলে অনেক ক্ষেত্রেই। মামলার তদন্ত ক্ষেত্রে নানা রকম গড়িমসি তো আছেই; তা ছাড়া তদন্তের দীর্ঘসূত্রতায় শান্তিকামী বিচারপ্রার্থী মানুষ আহতও হয়। এ সব কিছুরই সুযোগ লাভ করে অপশক্তি আর ন্যায়বিচার লাভে বঞ্চিত হন বিচারপ্রার্থীরা। এই হতাশা, প্রশ্নবোধক, উৎকণ্ঠাজনিত বিষয়গুলো এক দিনে সৃষ্ট না হলেও ক্রমেই এ চিত্র পুষ্ট হচ্ছে- এটি হলো আশঙ্কার বড় কারণ।
দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় নিকট অতীতে সংঘটিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। ৪৮ ঘণ্টা দূরে থাক, ৪৮ দিন পরও ওই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা যায়নি। এ রকম স্পর্শকাতর ঘটনা আরো অনেক আছে এবং সেগুলোর চিত্রও হতাশার ছায়ায় ঢাকা। এসব ক্ষেত্রে আইনি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সরকারি অন্য প্রশাসনের যোগ্যতার চিত্রটিও বড় বেশি বিবর্ণ হিসেবে ফুটে উঠছে, যা চরম অশুভ বার্তাও বটে। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর পরই দেশের সাংবাদিক সমাজ যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে, বিচার দাবি করে যাচ্ছে, স্বাধীনতা-উত্তর নিহত অন্য সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। অথচ এমনটিই ছিল খুব প্রত্যাশিত। এখন সাংবাদিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং বিলম্বে হলেও এ ব্যাপারটি তাদের চরম বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাতেও কিছু আসে-যায়নি সরকার, পুলিশসহ অন্য আইনি সংস্থাগুলোর। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বক্তব্যও একেকজনের একেক রকম এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্ববিরোধী বক্তব্য ও জনপ্রশংসা লাভের স্বার্থে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি আমাদের শুনতে হচ্ছে বিস্ময়করভাবে। এখন আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত কি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অন্ধকারে তলিয়ে যাবে? প্রসঙ্গক্রমে নিকট অতীতে সংঘটিত আরো কয়েকটি ঘটনা স্মরণে আনা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী রুমানার স্বামী হাসান সাঈদ স্ত্রীর চোখ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য সমাজের সব মহল থেকে ঘৃণিত-নিন্দিত হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলের বাথরুমে লাশ হয়ে পড়ে থাকার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। মনে পড়ে, রাজনীতিক নুরুল ইসলামের কথা, যিনি নিজ বাসভবনে অগি্নদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন এবং সে রহস্যও আমাদের আইনি সংস্থার লোকজন উন্মোচন করতে পারেনি। আরো মনে পড়ে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাটি- যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কূটনীতিক হত্যাকাণ্ড। ওই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিদেশি সংস্থার দ্বারস্থ হতে হলো। উলি্লখিত কোনো ঘটনাই মামুলি নয় এবং এর বাইরেও রয়েছে অনেক ঘটনা। আমাদের আইনি সংস্থাগুলোর এসব ব্যর্থতা জাতীয় লজ্জাও বটে। শোনা যায়, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থায় অনেক চৌকস গোয়েন্দা আছেন, উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শে তারা তদন্ত কাজেও নাকি আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। কিন্তু এর পরও তাদের ধারাবাহিক অক্ষমতা, অদক্ষতার বিষয়গুলো অবশ্যই অন্তহীন প্রশ্নের জন্ম দেয়।
আসা যাক বিলম্বিত বিচার প্রসঙ্গে। সুষ্ঠু তদন্ত ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্যতম বড় কিংবা অপরিহার্য বিষয়। দেশের আদালতে মামলাজট যেভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, এর পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান আছে বটে, কিন্তু যথাযথভাবে তদন্ত শেষে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ার বিরূপ প্রভাবও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করার দাবি রাখে। আদালতে মামলার নথিপত্রের পাহাড় জমে যাচ্ছে। বছরের পর বছর বিচারপ্রার্থী অপেক্ষা করছেন, কখন বিচারের রায় ঘোষিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফাইলের নিচ থেকে সেই মামলাটি আদালতে যাওয়া সম্পর্কে কেউই যেন কিছু বলতে পারছেন না! হাইকোর্টে প্রায় সোয়া তিন লাখ মামলা জমে আছে এবং সেগুলো যদি একের পর এক মীমাংসা করার দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা হলেও সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ বছর। অন্যদিকে এ সংখ্যা যতই কমানোর চেষ্টা হোক না কেন, চক্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় নতুন মামলা যোগ হওয়ার কারণে কার্যত তা বাড়তেই থাকবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষেত্রেই যখন অবস্থা এমন, তখন সারা দেশের নিম্ন আদালতগুলোর মামলাজট নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। এর মধ্যে যেমন আছে ফৌজদারি অপরাধের মামলা, তেমনি আছে অর্থবিত্ত বা জমিজমা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলাও। কে বলতে পারে, এর মধ্যে কতজন দুর্বল বিচারপ্রার্থী শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে না পেরে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন! কিংবা কতজন বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে মামলা চালনা থেকেই দূরে সরে গেছেন! আগেই বলেছি, আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার নানা দুর্বলতা নতুন কিছু নয় এবং এর সুযোগ নিয়ে বরাবরই প্রভাবশালী কিংবা ক্ষমতাবান অপশক্তি লাভবান হয়েছে, আর দুর্বলরা বঞ্চিত হয়েছে ন্যায়বিচার থেকে। দেশের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে মানুষের মধ্যে মতানৈক্য, মতভেদ, অনাচার, অবিচার, জিঘাংসা অনেক বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারই তদন্ত কার্যক্রমের বিবর্ণ চিত্র, মামলার জট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে চলেছে, নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, মাঝেমধ্যে উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপও নিচ্ছে; কিন্তু এ সবই সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। বিচারকের স্বল্পতা কাটানোর লক্ষ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। এর জন্যও সব সরকারই কমবেশি দায়ী। তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি কিংবা করছে না অথবা পূর্বাপর না ভেবেই এমন সব কাজ করা হয়েছে, যা সংকট নিরসন না করে উপরন্তু প্রকট করেছে। ঢাকার আদালতে এখনো নাকি এজলাস ভাগ করে চলে বিচার! এজলাস সংকটের বিষয়টিও পুরনো। ঢাকায় কয়েক ধরনের আদালত রয়েছে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, মহানগর দায়রা আদালত, মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ও মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল পাঁচটি, বিশেষ জজ আদালত ছয়টি, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল চারটি এবং একটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, পরিবেশ আদালত ও পরিবেশ আপিল আদালত রয়েছে। এসব আদালতের পৃথক কোনো ভবন নেই। জেলা জজশিপের বিভিন্ন কক্ষে এসব আদালতের বিচারকাজ চালানো হয়। অনেক আদালতেই নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র এবং আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, মামলার নথিপত্র সংরক্ষণের মতো ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিরাপদে রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই।
মামলাজট কমাতে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কথা এসেছিল গুরুত্বসহকারেই। ফৌজদারি মামলা দায়েরের পর তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইনে সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর পাশাপাশি কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও অত্যন্ত প্রকট। মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য অভিযোগ আছে আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও, তবে এ অভিযোগ ঢালাও নয়। পেশাদার ও দক্ষ তদন্তকারী সংস্থার কথা আগেই বলা হয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে সমন জারি, সাক্ষী, পরীক্ষা ও স্বীকারোক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা, বিনা পরোয়ানায় আটকের ক্ষেত্রে নানা অসংগতি ইত্যাদি। বিচার বিভাগ পৃৃথককরণের পর কয়েক বছর কেটে গেলেও অনেক সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। এক সমীক্ষায় প্রকাশ, উচ্চ আদালতসহ সারা দেশের নিম্ন আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। দুর্বল হোক আর সবলই হোক, কোনো বিচারপ্রার্থীই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত যেন না হন, এটি অবশ্যই স্বাভাবিক জনপ্রত্যাশা। জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব যেমন বিচার বিভাগের, তেমনি বিচার বিভাগকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এসব দ্রুত নিশ্চিত করা না গেলে জনহতাশা আরো বাড়বে, আইনের শাসন বিঘি্নত হবে এবং সমাজে নানা রকম অশুভ ছায়ার বিস্তার ঘটবে, যা শান্তিপ্রিয় এবং শুভবোধসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। একটি কথা তো সত্য, দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার ওপরই নির্ভর করে একটি দেশ ও দেশের বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি। একটি স্থিতিশীল সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য- এ সত্যের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় নিকট অতীতে সংঘটিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। ৪৮ ঘণ্টা দূরে থাক, ৪৮ দিন পরও ওই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করা যায়নি। এ রকম স্পর্শকাতর ঘটনা আরো অনেক আছে এবং সেগুলোর চিত্রও হতাশার ছায়ায় ঢাকা। এসব ক্ষেত্রে আইনি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সরকারি অন্য প্রশাসনের যোগ্যতার চিত্রটিও বড় বেশি বিবর্ণ হিসেবে ফুটে উঠছে, যা চরম অশুভ বার্তাও বটে। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর পরই দেশের সাংবাদিক সমাজ যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছে, বিচার দাবি করে যাচ্ছে, স্বাধীনতা-উত্তর নিহত অন্য সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। অথচ এমনটিই ছিল খুব প্রত্যাশিত। এখন সাংবাদিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এবং বিলম্বে হলেও এ ব্যাপারটি তাদের চরম বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাতেও কিছু আসে-যায়নি সরকার, পুলিশসহ অন্য আইনি সংস্থাগুলোর। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বক্তব্যও একেকজনের একেক রকম এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের স্ববিরোধী বক্তব্য ও জনপ্রশংসা লাভের স্বার্থে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি আমাদের শুনতে হচ্ছে বিস্ময়করভাবে। এখন আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত কি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি অন্ধকারে তলিয়ে যাবে? প্রসঙ্গক্রমে নিকট অতীতে সংঘটিত আরো কয়েকটি ঘটনা স্মরণে আনা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী রুমানার স্বামী হাসান সাঈদ স্ত্রীর চোখ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য সমাজের সব মহল থেকে ঘৃণিত-নিন্দিত হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলের বাথরুমে লাশ হয়ে পড়ে থাকার রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। মনে পড়ে, রাজনীতিক নুরুল ইসলামের কথা, যিনি নিজ বাসভবনে অগি্নদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন এবং সে রহস্যও আমাদের আইনি সংস্থার লোকজন উন্মোচন করতে পারেনি। আরো মনে পড়ে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলীর দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাটি- যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কূটনীতিক হত্যাকাণ্ড। ওই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিদেশি সংস্থার দ্বারস্থ হতে হলো। উলি্লখিত কোনো ঘটনাই মামুলি নয় এবং এর বাইরেও রয়েছে অনেক ঘটনা। আমাদের আইনি সংস্থাগুলোর এসব ব্যর্থতা জাতীয় লজ্জাও বটে। শোনা যায়, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থায় অনেক চৌকস গোয়েন্দা আছেন, উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শে তারা তদন্ত কাজেও নাকি আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। কিন্তু এর পরও তাদের ধারাবাহিক অক্ষমতা, অদক্ষতার বিষয়গুলো অবশ্যই অন্তহীন প্রশ্নের জন্ম দেয়।
আসা যাক বিলম্বিত বিচার প্রসঙ্গে। সুষ্ঠু তদন্ত ন্যায়বিচারের স্বার্থে অন্যতম বড় কিংবা অপরিহার্য বিষয়। দেশের আদালতে মামলাজট যেভাবে প্রকট হয়ে উঠছে, এর পেছনে নানা কারণ বিদ্যমান আছে বটে, কিন্তু যথাযথভাবে তদন্ত শেষে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়ার বিরূপ প্রভাবও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করার দাবি রাখে। আদালতে মামলার নথিপত্রের পাহাড় জমে যাচ্ছে। বছরের পর বছর বিচারপ্রার্থী অপেক্ষা করছেন, কখন বিচারের রায় ঘোষিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফাইলের নিচ থেকে সেই মামলাটি আদালতে যাওয়া সম্পর্কে কেউই যেন কিছু বলতে পারছেন না! হাইকোর্টে প্রায় সোয়া তিন লাখ মামলা জমে আছে এবং সেগুলো যদি একের পর এক মীমাংসা করার দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা হলেও সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ বছর। অন্যদিকে এ সংখ্যা যতই কমানোর চেষ্টা হোক না কেন, চক্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় নতুন মামলা যোগ হওয়ার কারণে কার্যত তা বাড়তেই থাকবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষেত্রেই যখন অবস্থা এমন, তখন সারা দেশের নিম্ন আদালতগুলোর মামলাজট নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। এর মধ্যে যেমন আছে ফৌজদারি অপরাধের মামলা, তেমনি আছে অর্থবিত্ত বা জমিজমা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলাও। কে বলতে পারে, এর মধ্যে কতজন দুর্বল বিচারপ্রার্থী শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে না পেরে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন! কিংবা কতজন বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে মামলা চালনা থেকেই দূরে সরে গেছেন! আগেই বলেছি, আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থার নানা দুর্বলতা নতুন কিছু নয় এবং এর সুযোগ নিয়ে বরাবরই প্রভাবশালী কিংবা ক্ষমতাবান অপশক্তি লাভবান হয়েছে, আর দুর্বলরা বঞ্চিত হয়েছে ন্যায়বিচার থেকে। দেশের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে মানুষের মধ্যে মতানৈক্য, মতভেদ, অনাচার, অবিচার, জিঘাংসা অনেক বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারই তদন্ত কার্যক্রমের বিবর্ণ চিত্র, মামলার জট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে চলেছে, নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, মাঝেমধ্যে উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপও নিচ্ছে; কিন্তু এ সবই সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। বিচারকের স্বল্পতা কাটানোর লক্ষ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। এর জন্যও সব সরকারই কমবেশি দায়ী। তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি কিংবা করছে না অথবা পূর্বাপর না ভেবেই এমন সব কাজ করা হয়েছে, যা সংকট নিরসন না করে উপরন্তু প্রকট করেছে। ঢাকার আদালতে এখনো নাকি এজলাস ভাগ করে চলে বিচার! এজলাস সংকটের বিষয়টিও পুরনো। ঢাকায় কয়েক ধরনের আদালত রয়েছে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত, মহানগর দায়রা আদালত, মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ও মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল পাঁচটি, বিশেষ জজ আদালত ছয়টি, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল চারটি এবং একটি ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, পরিবেশ আদালত ও পরিবেশ আপিল আদালত রয়েছে। এসব আদালতের পৃথক কোনো ভবন নেই। জেলা জজশিপের বিভিন্ন কক্ষে এসব আদালতের বিচারকাজ চালানো হয়। অনেক আদালতেই নেই পর্যাপ্ত আসবাবপত্র এবং আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, মামলার নথিপত্র সংরক্ষণের মতো ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিরাপদে রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই।
মামলাজট কমাতে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কথা এসেছিল গুরুত্বসহকারেই। ফৌজদারি মামলা দায়েরের পর তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইনে সময় বেঁধে দেওয়া থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর পাশাপাশি কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও অত্যন্ত প্রকট। মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য অভিযোগ আছে আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও, তবে এ অভিযোগ ঢালাও নয়। পেশাদার ও দক্ষ তদন্তকারী সংস্থার কথা আগেই বলা হয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে সমন জারি, সাক্ষী, পরীক্ষা ও স্বীকারোক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতা, বিনা পরোয়ানায় আটকের ক্ষেত্রে নানা অসংগতি ইত্যাদি। বিচার বিভাগ পৃৃথককরণের পর কয়েক বছর কেটে গেলেও অনেক সমস্যার এখনো সমাধান হয়নি। এক সমীক্ষায় প্রকাশ, উচ্চ আদালতসহ সারা দেশের নিম্ন আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। দুর্বল হোক আর সবলই হোক, কোনো বিচারপ্রার্থীই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত যেন না হন, এটি অবশ্যই স্বাভাবিক জনপ্রত্যাশা। জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব যেমন বিচার বিভাগের, তেমনি বিচার বিভাগকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এসব দ্রুত নিশ্চিত করা না গেলে জনহতাশা আরো বাড়বে, আইনের শাসন বিঘি্নত হবে এবং সমাজে নানা রকম অশুভ ছায়ার বিস্তার ঘটবে, যা শান্তিপ্রিয় এবং শুভবোধসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। একটি কথা তো সত্য, দ্রুততম সময়ে ন্যায়বিচার পাওয়ার ওপরই নির্ভর করে একটি দেশ ও দেশের বিচারব্যবস্থার ভাবমূর্তি। একটি স্থিতিশীল সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য- এ সত্যের মধ্যে কোনো ফাঁক নেই।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments