গণমাধ্যম-উইকিলিকস—জনগণের গোয়েন্দা সংস্থা by জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ

যে কালে বড় মাপের গণ-অভ্যুত্থান ঘটে চলেছে, তখন বিপরীত রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অনুসারী অভিজাতেরা প্রতিপক্ষকে যতটা না ভয় পেত তারও চেয়ে বেশি ভয় পেত সাধারণ জনগণকে। সে কালে উদীয়মান বণিক শ্রেণী হয়তো অধিকতর ঐতিহ্যবাহী, অভিজাত বংশের বিরোধিতা করেছে।


তবে উভয় পক্ষের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল র্যাডিকেল প্রকাশকেরা। কেননা, জনগণকে এরা এমনভাবে আন্দোলিত করছিল, যেখান থেকে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া ছিল অসম্ভব। তেমন বর্ণনাই উঠে এসেছে এক লেখকের রচনায়, ‘সরকার-বিষয়ক সব গূঢ় রহস্য, রাজা ও পার্লামেন্ট-বিষয়ক সব গুপ্তকথা এরা চাষাভুষা, ইতর জনগণকে জানিয়ে দিচ্ছে (শূকরের সামনে মুক্তো দেওয়ার মতোই মূল্যবান বস্তু দেওয়া হচ্ছে এমন মানুষকে, যারা তার কদর বোঝে না), আর সেসব বিষয়ের এত গভীরে দৃষ্টি দেওয়ার শিক্ষা দিচ্ছে সেনাদল ও জনগণকে যেন তারা সব সরকারকে বিপাকে ফেলে, প্রকৃতির আদি রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে তারা জনগণকে এত উৎসুক ও উদ্ধত বানিয়ে ফেলেছে যে তারা আর কখনো কোনো সভ্য শাসনের অধীনে থাকার মতো যথেষ্ট বিনয়ী হবে না।’
যদিও আজকের তিউনিশিয়া, মিসর এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি উল্লিখিত কথাগুলোর মাধ্যমে সহজেই বর্ণনা করা যায়, আসলে কিন্তু কথাগুলো রচিত হয়েছিল ১৬৬১ সালে। লেখক ক্লেমেন্ট ওয়াকার। বিষয় ১৬৪০-এর দশকে ইংরেজ গৃহযুদ্ধের সময়ে জনপ্রিয় চরমপন্থা।
প্রকাশনার ইতিহাস এবং জনগণ কী পড়তে পারবে, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপের ইতিহাসে সময়কালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারও ২০০ বছর আগেই ছাপাখানা আবিষ্কৃত হয়েছে। তত দিনে ছাপাখানার অভিগম্যতাও বেড়েছে। আর ডাকব্যবস্থা সৃষ্টির ফলে পশ্চিম ইউরোপজুড়ে প্রথম দিককার সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। ‘বিতরণ পদ্ধতিকে চালিত করে প্রযুক্তি’—আজকের এই প্রবচনের বহু দৃষ্টান্তের দেখা মিলবে ইতিহাস ঘাঁটলে।
গৃহযুদ্ধের সময়কালে শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত ছাপাখানার মালিক ও পুস্তকবিক্রেতারাই পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন না, পাশাপাশি ততটা মর্যাদাসম্পন্ন নন, এমন পেশার মানুষও নিজেদের পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন। ১৬৪০-এর দশকে জন ডিলিংহাম নামের এক দর্জি মডারেট ইন্টেলিজেন্সার নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন চার বছর ধরে। তাতে স্থান পায় গৃহযুদ্ধে কী ঘটছে সেসব খবরাখবর। (সংঘর্ষের খবর পরিবেশনে পরিমিতি বজায় রাখার চেষ্টার ফলে কিছু দিনের মধ্যেই গিলবার্ট ম্যাবটের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হয় তাঁকে। ম্যাবট তখন ছাপাখানার লাইসেন্স প্রদানের দায়িত্বে। অলিভার ক্রমওয়েলের প্রকাশ্য সমর্থক কোনো পত্রিকাকে ইন্টেলিজেন্সার-এর জায়গায় নিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন ম্যাবট।)
প্রচারণাধর্মী পুস্তিকা, পাণ্ডুলিপি ও ছোট ছোট নিউজলেটারও নিয়মিত প্রকাশিত হতো। তাতে রচয়িতার ভাবনাচিন্তার প্রতিফলন ঘটত। অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্যে তখন এমন ভাবনাও দেখা দিয়েছিল, জনগণ (ওয়াকারের বর্ণনা অনুসারে) ধীরে ধীরে এত উৎসুক ও উদ্ধত হয়ে পড়ছে যে তারা অধীনতার জন্য যথেষ্ট বিনয়ী আর থাকবে না কোনো দিন—এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
আজ এক ছোট সংগঠন হিসেবে উইকিলিকস সে সব র্যাডিকেল প্রকাশনার ঐতিহ্যের ভেতরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, যারা ‘সরকার-বিষয়ক সব গূঢ় রহস্য’ জনগণের সামনে হাজির করতে সচেষ্ট। বাস্তব পরিস্থিতির কারণে কতগুলো বৃহৎ মিডিয়াগোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা কাজ করেছি, তবে ৫০টি আঞ্চলিক প্রকাশনা, অ্যাকটিভিস্ট গোষ্ঠী ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান পর্যন্তও বিস্তৃত করেছি সহযোগিতার সম্পর্ক—তাদের রাষ্ট্র এবং কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত শত শত, কিংবা কিছু ক্ষেত্রে হাজার হাজার, দলিল আগেভাগে যেন তারা দেখতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব জনপ্রিয় সংবাদপত্রের বিস্তার ঘটে, তাদের আদর্শের প্রতিও সৎ থেকেছে উইকিলিকস। মার্কিন চতুর্থ স্তম্ভের চমৎকার ব্যবচ্ছেদ হিসেবে গণ্য রুথলেস ক্রিটিসিজম বইতে ইতিহাসবিদ জন বেক্কেন দেখাচ্ছেন, ‘একসময় কয়েক ডজন ভাষায় শত শত পত্রিকা প্রকাশিত হতো। তাতে যেমন ছিল শ্রমজীবীদের রাজনৈতিক সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত আঞ্চলিক ও স্থানীয় দৈনিক, তেমনি ছিল পারস্পরিক সহায়তা সংস্থা এবং জাতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা।’
এসব সংবাদপত্রের ভূমিকা শুধু খবর পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ থাকত না, বেক্কেনের ভাষায় এরা এমন একটা জায়গা তৈরি করত, যেখানে পাঠকেরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে পারত। প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের প্রতিষ্ঠানগুলো কী কাজ করছে, পাঠক তা জানতে পারত এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরে সমর্থন জোগাতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা যেত।
এখন ব্লগ-বিশ্বকে জনগণের চিন্তাভাবনার বৈচিত্র্য প্রতিফলিত করার ক্ষেত্র হিসেবে যথার্থভাবেই গণ্য করা হয়। তবে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক গণমাধ্যমের ধারণা পেতে ফিরে যেতে হবে সেসব শ্রমজীবী প্রকাশনার ঐতিহ্যে। উদাহরণ দিয়ে বলছি, ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সম্পাদক মিলে একটি কো-অপারেটিভ খবর-সংগ্রহ সংস্থা গঠন করেন। নাম ফেডারেটেড প্রেস। উদ্দেশ্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব মোকাবিলা। ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত উদ্যোগটি জারি ছিল, মোটামুটি ১৫০টি প্রকাশনা তাদের সেবা নিত।
সেই সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের নিজস্ব সংবাদমাধ্যম প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিল। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সর্ববৃহৎ বামপন্থী জার্নাল অ্যাপিল টু রিজন-এর সাপ্তাহিক প্রচারসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখ।
কিন্তু ইউরোপে যখন শ্রেণীসংঘাত তীব্র হয়ে উঠল, তখন প্রতিষ্ঠিত মহল এসব প্রকাশনা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাল। মার্কিন মুলুকে ১৯১৭ সালে গুপ্তচরবৃত্তি আইনে যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ যুক্তি প্রদর্শনও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলো। ইউজিন ডেবস হলেন প্রথম দিককার অন্যতম ভিকটিম। তিনি আমেরিকান সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা। ১৯১৮ সালে এই শ্রমিক নেতাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় শান্তির পক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে। ১০ বছরের সাজা হয় তাঁর।
নিউইয়র্ক টাইমস দুই দশক ধরে নিজ চরিত্রের সঙ্গে সংগতি রেখে ডেবসকে শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। ১৮৯৪ সালের ৯ জুলাই এক সম্পাদকীয়তে পত্রিকাটি লিখে, ‘ডেবস আইন ভঙ্গকারী, মানবজাতির শত্রু। তাঁর বিরুদ্ধে পরোয়ানা থাকা এবং তাঁকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে ম্যালা কথা হয়েছে।’
পত্রিকাটিতে আরও বলা হয়, ‘এখন বাচালতা ত্যাগ করে কাজ শুরু করার সময় এসেছে। যদি ডেবসের আশপাশে কোনো কারাগার থেকে থাকে, তাহলে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া উচিত। এবং তাঁর দেওয়া কুশিক্ষার ফলে যে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা অবশ্যই দমন করতে হবে ...মনে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো বন্ধু এ দেশের সেনাদের হাতে কোনো দিন মারা পড়েনি—মরেছে শুধু শত্রুরা।’
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণের আগে নিউইয়র্ক টাইমস-এর নৈপুণ্য এবং আজ উইকিলিকসের বিরুদ্ধে তাদের বৈরী আচরণ কোনোটাই বিস্ময়কর লাগে না। সরকারের বৈরী মনোভাবের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রিয় প্রকাশকদের মোকাবিলা করতে হয় রাজস্বের উৎস হিসেবে বিজ্ঞাপনী বাস্তবতা। বিশ্লেষক জেমস কারেনের মতে, বিশ শতকের প্রথম দিকের ব্রিটিশ সংবাদপত্র ডেইলি হেরাল্ড-এর পাঠকসংখ্যা টাইমস, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও গার্ডিয়ান-এর মিলিত পাঠকসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ ছিল। পত্রিকাটি ১৯৬৪ সালে প্রকাশনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রচারিত ২০টি দৈনিকের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও এর প্রধান পাঠক শ্রমজীবী জনগণ হওয়ায় এটি লোভনীয় বিজ্ঞাপনী বাজার গড়ে তুলতে পারেনি।
বিজ্ঞাপন ঘাটতির আরেক শিকার উদারপন্থী নিউজ ক্রনিক্যাল। ১৯৬০ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়—ডানপন্থী ডেইলি মেইল-এ আত্তীকৃত হয়। যদিও পত্রিকাটির প্রচারসংখ্যা ছিল গার্ডিয়ান-এর ছয় গুণেরও বেশি।
বিজ্ঞাপনের ওপর উইকিলিকসের এই নির্ভরতা নেই, সত্য। বরং প্রকাশনা হিসেবে আমাদের আরেক ধরনের আর্থিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। ব্যাংক অব আমেরিকা, ভিসা (লন্ডনে রেজিস্ট্রিকৃত ভিসা ইউরোপসহ), মাস্টারকার্ড, পেপাল, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, সুইস পোস্টফিন্যান্স, মানিবুকারস ও অন্যান্য আর্থিক কোম্পানির আইনবহির্ভূত আর্থিক অবরোধ আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব? এসব কোম্পানি তো ওয়াশিংটনের কৃপাধন্য থাকতে মরিয়া।
ইতিহাসের দীর্ঘ পথে চোখ রাখলে দেখা যায়, উইকিলিকসের অবস্থান সেই সম্মানিত ঐতিহ্যের ভেতরে যা স্বাধীনতার সুযোগ বিস্তৃত করে, জনগণের সামনে ‘সরকারের সব গূঢ় রহস্য’ উন্মোচন করার চেষ্টা চালানোর মাধ্যমে। এক অর্থে, গণমাধ্যম আসলে যা হওয়া উচিত—জনগণের গোয়েন্দা সংস্থা, শূকরের সামনে যে মুক্তা দেয়—উইকিলিকস তার-ই বিশুদ্ধ অভিব্যক্তি।

নিউ স্টেটসম্যান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ: উইকিলিকসের এডিটর-ইন-চিফ।

No comments

Powered by Blogger.