ক্লাব ক্রিকেট নাকি রাজনীতি? by তারেক মাহমুদ
জেমি সিডন্সের বিস্মিত কণ্ঠটা এখনো কানে বাজে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর ঢাকার দুই বড় ক্লাব আবাহনী-মোহামেডানের অনুশীলন দেখতে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান কোচ। দেখলেন এবং যারপরনাই হতাশ হলেন। এও কি সম্ভব? টেস্ট খেলুড়ে একটা দেশের সেরা ক্লাবগুলোর নিজস্ব অনুশীলনসুবিধা নেই! নেই জিমনেসিয়াম,
ফিজিও-ট্রেনার! খেলোয়াড়েরা পানি খাচ্ছেন বালতি থেকে! বিস্ময়টা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশও করলেন। ক্লাব কর্মকর্তাদের মুখে খই ফুটল—ঠিকই তো বলেছেন কোচ। সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে।
বাংলাদেশে চার বছর কাটিয়ে সিডন্স চলে গেছেন নতুন কাজে। ঢেলে আর সাজানো হয়নি। ঢাকার ক্রিকেট যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। বরং বাংলাদেশে থাকলে সিডন্স এখন দেখতেন, ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধার বালাই না থাকলেও এ দেশের ক্লাব ক্রিকেটের পরাশক্তিরা মাঠের বাইরেও কেমন ক্ষমতাধর। মাঠের মতো মাঠের বাইরের খেলার জন্যও কী দারুণ ‘গেমপ্ল্যান’! যার অন্য নাম ক্লাব রাজনীতি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে নাকি ক্লাবগুলোর অনেক অবদান। ‘অনেক’ শব্দটার অনেক রকম মানে। তার চেয়ে আসুন সুনির্দিষ্টভাবে জানার চেষ্টা করি, ক্লাবের অবদান এ দেশের ক্রিকেটে আসলে কী রকম।
টেস্ট মর্যাদা-পূর্ব সময়ে ক্লাব ক্রিকেট আসলেই একটা ব্যাপার ছিল বাংলাদেশে। আবাহনী-মোহামেডান নামে উন্মাতাল ছিল দেশ। গ্যালারিতে দর্শক টানত দুই ক্লাব, যে দর্শকেরা ছিল এ দেশের ক্রিকেট সম্ভাবনার সত্যিকারের বিজ্ঞাপন। আইসিসির টেবিলে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে বোঝানো হলো, দেখো, কত দর্শক! বাংলাদেশ ক্রিকেটের কী সুবিশাল বাজার। ক্লাব ক্রিকেট ক্রিকেটারদেরও কম উপকার করছে না। দলবদলের বাজারে এখন টাকা ওড়ে। দেশের ক্রিকেটারদের বড় একটা অংশের আয়ের প্রধান উৎস ঢাকা লিগ। কিন্তু এটা হওয়ার কথা নয় যদি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটটা সত্যিকার পেশাদারিভাবে চালু করা যেত এ দেশে। জাতীয় লিগের গায়ে এখনো পিকনিক-পিকনিক গন্ধ। নামমাত্র টাকায় খেললে যেভাবে একটা খেলা খেলতে হয়, ক্রিকেটারদের কাছে তার বেশি মূল্য নেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের।
মাঠে দর্শক আনা, খেলোয়াড়দের আয়—এসব চিন্তা করলে ক্লাব ক্রিকেট শুরুর দিকে এ দেশের ক্রিকেটের এক্সেলেটরে একটা চাপ দিয়েছিল বটে। কিন্তু সেই গতি বাড়তে বাড়তে এখন এমন পর্যায়ে, এক্সেলেটর চাপাচাপির বোধহয় আর দরকার নেই। স্টিয়ারিং ঘোরানোটা ঠিকঠাকভাবে হওয়াই জরুরি। সেটা না হলে গতির ঝড় দুর্ঘটনাই ঘটাবে।
সে রকমই এক দুর্ঘটনায় এবার একেবারেই থেমে গেল ক্লাব ক্রিকেটের গতি। থামিয়ে দিলেন তাঁরাই, যাঁরা বলতে পছন্দ করেন, ক্লাব ক্রিকেট দেশের ক্রিকেটের প্রাণভোমরা। ক্লাব ক্রিকেট বাঁচলে তো দেশের ক্রিকেট বাঁচবে। প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা দেশের ক্রিকেট বেশ বাঁচাচ্ছেন! কে জানে, হয়তো এটাই হওয়া উচিত। এটাই বাঁচার পথ বাংলাদেশের ক্রিকেটের। ক্লাব ক্রিকেট হলে দেশের ক্রিকেট স্থবির হয়ে পড়ে। ক্লাব ক্রিকেট না হলেও কী হয়, সেটাও বুঝি দেখার সময় হলো।
ক্লাব রাজনীতির অভিশাপে এবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ বন্ধ হয়েছে পাঁচবার। বারবার ছেদ পড়েছে দেশের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও। ক্লাব স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি গেছে দেশের স্বার্থ। ‘এ’ দলের খেলোয়াড় তালিকা করার আগে প্রিমিয়ার লিগের সূচি নিয়ে বসেছেন নির্বাচকেরা। কোন ক্লাবের খেলোয়াড় নিলে কোন ক্লাবের ক্ষতি, সেসব সমীকরণ এড়িয়ে অতিসতর্ক থেকে গড়েছেন দল। ক্ষমতাশালী ক্লাবের স্বার্থ রক্ষায় বাইলজ কখনো রক্ষাকবচ, কখনো বা মূল্যহীন। সবলের অত্যাচারে কোণঠাসা দুর্বল দলকে বাইলজ দেখায় অবনমনের দরজা। আবার বড় দল-বড় দল যুদ্ধে সেই বাইলজই কয়েক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ মাত্র! ক্রিকেটাররা কিছু না। তারা বসে বসে ঝিমায়।
প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে এখন চলছে আবাহনী-ভিক্টোরিয়া-মোহামেডান ত্রিমুখী নাটক। একজন খেলোয়াড়ের নিবন্ধন বৈধ না অবৈধ—এ নিয়ে তর্ক একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেটকে অচল করে দিতে পারে, এ ঘটনা আর কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। কোনো কিছু নিয়ে মতবিরোধ হতেই পারে, সেটি মীমাংসা করার জন্য সিসিডিএম ছিল। সিসিডিএম আবাহনী-মোহামেডানের দাপটের কাছে অসহায় বলে বোর্ড সভাপতির শরণাপন্ন। এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বোর্ড সভার অনেকটা সময় ব্যয় হলো। তাতেও কোনো সমাধান নেই। বোর্ড সভাপতি চার সদস্যের এক কমিটি তৈরি করে ভারতে চলে গেলেন আইপিএল দেখতে। চার সদস্যের কমিটিও বেঁধে দেওয়া ২৪ ঘণ্টাকে ২৪ দিন বানিয়ে ফেলার শঙ্কা জাগিয়ে তুলল। বড় করে তুলল দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে বিসিবির পেশাদারি ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নও।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেটারদের সাফল্য সারা বিশ্বে দেশের নাম ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে সংগঠকদের ক্রিকেট পরিচালনা জোগাচ্ছে হাসির খোরাক। একসময় ক্রিকেটের উন্নতিতে ক্লাব ক্রিকেটের ভূমিকা ছিল। আর এখন সেটাই যেন উন্নতির পথে বাধা! টেস্ট খেলুড়ে কোনো দেশে ক্লাব ক্রিকেট অগ্রাধিকার তালিকায় কখনোই প্রথম দিকে স্থান পায় না। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনো আবাহনী-মোহামেডানের অঙ্গুলিহেলনে চলে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এই দুই দলের ভূমিকা নিয়েও এখন আলোচনার সময় হয়েছে। অনুশীলনসুবিধার দৈন্যের কথা তো আগেই বলা হলো। নতুন কোনো খেলোয়াড় তুলে আনায়ও কি বিন্দুমাত্র ভূমিকা আছে এই দুই ক্লাবের? না আছে কোনো যুব বা বয়সভিত্তিক দল, না আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত নিজস্ব মাঠ। দলবদলে কোটি কোটি টাকা ঢালতে কোনো দ্বিধা নেই, অথচ এসবের পেছনে সামান্য কিছু টাকা খরচ করতেও অনীহা!
দেশের ক্রিকেটে এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকায় ক্লাব ক্রিকেট! দোষটা ক্লাব বা ক্রিকেটের নয়, ক্লাব এবং ক্রিকেট যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের মানসিকতার। চার বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে যাওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে ডেভ হোয়াটমোর যৌক্তিক একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে। ‘এত ভালো একটা লিগ, কিন্তু কখন শুরু হয়, কখন বন্ধ হয়, কেন বন্ধ হয়—কিছুই বুঝতে পারি না’—হোয়াটমোরের কথার জবাবে তাঁকে জানানো হয়েছিল, ক্ষমতাধর ক্লাবগুলোই এখানে নিয়ন্তা। তাদের ইচ্ছামতোই সব হয়। হোয়াটমোর সহজ সমাধান দিয়েছিলেন—তা হলে ক্রিকেট বোর্ড এটি বন্ধ করে দিক। ক্লাবগুলো ক্রিকেট বোর্ডের আন্ডারে নাকি বোর্ড ক্লাবগুলোর আন্ডারে?
মজাটা তো এখানেই। বাংলাদেশে যাহা ক্লাব, তাহাই ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেট বোর্ডও চালান ক্লাব কর্মকর্তারাই। যে কারণে তুচ্ছ কারণে দিনের পর দিন প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ থাকে। বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় লিগ শেষ করাটাও হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।
জাতীয় লিগ? সেটি আবার কী জিনিস! এটির কথা আবার কে ভাবে! হ্যাঁ, জাতীয় লিগের কথাও আপনি মাঝেমধ্যে শুনবেন। বাংলাদেশ কোনো টেস্ট সিরিজে খারাপ করার পর খেলোয়াড়েরা দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের দুর্দশা নিয়ে কান্নাকাটি করবেন। সংবাদমাধ্যমেও বিস্তর লেখালেখি হবে, ঝড় উঠবে টেলিভিশনের টক শোতে। বোর্ড কর্মকর্তারা মাথা ঝাঁকাবেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা আমরা এবার ঢেলে সাজাবই।’
কদিন পরই সে কথা আর কারও মনে থাকবে না। ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তার চেয়ে ক্লাব কর্মকর্তা পরিচয়টাই যে তাঁদের কাছে বড় হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে চার বছর কাটিয়ে সিডন্স চলে গেছেন নতুন কাজে। ঢেলে আর সাজানো হয়নি। ঢাকার ক্রিকেট যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। বরং বাংলাদেশে থাকলে সিডন্স এখন দেখতেন, ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধার বালাই না থাকলেও এ দেশের ক্লাব ক্রিকেটের পরাশক্তিরা মাঠের বাইরেও কেমন ক্ষমতাধর। মাঠের মতো মাঠের বাইরের খেলার জন্যও কী দারুণ ‘গেমপ্ল্যান’! যার অন্য নাম ক্লাব রাজনীতি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে নাকি ক্লাবগুলোর অনেক অবদান। ‘অনেক’ শব্দটার অনেক রকম মানে। তার চেয়ে আসুন সুনির্দিষ্টভাবে জানার চেষ্টা করি, ক্লাবের অবদান এ দেশের ক্রিকেটে আসলে কী রকম।
টেস্ট মর্যাদা-পূর্ব সময়ে ক্লাব ক্রিকেট আসলেই একটা ব্যাপার ছিল বাংলাদেশে। আবাহনী-মোহামেডান নামে উন্মাতাল ছিল দেশ। গ্যালারিতে দর্শক টানত দুই ক্লাব, যে দর্শকেরা ছিল এ দেশের ক্রিকেট সম্ভাবনার সত্যিকারের বিজ্ঞাপন। আইসিসির টেবিলে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোকে বোঝানো হলো, দেখো, কত দর্শক! বাংলাদেশ ক্রিকেটের কী সুবিশাল বাজার। ক্লাব ক্রিকেট ক্রিকেটারদেরও কম উপকার করছে না। দলবদলের বাজারে এখন টাকা ওড়ে। দেশের ক্রিকেটারদের বড় একটা অংশের আয়ের প্রধান উৎস ঢাকা লিগ। কিন্তু এটা হওয়ার কথা নয় যদি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটটা সত্যিকার পেশাদারিভাবে চালু করা যেত এ দেশে। জাতীয় লিগের গায়ে এখনো পিকনিক-পিকনিক গন্ধ। নামমাত্র টাকায় খেললে যেভাবে একটা খেলা খেলতে হয়, ক্রিকেটারদের কাছে তার বেশি মূল্য নেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের।
মাঠে দর্শক আনা, খেলোয়াড়দের আয়—এসব চিন্তা করলে ক্লাব ক্রিকেট শুরুর দিকে এ দেশের ক্রিকেটের এক্সেলেটরে একটা চাপ দিয়েছিল বটে। কিন্তু সেই গতি বাড়তে বাড়তে এখন এমন পর্যায়ে, এক্সেলেটর চাপাচাপির বোধহয় আর দরকার নেই। স্টিয়ারিং ঘোরানোটা ঠিকঠাকভাবে হওয়াই জরুরি। সেটা না হলে গতির ঝড় দুর্ঘটনাই ঘটাবে।
সে রকমই এক দুর্ঘটনায় এবার একেবারেই থেমে গেল ক্লাব ক্রিকেটের গতি। থামিয়ে দিলেন তাঁরাই, যাঁরা বলতে পছন্দ করেন, ক্লাব ক্রিকেট দেশের ক্রিকেটের প্রাণভোমরা। ক্লাব ক্রিকেট বাঁচলে তো দেশের ক্রিকেট বাঁচবে। প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা দেশের ক্রিকেট বেশ বাঁচাচ্ছেন! কে জানে, হয়তো এটাই হওয়া উচিত। এটাই বাঁচার পথ বাংলাদেশের ক্রিকেটের। ক্লাব ক্রিকেট হলে দেশের ক্রিকেট স্থবির হয়ে পড়ে। ক্লাব ক্রিকেট না হলেও কী হয়, সেটাও বুঝি দেখার সময় হলো।
ক্লাব রাজনীতির অভিশাপে এবার প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ বন্ধ হয়েছে পাঁচবার। বারবার ছেদ পড়েছে দেশের একমাত্র প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও। ক্লাব স্বার্থের কাছে জলাঞ্জলি গেছে দেশের স্বার্থ। ‘এ’ দলের খেলোয়াড় তালিকা করার আগে প্রিমিয়ার লিগের সূচি নিয়ে বসেছেন নির্বাচকেরা। কোন ক্লাবের খেলোয়াড় নিলে কোন ক্লাবের ক্ষতি, সেসব সমীকরণ এড়িয়ে অতিসতর্ক থেকে গড়েছেন দল। ক্ষমতাশালী ক্লাবের স্বার্থ রক্ষায় বাইলজ কখনো রক্ষাকবচ, কখনো বা মূল্যহীন। সবলের অত্যাচারে কোণঠাসা দুর্বল দলকে বাইলজ দেখায় অবনমনের দরজা। আবার বড় দল-বড় দল যুদ্ধে সেই বাইলজই কয়েক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ মাত্র! ক্রিকেটাররা কিছু না। তারা বসে বসে ঝিমায়।
প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে এখন চলছে আবাহনী-ভিক্টোরিয়া-মোহামেডান ত্রিমুখী নাটক। একজন খেলোয়াড়ের নিবন্ধন বৈধ না অবৈধ—এ নিয়ে তর্ক একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেটকে অচল করে দিতে পারে, এ ঘটনা আর কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। কোনো কিছু নিয়ে মতবিরোধ হতেই পারে, সেটি মীমাংসা করার জন্য সিসিডিএম ছিল। সিসিডিএম আবাহনী-মোহামেডানের দাপটের কাছে অসহায় বলে বোর্ড সভাপতির শরণাপন্ন। এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বোর্ড সভার অনেকটা সময় ব্যয় হলো। তাতেও কোনো সমাধান নেই। বোর্ড সভাপতি চার সদস্যের এক কমিটি তৈরি করে ভারতে চলে গেলেন আইপিএল দেখতে। চার সদস্যের কমিটিও বেঁধে দেওয়া ২৪ ঘণ্টাকে ২৪ দিন বানিয়ে ফেলার শঙ্কা জাগিয়ে তুলল। বড় করে তুলল দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা হিসেবে বিসিবির পেশাদারি ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নও।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেটারদের সাফল্য সারা বিশ্বে দেশের নাম ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে সংগঠকদের ক্রিকেট পরিচালনা জোগাচ্ছে হাসির খোরাক। একসময় ক্রিকেটের উন্নতিতে ক্লাব ক্রিকেটের ভূমিকা ছিল। আর এখন সেটাই যেন উন্নতির পথে বাধা! টেস্ট খেলুড়ে কোনো দেশে ক্লাব ক্রিকেট অগ্রাধিকার তালিকায় কখনোই প্রথম দিকে স্থান পায় না। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনো আবাহনী-মোহামেডানের অঙ্গুলিহেলনে চলে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এই দুই দলের ভূমিকা নিয়েও এখন আলোচনার সময় হয়েছে। অনুশীলনসুবিধার দৈন্যের কথা তো আগেই বলা হলো। নতুন কোনো খেলোয়াড় তুলে আনায়ও কি বিন্দুমাত্র ভূমিকা আছে এই দুই ক্লাবের? না আছে কোনো যুব বা বয়সভিত্তিক দল, না আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত নিজস্ব মাঠ। দলবদলে কোটি কোটি টাকা ঢালতে কোনো দ্বিধা নেই, অথচ এসবের পেছনে সামান্য কিছু টাকা খরচ করতেও অনীহা!
দেশের ক্রিকেটে এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভূমিকায় ক্লাব ক্রিকেট! দোষটা ক্লাব বা ক্রিকেটের নয়, ক্লাব এবং ক্রিকেট যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের মানসিকতার। চার বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে যাওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে ডেভ হোয়াটমোর যৌক্তিক একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে। ‘এত ভালো একটা লিগ, কিন্তু কখন শুরু হয়, কখন বন্ধ হয়, কেন বন্ধ হয়—কিছুই বুঝতে পারি না’—হোয়াটমোরের কথার জবাবে তাঁকে জানানো হয়েছিল, ক্ষমতাধর ক্লাবগুলোই এখানে নিয়ন্তা। তাদের ইচ্ছামতোই সব হয়। হোয়াটমোর সহজ সমাধান দিয়েছিলেন—তা হলে ক্রিকেট বোর্ড এটি বন্ধ করে দিক। ক্লাবগুলো ক্রিকেট বোর্ডের আন্ডারে নাকি বোর্ড ক্লাবগুলোর আন্ডারে?
মজাটা তো এখানেই। বাংলাদেশে যাহা ক্লাব, তাহাই ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেট বোর্ডও চালান ক্লাব কর্মকর্তারাই। যে কারণে তুচ্ছ কারণে দিনের পর দিন প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ থাকে। বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়া জাতীয় লিগ শেষ করাটাও হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।
জাতীয় লিগ? সেটি আবার কী জিনিস! এটির কথা আবার কে ভাবে! হ্যাঁ, জাতীয় লিগের কথাও আপনি মাঝেমধ্যে শুনবেন। বাংলাদেশ কোনো টেস্ট সিরিজে খারাপ করার পর খেলোয়াড়েরা দেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের দুর্দশা নিয়ে কান্নাকাটি করবেন। সংবাদমাধ্যমেও বিস্তর লেখালেখি হবে, ঝড় উঠবে টেলিভিশনের টক শোতে। বোর্ড কর্মকর্তারা মাথা ঝাঁকাবেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটটা আমরা এবার ঢেলে সাজাবই।’
কদিন পরই সে কথা আর কারও মনে থাকবে না। ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তার চেয়ে ক্লাব কর্মকর্তা পরিচয়টাই যে তাঁদের কাছে বড় হয়ে উঠবে।
No comments