যুক্তি তর্ক গল্প-সুনামির সূত্রে ‘উন্নয়ন’ নিয়ে উদ্বেগ by আবুল মোমেন
ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামির ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, তাহলে প্রকৃতির শক্তির কাছে মানুষের সব উদ্ভাবনা ও নির্মাণ তথা বুদ্ধি ও কুশলতা নিতান্তই তুচ্ছ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ পরিচিত। এ কারণে নিতান্ত কম ভোগান্তি পোহাতে হয় না আমাদের।
তা সত্ত্বেও আমরা দেখি মানুষ কী সাহস, দক্ষতা, সৃজনশীলতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায়। কবির ভাষায়, জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়। সেখানে মানুষের সংগ্রামশীলতা ও দুর্জয় সৃজনশীলতার পরিচয় পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হই, ধন্য হই।
জাপানিরা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি সুশৃঙ্খল জাতি, তারা কর্মঠ এবং বাস্তববাদী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই হয়তো আবার তারা ঘুরে দাঁড়াবে। এমনকি হয়তো অভাবিত রকমের অল্প সময়েই তারা ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্বসম্প্রদায়ও তাদের পাশে দাঁড়াবে।
না, মানুষের শক্তি ও দক্ষতার ওপর আস্থা হারাইনি। তবে প্রকৃতির অভাবিত এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের খেয়ালিপনা যে বাড়ছে সেটা লক্ষণীয়। তা পরিমাণে যেমন তেমনি মাত্রাগতভাবেও বেড়ে চলেছে। প্রকৃতি চলে ভাঙাগড়া, ধ্বংস ও নির্মাণপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। দৈনন্দিন জীবনের নানা কিছুতে এ অভিজ্ঞতা আমাদের হয়। প্রতিবছর অধিকাংশ গাছের পাতা ঝরে যায়, আবার নতুন পাতা গজিয়ে প্রকৃতির নবায়ন হয়। জীবনচক্রও এভাবে চলতে থাকে। নদীতে একদিকে চর পড়ে নতুন ভূমি জেগে ওঠে তো অন্যদিকে ভাঙনের কবলে পড়ে জনপদ উজাড় হয়ে যায়।
এ-ও আমরা জানি, পৃথিবীতে সময়ের বিশাল ব্যবধানে হিমযুগ ও উষ্ণযুগের পালাবদল চলতে থাকে। তাতে ধ্বংসযজ্ঞ হয় ব্যাপকভাবে। এখন প্রকৃতি যেন আমাদের জানাতে চাইছে, এ রকম পালাবদলের ক্রান্তিলগ্নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এখন যে ধরনের বড় আকারের ধ্বংসযজ্ঞ হবে, অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে, তা সব সময় দেশের সীমা মেনে ঘটবে না। আবার জাপানের মতো একটি দেশের সীমানার মধ্যে ঘটা বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের এমন প্রচণ্ড অভিঘাত হতে পারে যার প্রভাব বিশ্ববাসীর ওপর পড়বে। ফলে আজকের দিনে দেশে দেশে বৈরিতার পরিবর্তে সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। সেদিক থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতার ফোরামগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এখনো সহযোগিতার ফোরাম তথা সার্ককে যেমন কার্যকর করতে পারিনি, তেমনি দ্বিপক্ষীয় আস্থা ও বিনিময়ের সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। এখানে দেশে দেশে পুরোনো সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বৈরিতার সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে।
বলতেই হয়, এ কাজে আঞ্চলিক বড় শক্তি ভারতকেই ঔদার্য দেখাতে ও এগিয়ে আসতে হবে। আবার পাকিস্তানকেও মজ্জাগত অন্ধ ভারতবিরোধিতার বৃত্ত ভাঙতে হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুসারীদের আরও বাস্তবোচিত ভূমিকা নিতে হবে—পাকিস্তানের চশমা পরে ভারতকে বিচার করার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো ফায়দা নেই।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখন ব্যাপক হারে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন হতে থাকবে। এটি আমাদের জানা ও অভ্যস্ত উন্নয়নের ধারা। কিন্তু এর সবটা ধাক্কা গিয়ে পড়ে স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপর। এ কাজে গাছ কাটতে হয়, পাহাড় কাটা পড়ে, জলাভূমি ভরাট হয়, নদীতে বাঁধ ও সেতু দিতে হয়, জমির ওপর কংক্রিটের আচ্ছাদন হয়। এ সবই প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করেই করতে হয়। তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ ঘটে, খরার আশঙ্কা বাড়ে বা বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কবলে পড়তে হয়।
যদি আমরা ধূমপানকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে শনাক্ত করতে পারি এবং সেভাবে যথাযথ নিবারণমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি, তাহলে পৃথিবীর বা প্রকৃতির স্বাস্থ্যের জন্য অতিরিক্ত নগরায়ণ-শিল্পায়ন যে ক্ষতিকর তা কেন বলতে পারব না?
অতিরিক্ত মুনাফার জন্য উন্নয়নের নামে একদল যেভাবে ভূমি দখল করছে, কৃষিজমিতে আবাসন করছে, গাছপালা নির্বিচারে কাটছে; জলাভূমি, এমনকি দিঘি-খাল-নদী পর্যন্ত দখল করে ভরাট করছে, তাতে অচিরেই আমরা মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ব। আমরা মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ দেখেছি, এবার মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখব, তার আলামত প্রায় শুরু হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। একবার এক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানুষ কি আউটডোর প্রাণী না ইনডোর প্রাণী? তারা অনেকক্ষণ আলোচনা করল, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলো, তারপর সিদ্ধান্তে এল যে মানুষ আসলে আউটডোর প্রাণীই ছিল, ভুল করে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।
শিশুদের টান মুক্তির দিকে; মুক্ত, অবাধ পরিবেশের দিকে। ফলে সংগতভাবেই তাদের পক্ষপাত গেছে প্রকৃতির কোলে থাকার দিকেই। আমরা জানি, ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশো প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় লিখেছেন লোষ্ট্র-কাষ্ঠ-ইটের নগরী নিয়ে অরণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।
মনে হয়, প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকায় আমরা গাছের মূল্য বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রকৃতি বলতে যে কেবল গাছ নয়, গাছপালা-ভূমি-জলাধার-প্রাণী, নির্মল বাতাস, রোদ—অনেক কিছুর সমাহার, তা আমরা বুঝতে পারি না। আর তাতে উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছাচার চালানোতে ক্ষান্তি দিচ্ছি না।
ভবিষ্যতে সমস্যার নতুন আরও দিক খুলে যাবে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হয়ে যাবে নয় বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি। এখনকার সাড়ে ৬০০ কোটির অন্নসংস্থান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। এর ওপর আরও আড়াই শ কোটি যোগ হলে অবস্থা কী রকম দাঁড়াবে, সামাল দেওয়া যাবে কীভাবে, সেটাই আজ ভাবার বিষয়। কথা হলো, সমস্যাটা হয়তো আমরা আঁচ করতে পারছি, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের অভ্যাস হলো, সমস্যা বোঝা হয়ে এসে না দাঁড়ালে এ নিয়ে মুখে কথা বললেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয় না। বহুদিনের অভ্যাস, বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, সমস্যার পরিণতি না বোঝা এবং সর্বোপরি এর চেয়ে অন্য ছোটখাটো বিষয়কে বড় বলে ভাবা আমাদের পুরোনো অভ্যাস।
বাংলাদেশে পরিবেশ দপ্তর আগের তুলনায় বড় হয়েছে, লোকবল বেড়েছে। পরিবেশ নিয়ে সরকার ও এনজিওদের অনেক কাজ আছে, পরিবেশ আদালত তৈরি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে জনচেতনা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও লোকদেখানো অনুষ্ঠানসর্বস্ব কাজই বেশি হচ্ছে। ঠিকই কৃষিজমি দখল বা ক্রয় করে এবং জলাধার ভরাট করে আবাসন বাড়ছে। গাছ লাগানো বেড়েছে, কিন্তু কী ধরনের গাছ লাগালে ভালো হবে সে বিষয়ে চেতনা বাড়ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না, পানির দূষণ বেড়েই চলেছে। আমরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে আবর্জনার ব্যবস্থাপনা শিখছি না। এভাবে পরিবেশবিরোধী কাজের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যাবে।
বাংলাদেশ, বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার হতে চলেছে। এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, বলা যায় বেশ রাজনীতি হচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তিক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু সত্যি সত্যি বিষয়ের গভীরতা, ক্ষতির মাত্রা এবং এ সমস্যার আসন্নতা নিয়ে আমরা কি যথেষ্ট সচেতন হলে এ রকম বেপরোয়া ভূমিদস্যুতা চলতে পারত? গ্রাম পর্যন্ত নগরায়ণ ও আবাসনের থাবা বিস্তৃত হতে পারত? আর সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে জরুরি জাতীয় কর্মসূচি কি নেওয়া হতো না? তাতে বিরোধী পক্ষের কি সংযোগ থাকত না বা সরকারের দিক থেকে তাদেরও এ কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হতো না?
আমাদের দেশে ভূমিকম্পের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এবং পূর্বাভাস রয়েছে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের। আর সাধারণ মানুষও বলাবলি করে থাকে, ঢাকা মহানগরে রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ভয়াবহ বিপর্যয় হবে। ঢাকাকে বহুদিন ধরে ইট-কংক্রিটের জঙ্গল/জঞ্জাল/বস্তি বলা হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক গোলটেবিল, টকশো, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে। তাতে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রভৃতি বহু রকম বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছেন। কথাও হচ্ছে প্রচুর, লেখাও হচ্ছে কম নয়। কিন্তু আমাদের অভিযাত্রা উত্তরোত্তর কংক্রিটের জঞ্জাল বাড়িয়ে চলার দিকেই। গাড়ি বাড়ছে, বায়ু-জল-শব্দ দূষণ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ; কমছে কৃষিজমি, বিশুদ্ধ জলের প্রাকৃতিক সম্ভার। মানুষে মানুষে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তা মানবিক থাকছে না, সমাজে অমানবিক নিষ্ঠুরতা বেড়ে চলেছে। মানবের বামনায়ন ও দানবায়ন ঘটছে।
খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে খাবারের দাম। সময় কম, প্রায় প্রবল পরাক্রান্ত সুনামির মতোই প্রকৃতির প্রতিশোধের থাবা আমাদের পিছু নিয়েছে। কেবল আমাদের নয়, শুধু জাপানের নয়, গোটা বিশ্বের।
জাপানের ভূমিকম্প-সুনামি-পরবর্তী বিপর্যয় হিসেবে এই ধ্বংসের অংশরূপে আণবিক চুল্লির বিকিরণ ও আণবিক বিপর্যয় কি শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? আমরা ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে ভয় পেতে চাইছি না, তবে বোকার স্বর্গেও বাস করতে পারি না। পরিস্থিতি সাবধানতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক হওয়ার বারতা দিচ্ছে।
আমাদের নতুন করে অনেক কিছুই ভাবতে হবে। ক্রুদ্ধ প্রকৃতি সে রকম বারতাই আমাদের পাঠাচ্ছে। আরও সরল সাদাসিধে জীবনের কথা ভাবতে হবে, তাতেই মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ছে—
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
জাপানিরা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি সুশৃঙ্খল জাতি, তারা কর্মঠ এবং বাস্তববাদী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই হয়তো আবার তারা ঘুরে দাঁড়াবে। এমনকি হয়তো অভাবিত রকমের অল্প সময়েই তারা ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্বসম্প্রদায়ও তাদের পাশে দাঁড়াবে।
না, মানুষের শক্তি ও দক্ষতার ওপর আস্থা হারাইনি। তবে প্রকৃতির অভাবিত এবং ধ্বংসাত্মক আচরণের খেয়ালিপনা যে বাড়ছে সেটা লক্ষণীয়। তা পরিমাণে যেমন তেমনি মাত্রাগতভাবেও বেড়ে চলেছে। প্রকৃতি চলে ভাঙাগড়া, ধ্বংস ও নির্মাণপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। দৈনন্দিন জীবনের নানা কিছুতে এ অভিজ্ঞতা আমাদের হয়। প্রতিবছর অধিকাংশ গাছের পাতা ঝরে যায়, আবার নতুন পাতা গজিয়ে প্রকৃতির নবায়ন হয়। জীবনচক্রও এভাবে চলতে থাকে। নদীতে একদিকে চর পড়ে নতুন ভূমি জেগে ওঠে তো অন্যদিকে ভাঙনের কবলে পড়ে জনপদ উজাড় হয়ে যায়।
এ-ও আমরা জানি, পৃথিবীতে সময়ের বিশাল ব্যবধানে হিমযুগ ও উষ্ণযুগের পালাবদল চলতে থাকে। তাতে ধ্বংসযজ্ঞ হয় ব্যাপকভাবে। এখন প্রকৃতি যেন আমাদের জানাতে চাইছে, এ রকম পালাবদলের ক্রান্তিলগ্নের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এখন যে ধরনের বড় আকারের ধ্বংসযজ্ঞ হবে, অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে, তা সব সময় দেশের সীমা মেনে ঘটবে না। আবার জাপানের মতো একটি দেশের সীমানার মধ্যে ঘটা বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের এমন প্রচণ্ড অভিঘাত হতে পারে যার প্রভাব বিশ্ববাসীর ওপর পড়বে। ফলে আজকের দিনে দেশে দেশে বৈরিতার পরিবর্তে সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। সেদিক থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতার ফোরামগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এখনো সহযোগিতার ফোরাম তথা সার্ককে যেমন কার্যকর করতে পারিনি, তেমনি দ্বিপক্ষীয় আস্থা ও বিনিময়ের সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। এখানে দেশে দেশে পুরোনো সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বৈরিতার সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে।
বলতেই হয়, এ কাজে আঞ্চলিক বড় শক্তি ভারতকেই ঔদার্য দেখাতে ও এগিয়ে আসতে হবে। আবার পাকিস্তানকেও মজ্জাগত অন্ধ ভারতবিরোধিতার বৃত্ত ভাঙতে হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের অনুসারীদের আরও বাস্তবোচিত ভূমিকা নিতে হবে—পাকিস্তানের চশমা পরে ভারতকে বিচার করার মধ্যে বাংলাদেশের কোনো ফায়দা নেই।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখন ব্যাপক হারে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, আবাসন হতে থাকবে। এটি আমাদের জানা ও অভ্যস্ত উন্নয়নের ধারা। কিন্তু এর সবটা ধাক্কা গিয়ে পড়ে স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপর। এ কাজে গাছ কাটতে হয়, পাহাড় কাটা পড়ে, জলাভূমি ভরাট হয়, নদীতে বাঁধ ও সেতু দিতে হয়, জমির ওপর কংক্রিটের আচ্ছাদন হয়। এ সবই প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করেই করতে হয়। তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ ঘটে, খরার আশঙ্কা বাড়ে বা বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কবলে পড়তে হয়।
যদি আমরা ধূমপানকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে শনাক্ত করতে পারি এবং সেভাবে যথাযথ নিবারণমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি, তাহলে পৃথিবীর বা প্রকৃতির স্বাস্থ্যের জন্য অতিরিক্ত নগরায়ণ-শিল্পায়ন যে ক্ষতিকর তা কেন বলতে পারব না?
অতিরিক্ত মুনাফার জন্য উন্নয়নের নামে একদল যেভাবে ভূমি দখল করছে, কৃষিজমিতে আবাসন করছে, গাছপালা নির্বিচারে কাটছে; জলাভূমি, এমনকি দিঘি-খাল-নদী পর্যন্ত দখল করে ভরাট করছে, তাতে অচিরেই আমরা মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ব। আমরা মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ দেখেছি, এবার মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখব, তার আলামত প্রায় শুরু হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। একবার এক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, মানুষ কি আউটডোর প্রাণী না ইনডোর প্রাণী? তারা অনেকক্ষণ আলোচনা করল, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হলো, তারপর সিদ্ধান্তে এল যে মানুষ আসলে আউটডোর প্রাণীই ছিল, ভুল করে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।
শিশুদের টান মুক্তির দিকে; মুক্ত, অবাধ পরিবেশের দিকে। ফলে সংগতভাবেই তাদের পক্ষপাত গেছে প্রকৃতির কোলে থাকার দিকেই। আমরা জানি, ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশো প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় লিখেছেন লোষ্ট্র-কাষ্ঠ-ইটের নগরী নিয়ে অরণ্য ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।
মনে হয়, প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকায় আমরা গাছের মূল্য বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রকৃতি বলতে যে কেবল গাছ নয়, গাছপালা-ভূমি-জলাধার-প্রাণী, নির্মল বাতাস, রোদ—অনেক কিছুর সমাহার, তা আমরা বুঝতে পারি না। আর তাতে উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছাচার চালানোতে ক্ষান্তি দিচ্ছি না।
ভবিষ্যতে সমস্যার নতুন আরও দিক খুলে যাবে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হয়ে যাবে নয় বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি। এখনকার সাড়ে ৬০০ কোটির অন্নসংস্থান নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। এর ওপর আরও আড়াই শ কোটি যোগ হলে অবস্থা কী রকম দাঁড়াবে, সামাল দেওয়া যাবে কীভাবে, সেটাই আজ ভাবার বিষয়। কথা হলো, সমস্যাটা হয়তো আমরা আঁচ করতে পারছি, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের অভ্যাস হলো, সমস্যা বোঝা হয়ে এসে না দাঁড়ালে এ নিয়ে মুখে কথা বললেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয় না। বহুদিনের অভ্যাস, বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা, সমস্যার পরিণতি না বোঝা এবং সর্বোপরি এর চেয়ে অন্য ছোটখাটো বিষয়কে বড় বলে ভাবা আমাদের পুরোনো অভ্যাস।
বাংলাদেশে পরিবেশ দপ্তর আগের তুলনায় বড় হয়েছে, লোকবল বেড়েছে। পরিবেশ নিয়ে সরকার ও এনজিওদের অনেক কাজ আছে, পরিবেশ আদালত তৈরি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে জনচেতনা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও লোকদেখানো অনুষ্ঠানসর্বস্ব কাজই বেশি হচ্ছে। ঠিকই কৃষিজমি দখল বা ক্রয় করে এবং জলাধার ভরাট করে আবাসন বাড়ছে। গাছ লাগানো বেড়েছে, কিন্তু কী ধরনের গাছ লাগালে ভালো হবে সে বিষয়ে চেতনা বাড়ছে না। পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না, পানির দূষণ বেড়েই চলেছে। আমরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে আবর্জনার ব্যবস্থাপনা শিখছি না। এভাবে পরিবেশবিরোধী কাজের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যাবে।
বাংলাদেশ, বলা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার হতে চলেছে। এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, বলা যায় বেশ রাজনীতি হচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তিক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু সত্যি সত্যি বিষয়ের গভীরতা, ক্ষতির মাত্রা এবং এ সমস্যার আসন্নতা নিয়ে আমরা কি যথেষ্ট সচেতন হলে এ রকম বেপরোয়া ভূমিদস্যুতা চলতে পারত? গ্রাম পর্যন্ত নগরায়ণ ও আবাসনের থাবা বিস্তৃত হতে পারত? আর সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে জরুরি জাতীয় কর্মসূচি কি নেওয়া হতো না? তাতে বিরোধী পক্ষের কি সংযোগ থাকত না বা সরকারের দিক থেকে তাদেরও এ কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হতো না?
আমাদের দেশে ভূমিকম্পের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এবং পূর্বাভাস রয়েছে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের। আর সাধারণ মানুষও বলাবলি করে থাকে, ঢাকা মহানগরে রিখটার স্কেলে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ভয়াবহ বিপর্যয় হবে। ঢাকাকে বহুদিন ধরে ইট-কংক্রিটের জঙ্গল/জঞ্জাল/বস্তি বলা হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক গোলটেবিল, টকশো, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়েছে। তাতে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পনাবিদ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রভৃতি বহু রকম বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়েছেন। কথাও হচ্ছে প্রচুর, লেখাও হচ্ছে কম নয়। কিন্তু আমাদের অভিযাত্রা উত্তরোত্তর কংক্রিটের জঞ্জাল বাড়িয়ে চলার দিকেই। গাড়ি বাড়ছে, বায়ু-জল-শব্দ দূষণ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ; কমছে কৃষিজমি, বিশুদ্ধ জলের প্রাকৃতিক সম্ভার। মানুষে মানুষে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তা মানবিক থাকছে না, সমাজে অমানবিক নিষ্ঠুরতা বেড়ে চলেছে। মানবের বামনায়ন ও দানবায়ন ঘটছে।
খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে খাবারের দাম। সময় কম, প্রায় প্রবল পরাক্রান্ত সুনামির মতোই প্রকৃতির প্রতিশোধের থাবা আমাদের পিছু নিয়েছে। কেবল আমাদের নয়, শুধু জাপানের নয়, গোটা বিশ্বের।
জাপানের ভূমিকম্প-সুনামি-পরবর্তী বিপর্যয় হিসেবে এই ধ্বংসের অংশরূপে আণবিক চুল্লির বিকিরণ ও আণবিক বিপর্যয় কি শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? আমরা ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগে ভয় পেতে চাইছি না, তবে বোকার স্বর্গেও বাস করতে পারি না। পরিস্থিতি সাবধানতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্ক হওয়ার বারতা দিচ্ছে।
আমাদের নতুন করে অনেক কিছুই ভাবতে হবে। ক্রুদ্ধ প্রকৃতি সে রকম বারতাই আমাদের পাঠাচ্ছে। আরও সরল সাদাসিধে জীবনের কথা ভাবতে হবে, তাতেই মুক্তি।
রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ছে—
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments