গ্যাস সংকটে ধুঁকছে শিল্প by আরিফুজ্জামান তুহিন
উৎপাদন ঘাটতির কারণে বাসাবাড়িসহ শিল্পাঞ্চলে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকলেও সংকট সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। যেসব শিল্প-কারখানায় আগে থেকেই গ্যাসের সংযোগ রয়েছে, এখন সেখানেও গ্যাস দিতে পারছে না সরকার। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ না থাকায় শিল্প-কারখানা চালু করা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, তারা সংকটের সমাধান দেবে- তবে এ জন্য সময় দিতে হবে। তবে সরকারের তিন বছর পার হলেও গ্যাসের উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। শিল্প মালিকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে শিল্প-কারখানায় লাল বাতি জ্বলবে।
দেশে তীব্র গ্যাস সংকট চলায় ২০০৯ সালের ২১ জুলাই সরকার সব ধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। সরকার তখন জানিয়ে দেয়, উৎপাদন দৈনিক ২২০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে না। বর্তমানে গ্যাসের উৎপাদন ২০০ কোটি ঘনফুটের মতো। নতুন সংযোগ না দেওয়া হলেও যেসব শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ ছিল, সেখানেও দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকট সামাল দিতে সিএনজি স্টেশনগুলোকে আগের চার ঘণ্টার (বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) সঙ্গে আরো দুই ঘণ্টা যোগ করে (বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) মোট ছয় ঘণ্টা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সিএনজি স্টেশনের পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে সার কারখানাগুলোতেও।
বর্তমানে পোশাক শিল্পের ঘনীভূত এলাকা নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, রূপগঞ্জ, কাঁচপুর, হেমায়েতপুর, সাভার, বড় আশুলিয়া, কোনাবাড়ী, চান্দুরা ও জিরানি এলাকায় গ্যাসের চাপ মাত্রাতিরিক্ত কমে গেছে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ইস্পাত, সিমেন্ট, ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ ভারী শিল্পকারখানা যেসব অঞ্চলে রয়েছে, এমন সব অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জের শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। শিল্পমালিকরা বলছেন, এর আগে এসব অঞ্চলে গ্যাসের পিএসআই ১৫ পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে চার বা পাঁচ। এতে অনেক কারখানা কার্যত বন্ধ থাকছে।
গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করে তিতাস বলেছে, দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ অঞ্চলের গ্যাস বিতরণ কম্পানি তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ অঞ্চলের শিল্পকারখানায় গ্যাসের অবস্থা ভালো না। কারখানাগুলোতে গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার কারণে তিতাসের এ অঞ্চলে গ্যাসের সংকট বেশি দেখা দিয়েছে।' কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গ্রীষ্মে সেচ মৌসুমের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে, যা চলবে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এপ্রিলের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।'
তিতাসের কর্মকর্তা মীর মশিউর রহমান আরো জানান, তিতাসের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ১৮০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে তিতাস গ্যাস উত্তোলন কম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ কোটি ঘনফুট। ফলে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে এবং এ কারণেই শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে।
তিতাসের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যখন চালু থাকে, তখন গ্যাসের চাপ প্রায় থাকেই না কারখানাগুলোতে। কারখানাগুলোর উৎপাদন তখন বন্ধ রাখতে হয়। শিল্পকারখানায় গ্যাস না দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, সেখানেও সাফল্য আসেনি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেওয়া তথ্য মতে, গ্যাসের অভাবে এই মুহূর্তে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
তিতাস ও এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন- পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের ৩০ এপ্রিল মোচাইতে একটি কম্প্রেসার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই কম্প্রেসার কাজ শুরু করলে গ্যাসের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, মোচাইতে চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে কম্প্রেসারটি কাজ শুরু করবে। তখনই বোঝা যাবে আসলে এই কম্প্রেসারের মাধ্যমে বাড়তি গ্যাস আদৌ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারছে কি না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছরে গ্যাস সংকটে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো সাফল্য নেই। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৩০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণে যুক্ত সরকারি সংস্থাগুলোর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের চাহিদা (প্রোজেক্টেড) এ বছরের মধ্যেই ২৮০ কোটি ঘনফুটে দাঁড়াবে। অন্যদিকে উৎপাদন ২২০ কোটি ঘনফুটের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। এতে করে ঘাটতি থেকে যাবে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'গ্যাস সংকট ২০১৩ সালের আগে সহনীয় পর্যায়েও আসবে না।' তিনি আরো বলেন, 'গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নেওয়া মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় সাতটি অনুসন্ধান কূপ, ২৪টি উন্নয়ন কূপ ও তিনটি ওয়ার্কওভার কূপ খনন এবং দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কথা ছিল। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত ধীরগতি হওয়ায় গ্যাস সংকটের সমাধান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।'
গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প খাতে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এঙ্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমই) সূত্রে জানা যায়, গ্যাসের অভাবে গত দুই মাসে এ খাতে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। বিকেএমইয়ের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাসস্বল্পতার কারণে নিটিং সেক্টর ধ্বংস হতে বসেছে। দেশের ৭৫ ভাগ নিটিং কারখানা নারায়ণগঞ্জে। অথচ এখানকার কারখানাগুলো তাদের প্রয়োজনের মাত্র ২৫ ভাগ গ্যাস পায়। এ কারণে গত দুই মাসে এ খাতের ২০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি কমেছে, যার মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জেরই রয়েছে ৭০ মিলিয়ন ডলার।'
সেলিম ওসমান বলেন, 'আমাদের শুধু আশ্বাসই শোনানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।' সিএনজি সুলভ করে দেওয়া সম্পর্কে ক্ষুব্ধ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'যাঁরা ২০ লাখ টাকা খরচ করে একটি গাড়ি কিনতে পারেন, তাঁদের কেন ৬০০ টাকায় গ্যাস দেওয়া হবে? আর আমরা যাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা আনি, শ্রমিকের বেতন দিই, তাঁরা গ্যাস পাব না, শিল্পাঞ্চল অচল হয়ে যাবে, তা হতে পারে না। গ্যাসের ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে গ্যাস দিতে হবে।'
একইভাবে গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে টেক্সটাইল শিল্পে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যানুযায়ী, গ্যাসের অভাবে বস্ত্র খাতে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। অন্তত ২৫টি টেক্সটাইল মিল দুই বছর ধরে গ্যাসের অপেক্ষায় রয়েছে। গ্যাসের অভাবে টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ।
বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের টেক্সটাইল শিল্প খাত সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাস দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ তৈরি করি, কারখানা চালাই। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে না। ফলে আমাদের কারখানাগুলো চলছে না। এই ভয়াবহ সংকট থেকে যদি টেক্সটাইলকে বাঁচানো না যায়, তাহলে অর্থনীতির জন্য তা খুবই ক্ষতির কারণ হবে।'
শিল্পে গ্যাস সংকটের কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সূত্রে জানা জানা যায়, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ মাঠে মারা যেতে পারে। গ্যাস সংকটের এ নেতিবাচক প্রভাব রপ্তানিমুখী শিল্পে পড়বে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মোর্শেদি বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের স্পিনিং, ডায়িং, ফিনিশিং, নিটিং ও টেক্সটাইল কম্পানিগুলো। এর প্রভাব অন্যান্য শিল্প খাতে পড়েছে। গ্যাসের চাপ নেই লাইনে। তবু গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে পণ্য উৎপাদনে খরচ পড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। এভাবে বেশি দামে পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়বে দেশের রপ্তানিতে। সরকারের উচিত রপ্তানিমুখী শিল্পে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া।'
দেশে তীব্র গ্যাস সংকট চলায় ২০০৯ সালের ২১ জুলাই সরকার সব ধরনের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। সরকার তখন জানিয়ে দেয়, উৎপাদন দৈনিক ২২০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হবে না। বর্তমানে গ্যাসের উৎপাদন ২০০ কোটি ঘনফুটের মতো। নতুন সংযোগ না দেওয়া হলেও যেসব শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ ছিল, সেখানেও দেখা দিয়েছে গ্যাস সংকট। গ্যাস সংকট সামাল দিতে সিএনজি স্টেশনগুলোকে আগের চার ঘণ্টার (বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) সঙ্গে আরো দুই ঘণ্টা যোগ করে (বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) মোট ছয় ঘণ্টা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সিএনজি স্টেশনের পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে সার কারখানাগুলোতেও।
বর্তমানে পোশাক শিল্পের ঘনীভূত এলাকা নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, রূপগঞ্জ, কাঁচপুর, হেমায়েতপুর, সাভার, বড় আশুলিয়া, কোনাবাড়ী, চান্দুরা ও জিরানি এলাকায় গ্যাসের চাপ মাত্রাতিরিক্ত কমে গেছে। পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ইস্পাত, সিমেন্ট, ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ ভারী শিল্পকারখানা যেসব অঞ্চলে রয়েছে, এমন সব অঞ্চলের মধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জের শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। শিল্পমালিকরা বলছেন, এর আগে এসব অঞ্চলে গ্যাসের পিএসআই ১৫ পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে চার বা পাঁচ। এতে অনেক কারখানা কার্যত বন্ধ থাকছে।
গ্যাস সংকটের কথা স্বীকার করে তিতাস বলেছে, দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ অঞ্চলের গ্যাস বিতরণ কম্পানি তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ অঞ্চলের শিল্পকারখানায় গ্যাসের অবস্থা ভালো না। কারখানাগুলোতে গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করার কারণে তিতাসের এ অঞ্চলে গ্যাসের সংকট বেশি দেখা দিয়েছে।' কবে নাগাদ এ সমস্যার সমাধান হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'গ্রীষ্মে সেচ মৌসুমের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে, যা চলবে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এপ্রিলের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।'
তিতাসের কর্মকর্তা মীর মশিউর রহমান আরো জানান, তিতাসের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ১৮০ কোটি ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে তিতাস গ্যাস উত্তোলন কম্পানিগুলোর কাছ থেকে পাচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ কোটি ঘনফুট। ফলে ৩৫ থেকে ৪০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে এবং এ কারণেই শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে।
তিতাসের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যখন চালু থাকে, তখন গ্যাসের চাপ প্রায় থাকেই না কারখানাগুলোতে। কারখানাগুলোর উৎপাদন তখন বন্ধ রাখতে হয়। শিল্পকারখানায় গ্যাস না দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, সেখানেও সাফল্য আসেনি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেওয়া তথ্য মতে, গ্যাসের অভাবে এই মুহূর্তে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
তিতাস ও এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন- পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের ৩০ এপ্রিল মোচাইতে একটি কম্প্রেসার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই কম্প্রেসার কাজ শুরু করলে গ্যাসের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটতে পারে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাসের এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, মোচাইতে চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে কম্প্রেসারটি কাজ শুরু করবে। তখনই বোঝা যাবে আসলে এই কম্প্রেসারের মাধ্যমে বাড়তি গ্যাস আদৌ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারছে কি না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের তিন বছরে গ্যাস সংকটে উল্লেখ্যযোগ্য কোনো সাফল্য নেই। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৩০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস উৎপাদন ও বিতরণে যুক্ত সরকারি সংস্থাগুলোর একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের চাহিদা (প্রোজেক্টেড) এ বছরের মধ্যেই ২৮০ কোটি ঘনফুটে দাঁড়াবে। অন্যদিকে উৎপাদন ২২০ কোটি ঘনফুটের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই। এতে করে ঘাটতি থেকে যাবে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের।
পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'গ্যাস সংকট ২০১৩ সালের আগে সহনীয় পর্যায়েও আসবে না।' তিনি আরো বলেন, 'গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নেওয়া মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় সাতটি অনুসন্ধান কূপ, ২৪টি উন্নয়ন কূপ ও তিনটি ওয়ার্কওভার কূপ খনন এবং দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুটের সমান এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কথা ছিল। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত ধীরগতি হওয়ায় গ্যাস সংকটের সমাধান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।'
গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প খাতে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এঙ্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমই) সূত্রে জানা যায়, গ্যাসের অভাবে গত দুই মাসে এ খাতে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। বিকেএমইয়ের সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাসস্বল্পতার কারণে নিটিং সেক্টর ধ্বংস হতে বসেছে। দেশের ৭৫ ভাগ নিটিং কারখানা নারায়ণগঞ্জে। অথচ এখানকার কারখানাগুলো তাদের প্রয়োজনের মাত্র ২৫ ভাগ গ্যাস পায়। এ কারণে গত দুই মাসে এ খাতের ২০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি কমেছে, যার মধ্যে শুধু নারায়ণগঞ্জেরই রয়েছে ৭০ মিলিয়ন ডলার।'
সেলিম ওসমান বলেন, 'আমাদের শুধু আশ্বাসই শোনানো হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।' সিএনজি সুলভ করে দেওয়া সম্পর্কে ক্ষুব্ধ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'যাঁরা ২০ লাখ টাকা খরচ করে একটি গাড়ি কিনতে পারেন, তাঁদের কেন ৬০০ টাকায় গ্যাস দেওয়া হবে? আর আমরা যাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা আনি, শ্রমিকের বেতন দিই, তাঁরা গ্যাস পাব না, শিল্পাঞ্চল অচল হয়ে যাবে, তা হতে পারে না। গ্যাসের ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে গ্যাস দিতে হবে।'
একইভাবে গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়েছে টেক্সটাইল শিল্পে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যানুযায়ী, গ্যাসের অভাবে বস্ত্র খাতে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। অন্তত ২৫টি টেক্সটাইল মিল দুই বছর ধরে গ্যাসের অপেক্ষায় রয়েছে। গ্যাসের অভাবে টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ।
বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের টেক্সটাইল শিল্প খাত সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাস দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ তৈরি করি, কারখানা চালাই। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে না। ফলে আমাদের কারখানাগুলো চলছে না। এই ভয়াবহ সংকট থেকে যদি টেক্সটাইলকে বাঁচানো না যায়, তাহলে অর্থনীতির জন্য তা খুবই ক্ষতির কারণ হবে।'
শিল্পে গ্যাস সংকটের কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এঙ্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সূত্রে জানা জানা যায়, গ্যাস সংকটের কারণে প্রায় ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ মাঠে মারা যেতে পারে। গ্যাস সংকটের এ নেতিবাচক প্রভাব রপ্তানিমুখী শিল্পে পড়বে বলে মনে করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মোর্শেদি বলেন, 'গ্যাস সংকটের কারণে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের স্পিনিং, ডায়িং, ফিনিশিং, নিটিং ও টেক্সটাইল কম্পানিগুলো। এর প্রভাব অন্যান্য শিল্প খাতে পড়েছে। গ্যাসের চাপ নেই লাইনে। তবু গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে পণ্য উৎপাদনে খরচ পড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। এভাবে বেশি দামে পণ্য উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকা আমাদের জন্য অনেক কঠিন। গ্যাস সংকটের প্রভাব পড়বে দেশের রপ্তানিতে। সরকারের উচিত রপ্তানিমুখী শিল্পে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া।'
No comments