সত্যের বসু বিজ্ঞান ক্যাম্প ২০১২-আনন্দের সঙ্গে বিজ্ঞানশিক্ষার ক্যাম্প

দেশে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিষয়ভীতি এর অন্যতম কারণ বলে গবেষণায় জানা গেছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেই আনুষ্ঠানিক আর অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা সম্ভব বলে জানা গেছে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া বিজ্ঞানের শিক্ষকদের একটি ক্যাম্পে।


বাংলাদেশে বিজ্ঞানে পড়তে আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ বিশ্ব ক্রমাগত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে প্রযুক্তির ওপর। ফলে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের অনাগ্রহের এ হার গ্রামাঞ্চলে অনেক বেশি। দক্ষিণের এক উপজেলায় চলতি বছর ৫২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ২৫০ জন। গ্রামে অনেক স্কুলে ইদানীং একজনও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী থাকে না!!!
দেশের সাতটি জেলার ২২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে এর কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন পরিচালিত ওই গবেষণায় বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতি অনাগ্রহের যে কারণগুলো উঠে এসেছে, তার মধ্যে বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান কঠিন, সিলেবাস বড়, অধিক সময় স্কুলে থাকা, খরচ বেশি (প্রাইভেট পড়তে হয়) যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে চাকরির অভাব ও সামাজিক কারণ। (বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে, বিজ্ঞান প্রজন্ম, প্রথম আলো, ২১ আগস্ট, ২০১১)। এর মধ্যে ভীতি কাটিয়ে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। এ কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে, যদি বিজ্ঞানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা যায়। শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানশিক্ষাদানকে আনন্দময় করে তোলার নানা কৌশল এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানভীতি দূর করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার জন্য সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে বিজ্ঞানের শিক্ষকদের ক্যাম্প। বিজ্ঞানের শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত এই ক্যাম্পের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি। এতে একাডেমিক সহযোগিতা দিয়েছে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। গত ২২ থেকে ২৪ মার্চ সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ ভবনের এ ক্যাম্পে মানিকগঞ্জ, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, পিরোজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও কুষ্টিয়া থেকে মোট ৭৭ জন বিজ্ঞানের শিক্ষক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অংশ নেন। ক্যাম্পে ফ্যাসিলিটেটরের দায়িত্ব পালন করেন দেশের জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এ আর খান, ঢাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের শিক্ষক রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাম্মাদ আলী, বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষক তানিয়া কামরুন নাহার, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক কাউন্সিলর মাহমুদুল হাসান ও সৌমিত্র চক্রবর্তী। ক্যাম্প পরিচালনা করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান।

যা যা হলো
২২ মার্চ রাতে শিক্ষকদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়পর্ব সমাপ্ত হয়। ২৩ ও ২৪ তারিখের বিভিন্ন সেশনে কখনো শ্রেণীকক্ষে, কখনো খোলা আকাশের নিচে, আবার কখনো ভবনের বারান্দায় খোঁজা হয়েছে বিজ্ঞানশিক্ষাকে আনন্দময় করার কৌশল। তবে শুরুতে শিক্ষকদের শিক্ষাদান পদ্ধতির একটি ম্যাপ তৈরি করা হয়। দেখা যায়, শিক্ষকদের প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে পূর্ব পাঠ বা পূর্বজ্ঞান, বিষয়ের অবতারণা, ছবি বা ডায়াগ্রাম থাকলে তা বোর্ডে আঁকা, বর্ণনা বা লেকচার, একক বা দলীয় কাজ, শিক্ষার্থীরা বুঝল কি না, তা কুইজের মাধ্যমে যাচাই এবং শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া।
এর পরই বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় এবং বিজ্ঞানের পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে কর্ম অধিবেশনের শুরু। বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে শিক্ষকদের ধারণা স্বচ্ছ হলে পাঠদানও সহজ হয়ে ওঠে। শ্রেণীকক্ষে বিজ্ঞানের আদি প্রশ্ন, যেমন, এলাম আমি কোথা থেকে জাতীয় প্রশ্নের আলাপ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তোলে। এ বিষয়ে ড. এ আর খান তাঁর দেশে এবং বিদেশে বিজ্ঞান পড়ানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
পূর্বপরিকল্পিত পাঠদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের তৈরি করে আনা পাঠ পরিকল্পনা থেকে দেখা যায়, পাঠ পরিকল্পনায় বাড়তি নজর দিলে শিক্ষা আনন্দময় হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের শিক্ষক রাজিয়া বেগম অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা এবং পোস্টারের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেন। জীববিজ্ঞানের শিক্ষকদের পাঠদানের একটি উল্লেখযোগ্য সময় নষ্ট হয় বোর্ডে বিভিন্ন চিত্র বা চার্ট আঁকতে। এ ক্ষেত্রে ছাপানো বহুরঙা চার্ট শিক্ষকের পরিশ্রম যেমন লাঘব করতে পারে, তেমনি তা শিক্ষার্থীদেরও আকর্ষণ করে। তবে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়, যখন তারা দেখে সুঁই দিয়ে একটু বেলুনকে ফাটিয়ে দেওয়া যায় না, পানিভর্তি গ্লাস উল্টে রাখলেও তা থেকে পানি পড়ে যায় না, পাত্রের মধ্যে পানি দিলে তার তলার মুদ্রা ওপরে উঠে আসে!!!
আমাদের দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই কেবল ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ পায়। কিন্তু ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের এ সুযোগ নেই। অথচ সাধারণ কিছু উপকরণ ব্যবহার করে শ্রেণীকক্ষেই নানা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিজ্ঞানশিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।
আবার আকাশ দেখার জন্য কোনো টাকাপয়সার প্রয়োজন হয় না! নিয়মিত রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করে একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে বুঝতে পারে। আকাশে শুক্র গ্রহের (সন্ধ্যাতারা বা শুকতারা) গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ যে শুক্র গ্রহ আর যা-ই করুক, পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে না!
অন্যদিকে তারামণ্ডলীতে কাল্পনিক চিত্র খুঁজে নিলে সেখানে সিংহ, মাছ কিংবা শিকারিকে পাওয়া যায়। তারার অবস্থান দেখে দিক নির্ণয়ের বিষয়ও একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তুলতে পারে।
শিক্ষার্থীদের প্রকল্পভিত্তিক বাড়ির কাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানমেলার আয়োজনও বিজ্ঞানশিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এর পাশাপাশি বিজ্ঞানের শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করারও সুপারিশ করেছেন অংশগ্রহণকারীরা।
বাগেরহাট ডাকরা স্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানশিক্ষক নিরঞ্জন মণ্ডল তাঁর উদ্ভাবিত কয়েকটি পরীক্ষাপদ্ধতি সবার সঙ্গে বিনিময় করেন। এ ছাড়া ক্যাম্পে গাইবান্ধার বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ওমর ফারুক আজাদের বিজ্ঞানশিক্ষা উপকরণ সেটের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক সূত্র ও পদ্ধতি হাতে-কলমে করে দেখানো হয়।

কেন এই আয়োজন
ক্যাম্পের অন্যতম আয়োজক বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান জানান, গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞানশিক্ষকেরা প্রশিক্ষিত হয়ে এগিয়ে এলে ভবিষ্যতে বিজ্ঞানশিক্ষার চিত্র পাল্টে দেওয়া সম্ভব। প্রচলিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরিবর্তে শিক্ষকদের জন্য ভিন্নধর্মী ক্যাম্পের আয়োজন করে তার যথার্থতা যাচাই ছিল এ কার্যক্রমের অন্যতম লক্ষ্য। ভবিষ্যতে বিভিন্ন জেলায় অনুরূপ আয়োজন করা হবে বলে তিনি জানান। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে বিজ্ঞানশিক্ষাকে যত আনন্দময় করা যাবে, তত মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে, এমনটি বিশ্বাস করেন ক্যাম্পের পরিচালক মুনির হাসান। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি আয়োজিত গণিত ক্যাম্প এরই মধ্যে গণিতশিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত ক্যাম্প বিজ্ঞানশিক্ষার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি। অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ বাগেরহাটের আমিনুল হক সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক ক্যাম্প বা প্রশিক্ষণ নিলেও এ ক্যাম্পকে যথেষ্ট কার্যকর বলে মনে করছেন। তিনি জানান, এবারের মহান স্বাধীনতা দিবসে তাঁরা বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করেছেন। তিনি মনে করেন, এ ক্যাম্প তাঁর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করেছে। বাগেরহাট সদর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মনোয়ারা নাসরিন মনে করেন, বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য এ রকম বিজ্ঞান ক্যাম্প খুব প্রয়োজন। এ ক্যাম্পে আসার আগে এ ক্যাম্পের কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু পরে তাঁর মনে হয়েছে, ক্যাম্পের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিজ্ঞানশিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে হলে শ্রেণীকক্ষে একে আনন্দময় করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য হাতে-কলমের শিক্ষাকে যেমন ছড়িয়ে দেওয়া দরকার, তেমনি দরকার বিজ্ঞানের শিক্ষকদের ক্রমাগতভাবে প্রশিক্ষিত করা।
যত দ্রুত এবং যত কার্যকরভাবে এ কাজ করা যাবে, ততই তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
বিজ্ঞান প্রজন্ম প্রতিবেদক

No comments

Powered by Blogger.