পাখি-সাদায়-কালোয় পাহাড়ি মুনিয়া by আ ন ম আমিনুর রহমান

গত বছরের ডিসেম্বরের এক বিকেলে সিলেটের টিলাগড় ইকোপার্কের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। সঙ্গে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সদরুল ইসলাম। গত দুই দিন এখানে গেছো চড়ুই, নীল রাজা, নীলকণ্ঠ, ধূসরমাথা ক্যানারি চটক, তাইগা চটক, সিপাহি বুলবুল, শ্বেতাক্ষী, গোলাপি সহেলি ও কয়েক প্রজাতির ফুটকি পাখি দেখেছি।


কিছু ছবি ভালো হয়নি। রাতেই পরীক্ষার কাজে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে, তাই শেষ চেষ্টা।
পাখি দেখার জন্য যখন ইতিউতি করছি, ঠিক তখন আশপাশ থেকে বাচ্চা পাখির কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। কান খাড়া করে আওয়াজের উৎস বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হলো, পেছন দিক থেকেই আসছে। পাঁচ কদম যেতেই একটা জারুলগাছ। হ্যাঁ, এখান থেকেই আওয়াজ আসছে। ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত। বাসার মতো কিছু একটা চোখে পড়ল। হঠাৎ চোখে পড়ল সাদা-কালো দুটি ছোট্ট পাখি। ক্লিক করলাম, ওরা উড়াল দিল। ইশ, ঝাপসা হয়ে গেছে। এরপর পাক্কা দুই ঘণ্টা অপেক্ষা। শেষমেশ একটির দেখা পেলাম পাশের বেতঝোপে। সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ দুই বাচ্চাসহ বাবা-মায়ের দেখা মিলল। একসময় ওরা বাসায় ঢুকল। আমরা বিদায় নিলাম।
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম, ওরা আমাদের স্বল্প পরিচিত গায়ক পাখি ‘সাদা-কোমর মুনিয়া’ (White-rumped Munia)। বৈজ্ঞানিক নাম Lonchura striata। অন্যান্য মুনিয়ার মতো শহর-বন্দর-গ্রামে দেখা যায় না। কারণ, এদের আবাস পাহাড়ি এলাকায়। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের চিরসবুজ বন ছাড়া দেখা মেলা ভার। এরা লম্বায় মাত্র ১০ সেন্টিমিটার, তিলা মুনিয়ার থেকেও ১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার ছোট। ওজন মাত্র ১২ গ্রাম। গায়ের রঙে গাঢ় কালচে বাদামি ও সাদার প্রাধান্য। হঠাৎ দেখলে সাদা-কালোই মনে হবে। পূর্ণবয়স্ক পাহাড়ি মুনিয়াগুলোর পুরো দেহ গাঢ় কালচে বাদামি। পিঠ, লেজের ওপরের পালক ও ডানার পালকে সূক্ষ্ম হালকা দাগ রয়েছে। কোমর সাদা। ছোট ও চোখা লেজ কালো। গলা ও বুক কালচে-বাদামি, বুকে সূক্ষ্ম হালকা দাগ। পেট ক্রিম সাদা। ওপরের ঠোঁট কালো ও নিচেরটা নীলচে ধূসর। চোখ লালচে বাদামি। পা গাঢ় ধূসর। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। বাচ্চাগুলোর কোমর ও দেহের নিচের অংশ হালকা ছোপযুক্ত বাদামি।
এরা মাধ্যমিক জঙ্গল, বনের সাফ করা অংশ, বাগান ও ঝোপে বাস করে। সাদা-কোমর মুনিয়া দলবদ্ধ পাখি, একসঙ্গে ১৫-২০টি পর্যন্ত থাকতে পারে। মাটিতে খুঁটে খুঁটে বাঁশ ও ঘাসবিচি খায়। ‘ট্রি-ট্রি-ট্রি-প্রিট ও ব্রিট’ স্বরে ডাকে।
মে-আগস্ট প্রজননকাল। ছোট ছোট গাছের উঁচু শাখায় বড় আকারের ঘাস বা বাঁশপাতা দিয়ে ছোট্ট গোল বাসা বানায়। বাসায় ঢোকার পথ সরু নলের মতো। ঘাসফুল দিয়ে পথের ভেতরটা মুড়ে নেয়। জারুলগাছে এ রকম আমি দেখেছি। বাসার ভেতরেও থাকে ঘাসফুলের গদি। স্ত্রী মুনিয়া তিন-আটটি ধবধবে সাদা ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৩-১৪ দিনে। বাচ্চাদের পোকামাকড় খাইয়ে বড় করে তোলে।
যদিও বিভিন্ন প্রজাতির মুনিয়া খাঁচাবন্দী অবস্থায় রাস্তাঘাট ও পেটশপে দেদার বিক্রি হচ্ছে। আজ পর্যন্ত সাদা-কোমর মুনিয়া কোথাও বিক্রি হতে দেখিনি। দুষপ্রাপ্যতার জন্যই হয়তো এ সুন্দর পাখিগুলো শিকারি ও বিক্রেতাদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। যাহোক, কামনা করি পাহাড়ি সাদা-কালো মুনিয়াগুলো এভাবেই বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।

No comments

Powered by Blogger.