চলচ্চিত্র শিল্প-ফিরে আসুক হারানো গৌরব
চলচ্চিত্র একই সঙ্গে আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি। বাংলা ভাষায় দুটি শব্দই শিল্প বলে আখ্যায়িত হয়। কিন্তু পরিহাস হলো, বাংলাদেশে নির্মিত অধিকাংশ চলচ্চিত্রই আর্ট হিসেবে মানোত্তীর্ণ হতে পারে না, আবার ইন্ডাস্ট্রি হিসেবেও অর্থনীতিতে চলচ্চিত্র বিশেষ অবদান রাখতে পারে না।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতে যখন রীতিমতো বিনোদন সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে আর সেই সাম্রাজ্যের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে বলিউডের সিনেমা তখন একেবারে উল্টোচিত্র বাংলাদেশে। এখানে মূলধারার সিনেমা রীতিমতো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এফডিসিতে নির্মিত সিনেমাগুলোর দর্শক আকৃষ্ট করতে পারছে না। ব্যবসাসফলও হতে পারছে না। সিনেমা তৈরির হার যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সিনেমাকেন্দ্রিক অন্যান্য বাণিজ্যিক উদ্যোগও। সিনেমা প্রদর্শনের বাণিজ্যে রীতিমতো ধস নেমেছে। ১৯৯০ সালের এক হাজার ৪৩৫টি হল এখন ৬১৮তে এসে ঠেকেছে। দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে ঐতিহ্যবাহী অনেক প্রেক্ষাগৃহই বন্ধ হয়ে যাবে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষরা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট পণ্যে ভর্তুকি দাবি করছেন। সিনেমায় কর রেয়াত, সিনেমা নির্মাণে অনুদান থেকে শুরু করে সিনেমা প্রদর্শনের জন্য সিনে কমপ্লেক্স পর্যন্ত দাবির তালিকা অনেক বড়। সিনেমা নির্মাণ থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত সব পর্যায়েই সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দাবি আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সিনেমা কি রুগ্ণ শিল্প? পরিস্থিতি কিন্তু উল্টো কথাই বলে। ইন্টারনেট ও টেলিভিশন প্রযুক্তির রমরমার যুগে সিনেমাকে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বটে; কিন্তু বড় পর্দার চাহিদা কমেনি। বরং প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল বাজেটের সিনেমা নির্মিত হচ্ছে হরহামেশা। সেগুলো বাজার মাত করে বিনিয়োগ তো বটেই, অনেকগুণ লাভও তুলে আনছে। বলিউডের সিনেমাগুলোর সফলতা নিত্যই দর্শকদের বিস্মিত করছে। কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমাগুলো একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছে। এই ব্যর্থতার পেছনের কারণগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় শনাক্তও হয়েছে। অভিযোগ আছে, এখানে মূলধারার সিনেমায় সৃষ্টিশীলতা ও নতুন উদ্যোগের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এফডিসিতে প্রতিভাবান ও তরুণ নির্মাতাদের সিনেমা তৈরির সুযোগ খুবই সীমিত। ফলে এখানে সিনেমা নিয়ে প্রত্যাশিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। বরং পুরনো বাঁধাগতের সিনেমা পুরনো ফর্মুলার চর্বিতচর্বণ বা অন্য দেশের সিনেমার ব্যর্থ অনুকরণ হিসেবে নির্মিত হচ্ছে। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের দর্শকরা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। দেশের বিপুল মধ্যবিত্ত দর্শকের বিনোদন কেন্দ্রের তালিকায় আর সিনেমা হল নেই। এফডিসির চলচ্চিত্রের দর্শক মূলত সীমিতসংখ্যক নিম্নআয়ের মানুষ। শুধু সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রেই নয়, প্রযোজনার ক্ষেত্রেও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। নতুন যুগের চাওয়া-পাওয়া বিশ্লেষণ করে করণীয় নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন আমাদের প্রযোজকরা। নতুন বিনিয়োগকারীরা সিনেমার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না। গত দুই দশকে সিনেমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটে গেছে তার ছোঁয়াও এখানে লাগেনি। বিশ্বব্যাপী পুরনো সিনেমা হলগুলো হারিয়ে গিয়ে বড় বিপণিকেন্দ্রগুলোতে তৈরি হয়েছে সিনেপ্লেক্স বা মাল্টিপ্লেক্স। আমাদের দেশে দু'একটি সিনেপ্লেক্স হলেও প্রদর্শন বাণিজ্যের নতুন এই ধারা আয়ত্ত হয়নি। এমন বহু কারণে সিনেমা দর্শক হারিয়েছে। গভীর সংকটে পড়েছে চলচ্চিত্র শিল্প। কিন্তু ভারতের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, নিজেদের প্রতিভা, সৃষ্টিশীলতা, বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো সিনেমাকে সফল করতে পারে, এমনকি দেশের বাইরেও বাজার সৃষ্টি করতে পারে। এমন উদাহরণ থাকতে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে যদি দেশের সিনেমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য সিনেমা নির্মাণ, বিপণন ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয় তবে তা সবাইকে উৎসাহিত করবে। তবে এক্ষেত্রে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, লাভজনক এ শিল্পের প্রতিটি স্তরে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য করণীয় নির্ধারণ ও
বাস্তবায়নও জরুরি।
No comments