বিশ্বায়ন-সংস্কৃতির মিশ্রণ: সংঘাত ও বিকল্প by মোহীত উল আলম
এবারের পয়লা বৈশাখ খুব জাঁকজমক ও স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে পালিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, বৈশাখী খাওয়া, মিছিল-উৎসব, উৎসবে ব্যবহূত বিচিত্র-রঙা পোস্টার, ব্যানার, মুখোশ, ভেঁপু, শব্দিত যন্ত্র এবং জন্তু-জানোয়ার ও পাখির বড় বড় চলমান বাঁশের তৈরি কাগজে মোড়ানো মূর্তি ছিল উৎসবের উপকরণ। সারা দিনই ঢাকা,
চট্টগ্রামসহ সব শহরের বড় বড় রাস্তায় নেমে আসা জনতার ঢলে নাচ-গান, মুখে-হাতে রঙের নকশা ফোটানো এবং ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণের আগ্রহ স্বচক্ষে দেখে মনে হয়েছে, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এবার সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।
মানুষের এই ব্যাপক অংশগ্রহণকে ইতিবাচক সূত্র মনে করে আজ আলোচনা করতে চাই যে কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করা যায়। আমার আলোচনায় তিনটে পরস্পরনির্ভর প্রশ্ন তুলে আনব: বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্ক কি সংঘাতমূলক, নাকি সহযোগিতামূলক, নাকি শক্তিশালী বিকল্প সংস্কৃতি তৈরির প্রয়োজনীয়তামূলক?
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আধুনিক সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণার পরিচিতি দেওয়া দরকার। রোনাল্ডো রিসাল্টো, ঔপন্যাসিক ও নৃতত্ত্ববিদ অমিতাভ ঘোষসহ অনেকে বলছেন, সংস্কৃতির যে একটি মৌল-পরিচয় খোঁজা হয় সেটি আসলে মানব-ইতিহাসের কোনো পর্যায়ে বিদ্যমান ছিল না। সব মৌল সমাজই চিরদিন অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে পুষ্ট হয়েছে। হোমি কে ভাবা তাঁর লোকেশন অব কালচার গ্রন্থের একটি রচনায় বলেছেন, সমাজের প্রান্তসীমায় একটি মৌল সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির যে লেনদেন বা বনিবনা হয়, তরল হলেও সেটিই একটি সমাজের মূল সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করে। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ জেমস ক্লিফোর্ড সংস্কৃতির বাতাবরণকে রেলস্টেশন বা বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যাত্রী আসছে-যাচ্ছে, নতুন পরিচিতি হচ্ছে, পরিচিতি ভাঙছে, আবার নতুন পরিচিতি তৈরি হচ্ছে। সংস্কৃতির এই মিশ্রণ বা হাইব্রিডাইজেশনমুখী চরিত্র লক্ষ করে আরেকজন নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট ডিক্সন সংস্কৃতিকে পোরাস বা ছিদ্রসর্বস্ব বা চালুনিসম বলেছেন। চালুনির যেমন শত ছিদ্র থাকে, সংস্কৃতিরও তাই।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তিনটে জোরালো সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখতে পাই। ইংরেজি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি, আরবি বা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি এবং হিন্দি বা ভারতীয় সংস্কৃতি।
ইংরেজির সঙ্গে আমাদের প্রেম-দ্বেষ বা লাভ-হেইট সম্পর্ক অনেক দিনের। তারা আমাদের শাসন করে শিখিয়েছে, আমরা তাদের চেয়ে সব বিষয়ে নিকৃষ্ট। আমরাও সেটা মেনে নিয়ে গর্ব করে স্কুলগামী শিশুর মায়ের মতো প্রতিবেশী মাকে বলি যে, ‘আমার ছেলে না, আপা, বাংলা একদম পারে না!’ অথচ আমরা যদি জানি যে ৪৫০ বছর আগে ইংরেজ দেশপ্রেমিক ভাষাবিদদের তাড়না ছিল লাতিন ও ফরাসি ভাষা হটিয়ে ইংরেজিকে মাতৃভাষা হিসেবে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে বুঝব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ভুল। আমরা কেন তাই মনে করি না যে এখন থেকে চেষ্টা করলে একদিন বাংলাও বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে? ইংরেজি এখন প্রধান বিশ্বভাষা, সে জন্য আমাদের ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত ইংরেজি-ঐতিহ্য আমাদের এ ভাষায় সড়গড় থাকার ব্যাপারে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। তাই বলে ১৬ কোটি লোক ইংরেজিতে সড়গড় হবে, এটা ভাবা অবাস্তব। কারণ, তৃতীয় বাক্যের পর ইংরেজি জানা শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে শতকরা হিসাবে বিয়োগের দিকে আছে। সাহিত্য নিয়ে বলি, কবি কায়সার হক ইংরেজিতে কবিতা লেখেন, কারণ ইংরেজি তাঁর কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। তিনি উঁচুদরের কবিও। কিন্তু আরেকজন কায়সার হক আসতে ২০-৩০ বছর সময় নেবে, সে সময়ের মধ্যে বাংলায় বহু-বহু কবি জন্মাবেন, যাঁরা বাংলায় কবিতা লিখে নাম করবেন। দেশের সংস্কৃতি বা কবিতা তো ইংরেজিতে কবি তৈরি হওয়ার জন্য থেমে থাকবে না। আবার আরেকটা আন্তর্জাতিক সত্য দেখুন, পৃথিবীর বহু দেশের ইংরেজি জানার মান বাংলাদেশের মানের চেয়ে অনেক অনেক নিচে। যেমন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা চীন ও জাপান। কিন্তু এদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের মান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ওপরের সূচকে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কথিত করে আমরা ইংরেজি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার মানসিকতার মাধ্যমে যে দাস্যানুবৃত্তির সৃষ্টি করেছিলাম, ঠিক সেই একই মেজাজে আমরা ধর্মীয় দিক থেকে ভুলভাবে মনে করি যে বাংলাদেশ ইসলামি দেশ হওয়ার অর্থ হলো এর জলবায়ু হতে হবে মরু প্রকৃতির; এর আরাধ্য বৃক্ষ হবে বটগাছ নয়, খেজুর গাছ; এর প্রামাণ্য জীব হবে দুম্বা বা আরবীয় ভেড়া, ইলিশ মাছ নয়। আর বাংলাদেশিদের পরিধান হবে লুঙ্গি, গামছা বা শাড়ি নয়, আপদমস্তক মোড়ানো জোব্বা। আবহাওয়ার আর্দ্রতার আধিক্যের প্রশ্নটি যেন ধর্তব্যে আনার মতো নয়। গায়ের চামড়া ঘামে ভিজে অসুস্থ হয়ে যাক শরীর, কিন্তু কাপড়টা মোড়ানো থাক। এ প্রচেষ্টায় নিয়ত থেকে সমাজের একটি ধর্মবাদী অংশ ধর্মকে মৌলবাদীরূপে ব্যাখ্যা করে সময়ে সময়ে দেশে অশান্তির সৃষ্টি করছে। অথচ পরিষ্কার কথা হলো, ধর্ম কাজ করে মানুষের মনে, দেশের ভূগোলের ওপর নয়। খ্রিষ্টান ধর্ম মরুভূমিময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে জন্ম নিয়ে একদিকে গেছে শীতপ্রধান ইংল্যান্ড ও রাশিয়ায়, অন্যদিকে গেছে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশ ব্রাজিলে, কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়া দ্বীপপুঞ্জে। খ্রিষ্টান ধর্ম মানুষের মন বদলাতে পেরেছে, কিন্তু ভূগোল বদলাতে পারেনি। এক এক দেশের খ্রিষ্টানরা এক এক দেশের জলবায়ু অনুযায়ী পোশাক পরে, জীবনযাপন করে এবং ভাষানুযায়ী কথা বলে।
আরেকটা কথা হলো, ধর্ম একটা ভাষাকে নির্ভর করে প্রচারিত ও প্রসারিত হলেও, ধর্মের পরিচয় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক, কিন্তু ভাষার পরিচয় অসাম্প্রদায়িক। ভাষার কাজ হলো অনেকটা টাকার মতো। টাকা দিয়ে যেমন ভালো কাজ করা যায়, আবার খারাপ কাজও করা যায়, তেমনি সব ভাষাই মানবসমাজের সব রকম আজ্ঞা পালন করতে প্রস্তুত। এটাকে সাম্প্রদায়িক কাজে যেমন তেমনি অসাম্প্রদায়িক কাজেও ব্যবহার করা যায়। এক অর্থে, ভাষা হচ্ছে মানবসমাজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সবচেয়ে বড় দাস। সে জন্য যে ভাষায় ধর্মগ্রন্থ লেখা হতে পারে, সে ভাষায় আবার ইতর গ্রন্থও লেখা হতে পারে। একক নিজস্ব পরিচয়ে ভাষার মধ্যে কোনো পবিত্রতা বা অপবিত্রতা নেই।
উপরিউক্ত ব্যাখ্যাটি মেনে নিলে বুঝব যে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির ওপর জোর করে চাপানোর কায়দাটি কেন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
বাঙালি সংস্কৃতির ওপর তৃতীয় হামলাটি আসছে ভারতের হিন্দি সংস্কৃতি থেকে। সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুত প্রসারণশীল সংস্কৃতি এখন হিন্দি। শুনেছি গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ হিন্দি সংস্কৃতির সমঝদার। হিন্দি গান, নাচ, চলচ্চিত্র এবং হিন্দি টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের সাধারণ্যের গৃহে দৃশ্যমান সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে, বিবাহ-সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদিতে এবং টিভির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে হিন্দি সংস্কৃতির আবেদন যুবসমাজের কাছে ব্যাপকভাবে আদৃত হচ্ছে। এদের কথাবার্তার ধরন, চালচলন, পোশাক-আশাকের চেহারায় সবকিছুতে হিন্দি সংস্কৃতির ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশের সিনেমা ও নাটক ন্যক্কারজনকভাবে হিন্দি সংস্কৃতির অনুসারী।
তবে পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবের তুলনায় হিন্দি প্রভাবের পার্থক্য হলো এই যে, প্রথম দুটি তাত্ত্বিকভাবে এবং ভাষাগতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের পথে অন্তরায়, কিন্তু হিন্দির প্রভাবটা মনোজগতের গভীরে ক্রিয়াশীল নয়। এটার দৌড় বিয়েবাড়ির গায়েহলুদ অনুষ্ঠান পর্যন্ত বিস্তৃত। আরেকটা কারণ, কেন হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাবটা প্রভাব বলে মনে হয় না সেটা হচ্ছে, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে বাঙালি সংস্কৃতির কাছাকাছি সংস্কৃতি হচ্ছে হিন্দি সংস্কৃতি। সে জন্য কোনো কিছু জোর করে ভাবতে হবে বা বদলাতে হবে, এমন চাপ বাঙালির মনের ওপর হিন্দি সংস্কৃতির দ্বারা সৃষ্টি হয় না।
তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি ওপরের তিনটি সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাতমূলক সম্পর্কের মধ্যে থাকবে? না। আলোচনার সূত্রপাতে বলেছি, সংস্কৃতিতে মিশ্রণই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এখানে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাব যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রভাবও, আর তেমনি থাকবে উঠতি হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব। ব্যাপারটা হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অপরাপর সংস্কৃতির সহযোগিতামূলক বাতাবরণ তৈরি হতে হবে। এমনভাবে ভারসাম্যটা রক্ষা করতে হবে যাতে বাঙালি সংস্কৃতি আগ্রাসনের হুমকির মুখে না পড়ে।
তবে ওপরে যে সহযোগিতার কথা বললাম, বর্তমানে আমাদের সমাজ যে অবস্থানে আছে তাতে সহযোগিতা করতে গেলেই বাঙালি সংস্কৃতি চাপের মুখে পড়বে। তৃতীয় যে সমাধানের কথা বলেছিলাম সেটি, আমার মতে, সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। অর্থাৎ বিকল্প (এখানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার) পন্থার জোর বাড়াতে হবে। একসময় আমরা গুড় খেতাম। চিনি এসে এমন একটা জোরদার বিকল্প সৃষ্টি করল যে মানুষ গুড়ের কথা ভুলেই গেল। বা গুড়ের বাজারই উঠে গেল। তেমনি সব ক্ষেত্রে যদি কেবলই বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির সংযোজন বরাবর বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন অন্য সংস্কৃতির প্রভাবগুলো আপনাতেই মিইয়ে আসবে। এককালে আমাদের নারীরা ভারতীয় সিল্ক না হলে পরতেন না। এখন রাজশাহী, টাঙ্গাইল সে বাজার দখল করেছে। এভাবে সর্বত্র—বাসগৃহ তৈরির সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে রাস্তার বিটুমিন পর্যন্ত, বিদেশি মুদ্রণের পরিবর্তে দেশীয় মুদ্রণ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধ, দেশীয় বাংলায় ওয়েবসাইট, দেশে তৈরি বাণিজ্যিক জাহাজ, সবগুলোর যদি অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে উৎপাদন হতে থাকে, দেখা যাবে যে জীবনযাপনে বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যবোধ অনেক প্রবল হচ্ছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ জেগে উঠছে সাম্প্রতিক সময়ে এবং একটি অগ্রসরমাণ সমাজের চিহ্ন হলো, নিজেদের সংস্কৃতিকে চিহ্নিতকরণ, অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করা এবং বিপুল পরিমাণে নিজস্ব সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পুনঃপুন উৎপাদন করা। এই প্রক্রিয়াগুলো এখন খুব সজাগ বাংলাদেশে।
কবি আহসান হাবীবের ভাষায়, এখন আমাদের হচ্ছে ‘আশায় বসতি’।
ড. মোহীত উল আলম: প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
মানুষের এই ব্যাপক অংশগ্রহণকে ইতিবাচক সূত্র মনে করে আজ আলোচনা করতে চাই যে কীভাবে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করা যায়। আমার আলোচনায় তিনটে পরস্পরনির্ভর প্রশ্ন তুলে আনব: বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্ক কি সংঘাতমূলক, নাকি সহযোগিতামূলক, নাকি শক্তিশালী বিকল্প সংস্কৃতি তৈরির প্রয়োজনীয়তামূলক?
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আধুনিক সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণার পরিচিতি দেওয়া দরকার। রোনাল্ডো রিসাল্টো, ঔপন্যাসিক ও নৃতত্ত্ববিদ অমিতাভ ঘোষসহ অনেকে বলছেন, সংস্কৃতির যে একটি মৌল-পরিচয় খোঁজা হয় সেটি আসলে মানব-ইতিহাসের কোনো পর্যায়ে বিদ্যমান ছিল না। সব মৌল সমাজই চিরদিন অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে পুষ্ট হয়েছে। হোমি কে ভাবা তাঁর লোকেশন অব কালচার গ্রন্থের একটি রচনায় বলেছেন, সমাজের প্রান্তসীমায় একটি মৌল সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির যে লেনদেন বা বনিবনা হয়, তরল হলেও সেটিই একটি সমাজের মূল সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করে। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ জেমস ক্লিফোর্ড সংস্কৃতির বাতাবরণকে রেলস্টেশন বা বিমানবন্দরের ট্রানজিট লাউঞ্জের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যাত্রী আসছে-যাচ্ছে, নতুন পরিচিতি হচ্ছে, পরিচিতি ভাঙছে, আবার নতুন পরিচিতি তৈরি হচ্ছে। সংস্কৃতির এই মিশ্রণ বা হাইব্রিডাইজেশনমুখী চরিত্র লক্ষ করে আরেকজন নৃতত্ত্ববিদ রবার্ট ডিক্সন সংস্কৃতিকে পোরাস বা ছিদ্রসর্বস্ব বা চালুনিসম বলেছেন। চালুনির যেমন শত ছিদ্র থাকে, সংস্কৃতিরও তাই।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে তিনটে জোরালো সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখতে পাই। ইংরেজি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি, আরবি বা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি এবং হিন্দি বা ভারতীয় সংস্কৃতি।
ইংরেজির সঙ্গে আমাদের প্রেম-দ্বেষ বা লাভ-হেইট সম্পর্ক অনেক দিনের। তারা আমাদের শাসন করে শিখিয়েছে, আমরা তাদের চেয়ে সব বিষয়ে নিকৃষ্ট। আমরাও সেটা মেনে নিয়ে গর্ব করে স্কুলগামী শিশুর মায়ের মতো প্রতিবেশী মাকে বলি যে, ‘আমার ছেলে না, আপা, বাংলা একদম পারে না!’ অথচ আমরা যদি জানি যে ৪৫০ বছর আগে ইংরেজ দেশপ্রেমিক ভাষাবিদদের তাড়না ছিল লাতিন ও ফরাসি ভাষা হটিয়ে ইংরেজিকে মাতৃভাষা হিসেবে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে বুঝব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ভুল। আমরা কেন তাই মনে করি না যে এখন থেকে চেষ্টা করলে একদিন বাংলাও বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে? ইংরেজি এখন প্রধান বিশ্বভাষা, সে জন্য আমাদের ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত ইংরেজি-ঐতিহ্য আমাদের এ ভাষায় সড়গড় থাকার ব্যাপারে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। তাই বলে ১৬ কোটি লোক ইংরেজিতে সড়গড় হবে, এটা ভাবা অবাস্তব। কারণ, তৃতীয় বাক্যের পর ইংরেজি জানা শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে শতকরা হিসাবে বিয়োগের দিকে আছে। সাহিত্য নিয়ে বলি, কবি কায়সার হক ইংরেজিতে কবিতা লেখেন, কারণ ইংরেজি তাঁর কাছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। তিনি উঁচুদরের কবিও। কিন্তু আরেকজন কায়সার হক আসতে ২০-৩০ বছর সময় নেবে, সে সময়ের মধ্যে বাংলায় বহু-বহু কবি জন্মাবেন, যাঁরা বাংলায় কবিতা লিখে নাম করবেন। দেশের সংস্কৃতি বা কবিতা তো ইংরেজিতে কবি তৈরি হওয়ার জন্য থেমে থাকবে না। আবার আরেকটা আন্তর্জাতিক সত্য দেখুন, পৃথিবীর বহু দেশের ইংরেজি জানার মান বাংলাদেশের মানের চেয়ে অনেক অনেক নিচে। যেমন মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা চীন ও জাপান। কিন্তু এদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের মান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ওপরের সূচকে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড কথিত করে আমরা ইংরেজি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার মানসিকতার মাধ্যমে যে দাস্যানুবৃত্তির সৃষ্টি করেছিলাম, ঠিক সেই একই মেজাজে আমরা ধর্মীয় দিক থেকে ভুলভাবে মনে করি যে বাংলাদেশ ইসলামি দেশ হওয়ার অর্থ হলো এর জলবায়ু হতে হবে মরু প্রকৃতির; এর আরাধ্য বৃক্ষ হবে বটগাছ নয়, খেজুর গাছ; এর প্রামাণ্য জীব হবে দুম্বা বা আরবীয় ভেড়া, ইলিশ মাছ নয়। আর বাংলাদেশিদের পরিধান হবে লুঙ্গি, গামছা বা শাড়ি নয়, আপদমস্তক মোড়ানো জোব্বা। আবহাওয়ার আর্দ্রতার আধিক্যের প্রশ্নটি যেন ধর্তব্যে আনার মতো নয়। গায়ের চামড়া ঘামে ভিজে অসুস্থ হয়ে যাক শরীর, কিন্তু কাপড়টা মোড়ানো থাক। এ প্রচেষ্টায় নিয়ত থেকে সমাজের একটি ধর্মবাদী অংশ ধর্মকে মৌলবাদীরূপে ব্যাখ্যা করে সময়ে সময়ে দেশে অশান্তির সৃষ্টি করছে। অথচ পরিষ্কার কথা হলো, ধর্ম কাজ করে মানুষের মনে, দেশের ভূগোলের ওপর নয়। খ্রিষ্টান ধর্ম মরুভূমিময় মধ্যপ্রাচ্য থেকে জন্ম নিয়ে একদিকে গেছে শীতপ্রধান ইংল্যান্ড ও রাশিয়ায়, অন্যদিকে গেছে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশ ব্রাজিলে, কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের সামোয়া দ্বীপপুঞ্জে। খ্রিষ্টান ধর্ম মানুষের মন বদলাতে পেরেছে, কিন্তু ভূগোল বদলাতে পারেনি। এক এক দেশের খ্রিষ্টানরা এক এক দেশের জলবায়ু অনুযায়ী পোশাক পরে, জীবনযাপন করে এবং ভাষানুযায়ী কথা বলে।
আরেকটা কথা হলো, ধর্ম একটা ভাষাকে নির্ভর করে প্রচারিত ও প্রসারিত হলেও, ধর্মের পরিচয় হচ্ছে সাম্প্রদায়িক, কিন্তু ভাষার পরিচয় অসাম্প্রদায়িক। ভাষার কাজ হলো অনেকটা টাকার মতো। টাকা দিয়ে যেমন ভালো কাজ করা যায়, আবার খারাপ কাজও করা যায়, তেমনি সব ভাষাই মানবসমাজের সব রকম আজ্ঞা পালন করতে প্রস্তুত। এটাকে সাম্প্রদায়িক কাজে যেমন তেমনি অসাম্প্রদায়িক কাজেও ব্যবহার করা যায়। এক অর্থে, ভাষা হচ্ছে মানবসমাজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সবচেয়ে বড় দাস। সে জন্য যে ভাষায় ধর্মগ্রন্থ লেখা হতে পারে, সে ভাষায় আবার ইতর গ্রন্থও লেখা হতে পারে। একক নিজস্ব পরিচয়ে ভাষার মধ্যে কোনো পবিত্রতা বা অপবিত্রতা নেই।
উপরিউক্ত ব্যাখ্যাটি মেনে নিলে বুঝব যে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির ওপর জোর করে চাপানোর কায়দাটি কেন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
বাঙালি সংস্কৃতির ওপর তৃতীয় হামলাটি আসছে ভারতের হিন্দি সংস্কৃতি থেকে। সম্ভবত পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুত প্রসারণশীল সংস্কৃতি এখন হিন্দি। শুনেছি গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ হিন্দি সংস্কৃতির সমঝদার। হিন্দি গান, নাচ, চলচ্চিত্র এবং হিন্দি টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের সাধারণ্যের গৃহে দৃশ্যমান সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে, বিবাহ-সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদিতে এবং টিভির বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে হিন্দি সংস্কৃতির আবেদন যুবসমাজের কাছে ব্যাপকভাবে আদৃত হচ্ছে। এদের কথাবার্তার ধরন, চালচলন, পোশাক-আশাকের চেহারায় সবকিছুতে হিন্দি সংস্কৃতির ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশের সিনেমা ও নাটক ন্যক্কারজনকভাবে হিন্দি সংস্কৃতির অনুসারী।
তবে পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবের তুলনায় হিন্দি প্রভাবের পার্থক্য হলো এই যে, প্রথম দুটি তাত্ত্বিকভাবে এবং ভাষাগতভাবে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশের পথে অন্তরায়, কিন্তু হিন্দির প্রভাবটা মনোজগতের গভীরে ক্রিয়াশীল নয়। এটার দৌড় বিয়েবাড়ির গায়েহলুদ অনুষ্ঠান পর্যন্ত বিস্তৃত। আরেকটা কারণ, কেন হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাবটা প্রভাব বলে মনে হয় না সেটা হচ্ছে, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে বাঙালি সংস্কৃতির কাছাকাছি সংস্কৃতি হচ্ছে হিন্দি সংস্কৃতি। সে জন্য কোনো কিছু জোর করে ভাবতে হবে বা বদলাতে হবে, এমন চাপ বাঙালির মনের ওপর হিন্দি সংস্কৃতির দ্বারা সৃষ্টি হয় না।
তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি ওপরের তিনটি সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘাতমূলক সম্পর্কের মধ্যে থাকবে? না। আলোচনার সূত্রপাতে বলেছি, সংস্কৃতিতে মিশ্রণই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এখানে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাব যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রভাবও, আর তেমনি থাকবে উঠতি হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব। ব্যাপারটা হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অপরাপর সংস্কৃতির সহযোগিতামূলক বাতাবরণ তৈরি হতে হবে। এমনভাবে ভারসাম্যটা রক্ষা করতে হবে যাতে বাঙালি সংস্কৃতি আগ্রাসনের হুমকির মুখে না পড়ে।
তবে ওপরে যে সহযোগিতার কথা বললাম, বর্তমানে আমাদের সমাজ যে অবস্থানে আছে তাতে সহযোগিতা করতে গেলেই বাঙালি সংস্কৃতি চাপের মুখে পড়বে। তৃতীয় যে সমাধানের কথা বলেছিলাম সেটি, আমার মতে, সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। অর্থাৎ বিকল্প (এখানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার) পন্থার জোর বাড়াতে হবে। একসময় আমরা গুড় খেতাম। চিনি এসে এমন একটা জোরদার বিকল্প সৃষ্টি করল যে মানুষ গুড়ের কথা ভুলেই গেল। বা গুড়ের বাজারই উঠে গেল। তেমনি সব ক্ষেত্রে যদি কেবলই বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির সংযোজন বরাবর বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন অন্য সংস্কৃতির প্রভাবগুলো আপনাতেই মিইয়ে আসবে। এককালে আমাদের নারীরা ভারতীয় সিল্ক না হলে পরতেন না। এখন রাজশাহী, টাঙ্গাইল সে বাজার দখল করেছে। এভাবে সর্বত্র—বাসগৃহ তৈরির সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে রাস্তার বিটুমিন পর্যন্ত, বিদেশি মুদ্রণের পরিবর্তে দেশীয় মুদ্রণ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও ওষুধ, দেশীয় বাংলায় ওয়েবসাইট, দেশে তৈরি বাণিজ্যিক জাহাজ, সবগুলোর যদি অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে উৎপাদন হতে থাকে, দেখা যাবে যে জীবনযাপনে বাঙালি সংস্কৃতির মূল্যবোধ অনেক প্রবল হচ্ছে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ জেগে উঠছে সাম্প্রতিক সময়ে এবং একটি অগ্রসরমাণ সমাজের চিহ্ন হলো, নিজেদের সংস্কৃতিকে চিহ্নিতকরণ, অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করা এবং বিপুল পরিমাণে নিজস্ব সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পুনঃপুন উৎপাদন করা। এই প্রক্রিয়াগুলো এখন খুব সজাগ বাংলাদেশে।
কবি আহসান হাবীবের ভাষায়, এখন আমাদের হচ্ছে ‘আশায় বসতি’।
ড. মোহীত উল আলম: প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা।
mohit_13_1952@yahoo.com
No comments