সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-কেন এই অবক্ষয়? by হাসান শাহরিয়ার

মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই ধারা অব্যাহত আছে। ভালো শিক্ষকই কেবল সত্যিকার ছাত্র গড়ার কারিগর হতে পারেন। এখন সময় এসেছে ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রক্টর সাহেবদের বলতে হবে_ কেন এই অবক্ষয় দেখা দিয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে কী শিক্ষা আপনারা


তাদের দিয়েছেন। এর জন্য কি শুধু ছাত্ররাই দায়ী? আপনাদেরও এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে



মেয়েটা না বললে ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতেই পারতাম না। পত্রিকার খবরে প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠেনি। ওঠার কথাও নয়। কারণ প্রতিবেদকরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তারা প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে শুনে রিপোর্ট করেছেন। তারপরও লজ্জা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাদের প্রতিবেদনে। তারা যদি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন এবং ভয়ঙ্কর ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করতেন অন্যভাবে।
অন্য দশজনের মতো ব্যাংকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে গত বুধবার এই মেয়েটিও প্রখর রৌদ্রতাপ উপেক্ষা করে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন সমাবর্তনের গাউন, হ্যাট ও উপহার নেওয়ার জন্য। এই লাইন ছিল বিশাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও অধিভুক্ত কলেজ থেকে সর্বশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তারা। সমাবর্তনে সনদ নেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাদের পদচারণার অবসান হবে; পরিসমাপ্তি ঘটবে তাদের ছাত্রজীবনের। সেই সঙ্গে শুরু হবে অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চিত যাত্রা আর কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই। মোট ১৬ হাজার ৮শ' গ্র্যাজুয়েট, ৭৫ জন এমফিল ও ৮৯ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং ৫৯ জন স্বর্ণপ্রদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর গাউন সংগ্রহের জন্য টিএসসি মাঠে বুথ করা হয়েছিল ৭২টি। আর উপহার নেওয়ার জন্য বুথের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়টি। সবাই অপেক্ষায় ছিলেন_ কখন টিএসসির প্রধান ফটকটি খুলবে। মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটি ঘটে গেল। ফটক খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাইন আর থাকল না। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল। শুরু হলো ভেতরে ঢোকার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা। যেন আগে পেঁৗছলেই সোনা পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থীদের এই হুড়োহুড়িতে এই মেয়েটিসহ আরও কয়েকজন নিজেদের সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যান। তারপর শত শত শিক্ষার্থী তাদের গায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে-হেঁটে টিএসসিতে ঢুকে পড়ে। 'আমার আর্তচিৎকার কেউ গায়ে মাখেনি, কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।' কান্নাভেজা কণ্ঠে এই উক্তি করে মেয়েটি বললেন, 'এক সময় আমি চোখে অন্ধকার দেখতে পেলাম। পরক্ষণেই মূর্ছা গেলাম।' কতক্ষণ এই অবস্থায় ছিলেন, তা তিনি বলতে পারলেন না। তবে এক পর্যায়ে যখন দু'তিন জন ছাত্র দয়াপরবশ হয়ে তাকে মাটি থেকে টেনে তুললেন, তখন তার জ্ঞান ফিরে আসে। 'ভাগ্যিস আমি উপুড় হয়ে পড়েছিলাম! চিৎ হয়ে পড়লে বোধহয় বাঁচতামই না! সবার পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যেতাম!' মেয়েটি এখন শয্যাশায়ী, সারা দেহে ব্যথা। বড় আশা নিয়ে তিনি টিএসসিতে গিয়েছিলেন; কিন্তু তার সে আশায় গুড়েবালি। তার আর সমাবর্তনে যাওয়া হলো না। এই দুঃখ তিনি কোনোদিন ভুলবেন না।
এসব মেয়ের গায়ের ওপর দিয়ে দৌড়-ঝাঁপ করে টিএসসিতে প্রবেশ করে কী করল উচ্ছৃঙ্খল গ্র্যাজুয়েটরা? তারা সমাবর্তনের স্মারক উপহার সামগ্রী লুট করে নিয়ে গেল। প্রত্যেকের জন্য একটি ব্যাগ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু তারা একেক জন অনেকটি ব্যাগ নিয়ে গেল। তারা যখন লুটতরাজে ব্যস্ত, তখন বেশ কয়েক নারী শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত হন। তবে নারী শিক্ষার্থী সবাই যে ধোয়া তুলসীপাতা তা নয়। তারাও সমভাবে লুটপাটে অংশ নেয়। পুরুষ শিক্ষার্থীদের কাছে পাওয়া গেছে মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, আর নারী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে টাই। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামখচিত মগ নিয়ে যায় একাধিক।
এ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অধিকর্তা ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক লুটপাটের ঘটনাকে 'অসততা' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, সমাবর্তন হলো একটি শৃঙ্খলার অনুষ্ঠান। এখানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা সৃশৃঙ্খল হবে_ এটাই সবার কাম্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা ও সীমাহীন অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তিনি সম্পূূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী সব দোষ অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের গাফিলতি ঢাকার চেষ্টা করেছেন। গাউন, হ্যাট ও উপহার বিতরণের কাজ সমাবর্তনের তিন দিন আগে না করে ১৫ দিন আগে করা হয়নি কেন? এখন প্রশ্ন,শিক্ষার্থীদের ভিড় ও হুড়োহুড়ির চাপে পদদলিত ওই মেয়েটির যদি মৃত্যু হতো, তাহলে তারা কাকে দায়ী করতেন? এ রকম মেয়ে একজন নয়, কমপক্ষে ২০-২৫ জন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি খবর নিয়েছে তারা কী অবস্থায় আছেন?
ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর বলেছেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তার সঙ্গে সবাই একমত হবেন। ভাইস চ্যান্সেলর মর্র্মাহত হয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের আচরণে। তিনি প্রশ্ন করেছেন :'পাঁচ বছরে তোমাদের এই শিখিয়েছি, এই শিক্ষা দিয়েছি?' স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শিক্ষার্জনের প্রতিটি স্তরেই চলছে অরাজকতা। মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতার চাকরিতে আসেন না। কেউ যদি আসতে চান তাহলে তাকে নেওয়া হয় না। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের জন্য প্রভাষক নিয়োগ নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে গেল। চারটি ফার্স্টক্লাস আছে এমন এক প্রার্থীর চাকরি হয়নি। এভাবেই মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই ধারা অব্যাহত আছে। ভালো শিক্ষকই কেবল সত্যিকার ছাত্র গড়ার কারিগর হতে পারেন। এখন সময় এসেছে ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রক্টর সাহেবদের বলতে হবে_ কেন এই অবক্ষয় দেখা দিয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে কী শিক্ষা আপনারা তাদের দিয়েছেন। এর জন্য কি শুধু ছাত্ররাই দায়ী? আপনাদেরও এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। এক সময় আমরা গর্ব করে বলতাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে এশিয়ার বহু দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এখন? বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা পড়তে যায় সেসব দেশে। শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর লেখাপড়ার কি আগের পরিবেশ এখন আছে?
নব্য গ্র্যাজুয়েটদের এই অপরিণামদর্শিতার সমর্থনে কেউ এগিয়ে আসবেন বলে মনে হয় না। তাদের এই অবিমৃষ্যকারিতা প্রমাণ করে_ সুদীর্ঘ ছাত্রজীবনে তারা ভালো কিছু শেখেনি। এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ। দু'দিন পর এরাই যোগ দেবে বিভিন্ন পেশায়। এদের মধ্য থেকেই হবে মন্ত্রী, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক। যারা সমাবর্তনের উপহার লুট করতে পারে, তাদের কাছে জাতি কী আশা করতে পারে? এ বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে একে সোজা রাখতে হবে। এখনও সময় আছে, সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা আমাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারব।

হাসান শাহরিয়ার : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.