স্মৃতি অমলিন by কাজী আসিফ ইমরান

আমার বাবা কাজী আরেফ আহমেদ প্রায়ই বলতেন- 'হাউ ডু ইউ ডু মাই সন? হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?' আজ তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে অনেক স্মৃতির ভিড়ে এ কথাটাই বারবার আমার মাসনপটে ভেসে উঠছে। আমি যেন মাঝেমধ্যেই তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।


১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল এক শুভলগ্নে তার জন্মের সময় মা-বাবা নিশ্চয়ই তাদের সন্তান একদিন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, জজ-ব্যারিস্টার হবে_ এই স্বপ্নই দেখেছিলেন। আমাকে নিয়েও তোমার তেমন উচ্চাশা কি ছিল না? তুমি শেষ পর্যন্ত হলে তুখোড় ছাত্রনেতা, স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াসের অন্যতম সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। এক সময়ের আগুন ঝরানো বিপ্লবের অন্যতম নেতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও পুরোধা। স্বপ্ন দেখেছিলে শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। দেশ স্বাধীন হলেও শোষণমুক্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। অতঃপর ফের সংগ্রামের কাতারে শামিল হওয়া। কী সুতীব্র সংগ্রামেই না মেতেছিলে! নাওয়া নেই-খাওয়া নেই, জীবনের প্রতি মায়া নেই, পার্থিব সুখ-শান্তির প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই। সে এক অদম্যের ছুটে চলা। এর পর ওপেন গ্রাউন্ড-আন্ডারগ্রাউন্ড করতে করতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে স্থিত হওয়া, স্বৈরাচারবিরোধী-রাজাকারবিরোধী সংগ্রাম_ কোথায় ছিলে না তুমি! কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা উজাড় করে দিতে গিয়ে তোমার সন্তানের প্রতিও যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে_ সব সময় কি তা পালন করতে পেরেছিলে? তারপরও তুমি এখনও আমার জীবনে একগুচ্ছ তীব্র আবেগের স্মৃতিকাতরতা। বড় কাছের, বড় আপনজন ।
মানুষ কত রকম স্বপ্ন দেখে। আমি ছোটবেলার মতো এখনও বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রক্ষমতাটাই আসল। কোনো পরিবর্তন বা কিছু করতে চাইলে এই ক্ষমতাটা চাই-ই চাই। ক্ষমতায় আসার পরই শুরু হয় আসল বিপ্লব। রাজপথে তুমি এক পলক স্লোগান, কয়েকটা বুলেট, একটা ভাষণ_ সবটুকুই শুধু চিৎকার। ক্ষমতায় এলে একটা সিগনেচার মানে কয়েক পলক; কিন্তু অসংখ্য ক্ষুধার সমাপ্তি। তোমরা স্বাধীনতা পেয়েছ। অর্থাৎ বিপ্লব সফল। বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব আসবে_ এটা চিরকালীন সত্য। আর এর প্রকোপ যদি কমাতে বা কমানোর চেষ্টা করতেই হয়, তাহলে সেটা ক্ষমতার খুঁটি ধরে কেন নয়? বিপ্লবের জন্য গোপনীয়তা জরুরি। কিন্তু সে জন্য ধারাবাহিকতা হারালে বা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হলে সেটা কি সুকৌশল হতে পারে? আচ্ছা, বিপ্লবের গঠনপ্রণালি কী? প্রথমে আন্দোলন, যার মধ্যে হয় শক্তি সঞ্চয়। অর্থাৎ লোকবল তৈরি, জনমত গঠন আর পরিবর্তন করার সমর্থন অর্জন। আর বিপ্লবের মূল পর্যায় হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাহায্যে প্রয়োজনীয় কাজ করে যাওয়া এবং ক্ষমতাকে সুসংহত করা। এর কিছুই সম্পূর্ণ হয়নি স্বাধীনতা যুদ্ধে। একটা অসম্পূর্ণ ক্যানভাসের মতো, অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো। শ্রমজীবী সম্প্রদায় তোমাদের চেনে না। কেরানিরা স্বপ্নের ছায়া দেখতেও ভয় পায়। বুদ্ধিজীবীরা সাহসী নয়। উচ্চবিত্তরা উদাসীন। তাহলে তোমাদের বিপ্লবটা পূর্ণতা পেল কোথায়? যাকগে, ছোটবেলায় তুমি আমাকে বকতে পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের সঙ্গে মেশার কারণে। সেটা ছিল তোমার চোখে স্বপ্নভঙ্গ।
যা হোক, তুমি এখন যেখানে আছ সেখানে নিশ্চয়ই বিপ্লবের প্রয়োজন হয় না। যদি হয় তাহলে 'আমি আছি।' ভদ্রলোকের এক জবান। ২৪ ঘণ্টা/পুরো সপ্তাহ। আমার ভাষায়, 'ইতিহাস দ্যাখো বিছিয়ে রেখেছি তোমার অপেক্ষায়/পায়ের ছোঁয়ায় এঁকে দাও প্রিয় সভ্য অবক্ষয়।'

No comments

Powered by Blogger.