সহজিয়া কড়চা-আমাদের প্রত্নসম্পদ আমাদের অহংকার by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাঙালি জাতির যে রয়েছে এক গৌরবময় প্রাচীন সভ্যতা, তা প্রমাণে নিদর্শনের অভাব নেই। পাহাড়পুর, ময়নামতি ও মহাস্থানগড় বেশি বিখ্যাত, তবে দেশের প্রতিটি এলাকায়ই রয়েছে প্রত্নসম্পদ। প্রত্নসম্পদ যে সোনা বা হীরার চেয়ে বেশি মূল্যবান, সে সম্পর্কে শিক্ষিত জনগণেরও একটি বড় অংশের সম্যক ধারণা নেই।
কোনো ধনী দেশ কয়েক টন সোনা কিনতে পারে। সোনার একটা বাজারদর আছে। প্রত্নসম্পদের কোনো মূল্য নেই—তা অমূল্য।
পাঁচ শ, হাজার বা দুই হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ইটগুলো দিয়ে বাড়িঘর বা উপাসনালয় বানিয়েছিলেন, তার এক কেজি ওজনের একখানা ইটের দাম সোনার দামের চেয়ে বেশি। তাঁরা মাটি, কাঠ, কষ্টিপাথর বা ধাতু দিয়ে যেসব ব্যবহার্য বস্তু বানিয়েছিলেন, তার সঙ্গে সোনা বা হীরার কোনো তুলনাই হয় না। তাই পাঁচ কেজি ওজনের একটি কষ্টিপাথরের মূর্তির দাম এক কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি।
বিধাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। জীব ও জড় জগতের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁরই সৃষ্টি মানুষ সভ্যতার স্রষ্টা। সব মানুষ সভ্যতার নির্মাতা হতে পারে না। উন্নত মেধা ও রুচির মানুষই সভ্যতার স্রষ্টা। পৃথিবীতে অসংখ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাঙালিও একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী। কিন্তু তার মেধা ও মননশীলতা পৃথিবীর যেকোনো উন্নত জাতির চেয়ে কম নয়। সে এক মহান সভ্যতার স্রষ্টা। যে সভ্যতার বয়স দুই-আড়াই হাজার বছরের বেশি।
আশির দশকের শেষের দিকে আমার একবার খেয়াল হলো, দেশের যত প্রাচীন স্থাপত্য আছে তার একটি তালিকা করব। প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান প্রত্নতত্ত্ববিদের কাজ, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রাচীন ইমারত, মসজিদ, মন্দির, বিহার, গির্জা, মঠ প্রভৃতি যেগুলো সময়ের আঘাতে ও অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার একটি তালিকা থাকা দরকার।
ওই লক্ষ্যে দেশব্যাপী ঘোরাঘুরি শুরু করি, যার নাম দিয়েছিলাম ‘দেশ পরিক্রমা’। ভোরের কাগজ নব্বইয়ের দশকে আমার সেই কাজ নিয়ে একটি ফিচারও করেছিল। তার শিরোনাম দিয়েছিল ‘স্বপ্নের খোঁজে একজন মানুষ’। সে কাজ কিছুদিন বেশ ভালোই সাড়া জাগিয়েছিল। দিল্লির খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রণয় শর্মা দৈনিক টেলিগ্রাফ-এ একটি ফিচার করেছিলেন ‘এ ম্যান উইথ এ ড্রিম’। ঢাকার কোনো কাগজ লিখেছিল ‘ওয়ান ম্যান এনজিও’—তহবিলবিহীন একজন মানুষের বেসরকারি কাজ।
প্রাচীন কীর্তির প্রতি শৈশব থেকেই আমার একটি মোহ রয়েছে। প্রথম ঢাকায় এসে যেদিন বাবার হাত ধরে গিয়ে কার্জন হল দেখেছিলাম, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। তার একটু দূরেই গিয়ে দেখি হাজি শাহবাজের মসজিদ ও তাঁর মাজার। মসজিদের ২০০ গজের মধ্যে রমনা কালীমন্দির। সেদিন বুঝিনি, পরে ষাটের দশকে ভেবে দেখেছি, বাঙালি কত অকৃত্রিম ও খাঁটি অসাম্প্রদায়িক। ২০০ গজের মধ্যে মন্দির ও মসজিদ পৃথিবীর আর কোথায় আছে? একাত্তরে কালীবাড়ি মন্দির পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়। আজও তা পুনর্নির্মাণ করা হয়নি।
পূর্ব বাংলার প্রাচীন কীর্তি সম্পর্কে আঠারো-উনিশ শতকে প্রকাশিত কিছু বইপত্র ও রিপোর্টও আমার দেখার সুযোগ হয়। উইলিয়াম হান্টারের বই ছাড়াও ব্রাডলি, কানিংহাম, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, চন্দ্রশেখর ব্যানার্জি প্রমুখ পণ্ডিতের দেড় শ বছর আগের লেখা বইপত্র দেখি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের কিছু রিপোর্টও আমি কলকাতার পাঠাগারে দেখেছিলাম।
পূর্ব বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধের পরপর অনুসন্ধানের চেষ্টা হয়। তার দুই বছরের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পূর্ব বাংলার ইতিহাসচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ১২টি বিভাগের মধ্যে ইতিহাস বিভাগ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে গবেষণা করা। সরকারের একজন উৎসাহী ইংরেজ কর্মকর্তা তাতে সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার আগে বহু বছর লালবাগ শাহি মসজিদের পাশে ছিলাম। বিকেলে খেলতে বা বেড়াতে যেতাম লালবাগ কেল্লার মাঠে। অমূল্য প্রত্নসম্পদ নানাভাবে নষ্ট হচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ উদ্যোগ নিয়ে লালবাগ কেল্লা, ঢাকার নবাববাড়ি ‘আহসান মঞ্জিল’ প্রভৃতি সংস্কার ও রক্ষার ব্যবস্থা করেন। শিল্পী জয়নুল আবেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সময় সোনারগাঁর প্রাচীন নগর সংস্কার করার। তাঁর সঙ্গে আমরা অনেকে ছিলাম। অকালে তিনি চলে যান।
পূর্ব বাংলায় অপেক্ষাকৃত প্রাচীন জনপদ উত্তরাঞ্চল, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সেখানেই বেশি। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মফিজ চৌধুরী এবং ১০ এপ্রিল ’৭১ মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী একবার আমাকে বগুড়া ও দিনাজপুরে নিয়ে যান। দিনাজপুরে ইউসুফ আলী সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন একজন অত্যন্ত গুণী ও প্রচারবিমুখ ইতিহাস সাধকের সঙ্গে। তাঁর নাম মেহ্বাব আলী। উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে তিনি বহু বইপত্র লিখেছেন। তাঁর কান্তজী মন্দির, কেরী যখন দিনাজপুরে, দিনাজপুর, রাজবাড়ি প্রভৃতি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো সম্পর্কে আমি সামান্য আলোচনাও করেছিলাম। দেশের কাছ থেকে মেহ্বাব আলী সাহেবের যে মর্যাদা প্রাপ্য ছিল, আমরা তাঁকে তা দিইনি। ঢাকায় এলে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতেন, দিনাজপুরে গেলে আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম।
বরেন্দ্র জাদুঘর বাংলাদেশের একটি অমূল্য প্রতিষ্ঠান। দু-একবার সেখানে গিয়ে কাজ করেছি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের উচিত, আরও বেশি অনুদান দেওয়া। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও উচিত, সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসা।
মহাস্থানগড় আমাদের গর্বের ধন। পৃথিবীর যেসব দেশ আমাদের সাহায্য দেয় তাদের আমরা বলতে পারি—এই যে দেখো, আমাদের পূর্বপুরুষদের কী ছিল। তোমাদের অনেকেরই হাজার বছর আগে যা ছিল না। যোগাযোগব্যবস্থার গত কয়েক দশকে উন্নতি হলেও যাতায়াত ব্যয়বহুল। তবে আমি গাড়ি চাইলে দয়া করে অনেকেই আনন্দের সঙ্গেই তা দেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি—তাঁদের একজন আনিসুল হক, আমার অকৃত্রিম অনুরাগী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক শফিকুর রহমানেরও সহযোগিতা পাই।
অনেকটা জায়গা ঘুরে দেখি। বড় মনোরম জায়গা। শত শত বছর আগেও জায়গাটিকে ভালো লেগেছিল বলেই মহান দরবেশ ও সুফি সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহী সওয়ার এসেছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন। এখানে একসময় খরস্রোতা নদী প্রবাহিত হতো। আজ সবুজ ফসলের চাষ হয়। মহাস্থানগড় জাদুঘরের মিসেস নাহিদ সুলতানা, পাহাড়পুর জাদুঘরের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম, প্রথম আলোর মিলন রহমান ও অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মী ও গণ্যমান্যের সঙ্গে অনেক কিছু ঘুরে দেখি।
মহামান্য উচ্চ আদালত মহাস্থানগড়ের মসজিদ, মাজার, প্রত্নসম্পদ যা কিছু যেভাবে আছে, তা সযত্নে রক্ষার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। এলাকার কোথাও কেউ প্রত্নসম্পদের কোনো রকম ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব অমূল্য সম্পদ ও ঐতিহ্য রক্ষায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সম্মিলিত সচেতনতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষকেও বোঝাতে হবে, পুরাকীর্তি আমাদের বড় সম্পদ, গর্বের ধন। এবং তার মালিক আমরা সবাই। তা রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সবার।
ফরাসি বিশেষজ্ঞরাও অতি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। মাটির নিচে প্রাপ্ত হাজার বছরের দ্রব্য নিয়ে গবেষণা করা কঠিন কাজ। ধুলামাটি নিয়ে কারবার। রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। ধন্যবাদ জানালাম। মহাস্থানগড়ের কর্মকর্তারাও যথেষ্ট আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন বলে মনে হলো। জাদুঘরটি অসামান্য। অমূল্য প্রত্নসম্পদে পরিপূর্ণ। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েসহ কত মানুষ প্রতিদিন দেখতে আসে। আশা করি, সরকার, স্থানীয় নেতা ও সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় মহাস্থানগড় একদিন এশিয়ার একটি দর্শনীয় স্থানে ও পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। পর্যটনকেন্দ্র এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখবে।
পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় অতি পুরোনো। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী স্থাপত্যশিল্পও এখনই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সেগুলোও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মহাস্থানগড় ঘুরে আসার কয়েক দিন পরেই আমার বন্ধু খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক আমাকে নিয়ে যান তাঁর এলাকা ধনবাড়ীতে। সেখানে ধনবাড়ী নাট্য পদাতিকের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অতিথি। ধনবাড়ী নতুন উপজেলা এবং নতুন পৌরসভা হয়েছে। নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদেরও সংবর্ধনা হলো। কিন্তু সেসবের চেয়েও ধনবাড়ীতে আমার আকর্ষণ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর বাড়িটি পরিদর্শন। নবাব বাহাদুরের কাছে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ঋণী, যদিও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। তাঁর সুরম্য বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা স্থাপত্য হিসেবে পরবর্তী বংশধরদের জন্য রক্ষা করা অপরিহার্য।
নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি হাজার বছরে আজ এখানে এসেছে। একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পর এই অঞ্চলের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি নিয়ে নতুন করে ও গভীরভাবে অনুসন্ধানের কাজ করার দায়িত্ব বর্তেছে আমাদের ওপর। সেই দায়িত্ব একই সঙ্গে সরকারের ও জনগণের। সে দায়িত্ব পালন করতে হবে ব্যক্তির স্বার্থে নয়, সরকারের স্বার্থে নয়—জাতির স্বার্থে। অহংকার করার মতো আমাদের যা আছে তার পরিচয় তুলে ধরতে হবে দেশবাসীর কাছে ও বিশ্ববাসীর কাছে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পাঁচ শ, হাজার বা দুই হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে ইটগুলো দিয়ে বাড়িঘর বা উপাসনালয় বানিয়েছিলেন, তার এক কেজি ওজনের একখানা ইটের দাম সোনার দামের চেয়ে বেশি। তাঁরা মাটি, কাঠ, কষ্টিপাথর বা ধাতু দিয়ে যেসব ব্যবহার্য বস্তু বানিয়েছিলেন, তার সঙ্গে সোনা বা হীরার কোনো তুলনাই হয় না। তাই পাঁচ কেজি ওজনের একটি কষ্টিপাথরের মূর্তির দাম এক কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি।
বিধাতা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। জীব ও জড় জগতের স্রষ্টা। কিন্তু তাঁরই সৃষ্টি মানুষ সভ্যতার স্রষ্টা। সব মানুষ সভ্যতার নির্মাতা হতে পারে না। উন্নত মেধা ও রুচির মানুষই সভ্যতার স্রষ্টা। পৃথিবীতে অসংখ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাঙালিও একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী। কিন্তু তার মেধা ও মননশীলতা পৃথিবীর যেকোনো উন্নত জাতির চেয়ে কম নয়। সে এক মহান সভ্যতার স্রষ্টা। যে সভ্যতার বয়স দুই-আড়াই হাজার বছরের বেশি।
আশির দশকের শেষের দিকে আমার একবার খেয়াল হলো, দেশের যত প্রাচীন স্থাপত্য আছে তার একটি তালিকা করব। প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান প্রত্নতত্ত্ববিদের কাজ, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ব্যাপার নয়। কিন্তু প্রাচীন ইমারত, মসজিদ, মন্দির, বিহার, গির্জা, মঠ প্রভৃতি যেগুলো সময়ের আঘাতে ও অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার একটি তালিকা থাকা দরকার।
ওই লক্ষ্যে দেশব্যাপী ঘোরাঘুরি শুরু করি, যার নাম দিয়েছিলাম ‘দেশ পরিক্রমা’। ভোরের কাগজ নব্বইয়ের দশকে আমার সেই কাজ নিয়ে একটি ফিচারও করেছিল। তার শিরোনাম দিয়েছিল ‘স্বপ্নের খোঁজে একজন মানুষ’। সে কাজ কিছুদিন বেশ ভালোই সাড়া জাগিয়েছিল। দিল্লির খ্যাতিমান সাংবাদিক প্রণয় শর্মা দৈনিক টেলিগ্রাফ-এ একটি ফিচার করেছিলেন ‘এ ম্যান উইথ এ ড্রিম’। ঢাকার কোনো কাগজ লিখেছিল ‘ওয়ান ম্যান এনজিও’—তহবিলবিহীন একজন মানুষের বেসরকারি কাজ।
প্রাচীন কীর্তির প্রতি শৈশব থেকেই আমার একটি মোহ রয়েছে। প্রথম ঢাকায় এসে যেদিন বাবার হাত ধরে গিয়ে কার্জন হল দেখেছিলাম, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। তার একটু দূরেই গিয়ে দেখি হাজি শাহবাজের মসজিদ ও তাঁর মাজার। মসজিদের ২০০ গজের মধ্যে রমনা কালীমন্দির। সেদিন বুঝিনি, পরে ষাটের দশকে ভেবে দেখেছি, বাঙালি কত অকৃত্রিম ও খাঁটি অসাম্প্রদায়িক। ২০০ গজের মধ্যে মন্দির ও মসজিদ পৃথিবীর আর কোথায় আছে? একাত্তরে কালীবাড়ি মন্দির পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়। আজও তা পুনর্নির্মাণ করা হয়নি।
পূর্ব বাংলার প্রাচীন কীর্তি সম্পর্কে আঠারো-উনিশ শতকে প্রকাশিত কিছু বইপত্র ও রিপোর্টও আমার দেখার সুযোগ হয়। উইলিয়াম হান্টারের বই ছাড়াও ব্রাডলি, কানিংহাম, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, চন্দ্রশেখর ব্যানার্জি প্রমুখ পণ্ডিতের দেড় শ বছর আগের লেখা বইপত্র দেখি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ের পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের কিছু রিপোর্টও আমি কলকাতার পাঠাগারে দেখেছিলাম।
পূর্ব বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধের পরপর অনুসন্ধানের চেষ্টা হয়। তার দুই বছরের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পূর্ব বাংলার ইতিহাসচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ১২টি বিভাগের মধ্যে ইতিহাস বিভাগ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে গবেষণা করা। সরকারের একজন উৎসাহী ইংরেজ কর্মকর্তা তাতে সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতার আগে বহু বছর লালবাগ শাহি মসজিদের পাশে ছিলাম। বিকেলে খেলতে বা বেড়াতে যেতাম লালবাগ কেল্লার মাঠে। অমূল্য প্রত্নসম্পদ নানাভাবে নষ্ট হচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ উদ্যোগ নিয়ে লালবাগ কেল্লা, ঢাকার নবাববাড়ি ‘আহসান মঞ্জিল’ প্রভৃতি সংস্কার ও রক্ষার ব্যবস্থা করেন। শিল্পী জয়নুল আবেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সময় সোনারগাঁর প্রাচীন নগর সংস্কার করার। তাঁর সঙ্গে আমরা অনেকে ছিলাম। অকালে তিনি চলে যান।
পূর্ব বাংলায় অপেক্ষাকৃত প্রাচীন জনপদ উত্তরাঞ্চল, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সেখানেই বেশি। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মফিজ চৌধুরী এবং ১০ এপ্রিল ’৭১ মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠকারী অধ্যাপক ইউসুফ আলী একবার আমাকে বগুড়া ও দিনাজপুরে নিয়ে যান। দিনাজপুরে ইউসুফ আলী সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন একজন অত্যন্ত গুণী ও প্রচারবিমুখ ইতিহাস সাধকের সঙ্গে। তাঁর নাম মেহ্বাব আলী। উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে তিনি বহু বইপত্র লিখেছেন। তাঁর কান্তজী মন্দির, কেরী যখন দিনাজপুরে, দিনাজপুর, রাজবাড়ি প্রভৃতি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো সম্পর্কে আমি সামান্য আলোচনাও করেছিলাম। দেশের কাছ থেকে মেহ্বাব আলী সাহেবের যে মর্যাদা প্রাপ্য ছিল, আমরা তাঁকে তা দিইনি। ঢাকায় এলে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতেন, দিনাজপুরে গেলে আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম।
বরেন্দ্র জাদুঘর বাংলাদেশের একটি অমূল্য প্রতিষ্ঠান। দু-একবার সেখানে গিয়ে কাজ করেছি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের উচিত, আরও বেশি অনুদান দেওয়া। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও উচিত, সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসা।
মহাস্থানগড় আমাদের গর্বের ধন। পৃথিবীর যেসব দেশ আমাদের সাহায্য দেয় তাদের আমরা বলতে পারি—এই যে দেখো, আমাদের পূর্বপুরুষদের কী ছিল। তোমাদের অনেকেরই হাজার বছর আগে যা ছিল না। যোগাযোগব্যবস্থার গত কয়েক দশকে উন্নতি হলেও যাতায়াত ব্যয়বহুল। তবে আমি গাড়ি চাইলে দয়া করে অনেকেই আনন্দের সঙ্গেই তা দেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি—তাঁদের একজন আনিসুল হক, আমার অকৃত্রিম অনুরাগী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক শফিকুর রহমানেরও সহযোগিতা পাই।
অনেকটা জায়গা ঘুরে দেখি। বড় মনোরম জায়গা। শত শত বছর আগেও জায়গাটিকে ভালো লেগেছিল বলেই মহান দরবেশ ও সুফি সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহী সওয়ার এসেছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন। এখানে একসময় খরস্রোতা নদী প্রবাহিত হতো। আজ সবুজ ফসলের চাষ হয়। মহাস্থানগড় জাদুঘরের মিসেস নাহিদ সুলতানা, পাহাড়পুর জাদুঘরের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম, প্রথম আলোর মিলন রহমান ও অন্যান্য গণমাধ্যমকর্মী ও গণ্যমান্যের সঙ্গে অনেক কিছু ঘুরে দেখি।
মহামান্য উচ্চ আদালত মহাস্থানগড়ের মসজিদ, মাজার, প্রত্নসম্পদ যা কিছু যেভাবে আছে, তা সযত্নে রক্ষার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন। এলাকার কোথাও কেউ প্রত্নসম্পদের কোনো রকম ক্ষতি করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব অমূল্য সম্পদ ও ঐতিহ্য রক্ষায় ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সম্মিলিত সচেতনতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষকেও বোঝাতে হবে, পুরাকীর্তি আমাদের বড় সম্পদ, গর্বের ধন। এবং তার মালিক আমরা সবাই। তা রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সবার।
ফরাসি বিশেষজ্ঞরাও অতি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। মাটির নিচে প্রাপ্ত হাজার বছরের দ্রব্য নিয়ে গবেষণা করা কঠিন কাজ। ধুলামাটি নিয়ে কারবার। রাসায়নিক দ্রব্য নিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। ধন্যবাদ জানালাম। মহাস্থানগড়ের কর্মকর্তারাও যথেষ্ট আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন বলে মনে হলো। জাদুঘরটি অসামান্য। অমূল্য প্রত্নসম্পদে পরিপূর্ণ। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েসহ কত মানুষ প্রতিদিন দেখতে আসে। আশা করি, সরকার, স্থানীয় নেতা ও সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টায় মহাস্থানগড় একদিন এশিয়ার একটি দর্শনীয় স্থানে ও পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। পর্যটনকেন্দ্র এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিতেও ভূমিকা রাখবে।
পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় অতি পুরোনো। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী স্থাপত্যশিল্পও এখনই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সেগুলোও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মহাস্থানগড় ঘুরে আসার কয়েক দিন পরেই আমার বন্ধু খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক আমাকে নিয়ে যান তাঁর এলাকা ধনবাড়ীতে। সেখানে ধনবাড়ী নাট্য পদাতিকের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অতিথি। ধনবাড়ী নতুন উপজেলা এবং নতুন পৌরসভা হয়েছে। নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদেরও সংবর্ধনা হলো। কিন্তু সেসবের চেয়েও ধনবাড়ীতে আমার আকর্ষণ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর বাড়িটি পরিদর্শন। নবাব বাহাদুরের কাছে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত ঋণী, যদিও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। তাঁর সুরম্য বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা স্থাপত্য হিসেবে পরবর্তী বংশধরদের জন্য রক্ষা করা অপরিহার্য।
নানা উত্থান-পতন ও ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি হাজার বছরে আজ এখানে এসেছে। একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পর এই অঞ্চলের ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি নিয়ে নতুন করে ও গভীরভাবে অনুসন্ধানের কাজ করার দায়িত্ব বর্তেছে আমাদের ওপর। সেই দায়িত্ব একই সঙ্গে সরকারের ও জনগণের। সে দায়িত্ব পালন করতে হবে ব্যক্তির স্বার্থে নয়, সরকারের স্বার্থে নয়—জাতির স্বার্থে। অহংকার করার মতো আমাদের যা আছে তার পরিচয় তুলে ধরতে হবে দেশবাসীর কাছে ও বিশ্ববাসীর কাছে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments