কালের আয়নায়-সংবিধান সংশোধনকে কেন্দ্র করে মিথ্যা সাফাই ও ভীতি প্রচার by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
অবশ্য সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টে আঘাত দেওয়া হলো না, দেশে বিএনপি-জামায়াতের অরাজকতা সৃষ্টি ঠেকানো গেল এবং শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা গেল বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন তারা সকলেই আহাম্মক নন।
তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জ্ঞানপাপী অংশও রয়েছেন। তাদের এই ভীতি প্রচার উদ্দেশ্যহীন নয়
বাংলাদেশে অত্যন্ত সুকৌশলে একটা ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ভীতিটা যারা ছড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক, এমনকি প্রবীণ-নবীন নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন। ঢাকার টিভি টক শোতেও কারও কারও মুখে শোনা যাচ্ছে এই একই কথা। বাংলাদেশে '৭৫ সালের অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় যে কিছু হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও এই হুজুগে মন্তব্যে কণ্ঠ মেলানোর ফলে এটা আরও গুরুত্ব পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমানের এক প্রধান নেতা আমাকে টেলিফোনে বলেছেন, আপনি তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রাখার বিরুদ্ধে খুবই লেখালেখি করছেন। কিন্তু আপনি কি শেখ হাসিনার লাইফের ওপর থ্রেটটার কথা কিছুই বিবেচনা করছেন না? বঙ্গবন্ধুর আমলের সেক্যুলারপন্থি দেশ এখন আর নেই। সব দেশেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে ধর্মের প্রতি টান ও ভক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় সহসা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের বিধান ও বিসমিল্লাহ বাদ দিতে গেলে বিএনপি-জামায়াত দেশে অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ তো পেতই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের ওপর হামলার আশঙ্কা দশগুণ বেড়ে যেত। এমনিতেই তিনি এই আশঙ্কা থেকে এখনও মুক্ত নন।
এই আশঙ্কাটা অমূলক নয়। আমি প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনার জীবন সর্বপ্রকার হামলামুক্ত থাকুক। অতীতের মতো তার জীবনের ওপর সকল হামলা ব্যর্থ হোক। তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিন। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানের সেক্যুলার চরিত্রে ফিরে গেলে তার জীবনের ওপর হামলা অনিবার্য হয়ে উঠত, কিংবা বিএনপি-জামায়াত '৭৫-এর মতো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা দেখাত_ এ ব্যাপারে ভীতি প্রচার ও অতিপ্রচারণা, যায় পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, তার সত্যতাও আমাদের বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে দেখা উচিত।
আওয়ামী লীগে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি অংশ আগেও ছিল, এখনও আছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে এরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। বর্তমানে দেশে বামপন্থি রাজনীতির বিপর্যয়ের সুযোগে দেশের গোটা রাজনীতিতেই এরা প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কার্যত কব্জা করে ফেলেছে। সাম্প্রতিক অতীতেও এরা এ ধরনের ভীতি সৃষ্টি দ্বারা আওয়ামী লীগকে সুবিধাবাদিতা ও নীতিভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে গেছে এবং 'সাময়িক কৌশলের রাজনীতি', 'ফতোয়া চুক্তি' ইত্যাদির দিকে টেনে নিয়েছে। আওয়ামী রাজনীতির সেক্যুলার কালচারকে ত্যাগ করে বিএনপি রাজনীতির ধর্মীয় কালচারকে সর্বতোভাবে অনুকরণ করার অসম্ভবকেও সম্ভব করেছেন এরা। প্রশ্ন, এসব সত্ত্বেও আহসানউল্লাহ মাস্টার ও কিবরিয়া হত্যা, গ্রেনেড হামলাসহ শেখ হাসিনার জীবনের ওপর অন্তত ছয়টি প্রধান হামলা, বিডিআর বিদ্রোহ (প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক) ইত্যাদি কি ঠেকানো গিয়েছিল? এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে এবং বাংলাদেশের সেক্যুলার চরিত্র বিসর্জন দিয়েও কি শেখ হাসিনার জীবনের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে?
আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষ এবং দলটির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের এই খেলা আমি আওয়ামী লীগের সেই জন্মকাল থেকে দেখে আসছি। আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম থেকে যখন (১৯৫৫) মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলটি সেক্যুলার করার প্রস্তাব ওঠে, তখনও এই হায় হায় রব আমরা শুনেছি। বলা হয়েছে, দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা দলটিকে হিন্দুদের দল, ভারতের দালাল বলে ধরে নেবে। আওয়ামী লীগকে তারা একটি ভোটও দেবে না, তাদের সেন্টিমেন্টে গুরুতর আঘাত লাগবে। পরে প্রমাণিত হয়েছে, এই ভীতি ছিল অমূলক। ভীতি প্রচারকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভীতি ছড়িয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার দল হতে না দেওয়া।
পাকিস্তান আমলেই আওয়ামী লীগে যখন সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার বদলে সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তনের প্রস্তাব ওঠে, তখন আমরা আবার এই হায় হায় রব শুনেছি। বলা হয়েছে সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম ও মুসলমানের সর্বনাশ হবে। দেশটি হিন্দুদের দখলে এবং ভারতের কবলে চলে যাবে। আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বর্জন করবে। এই প্রচারণা শুধু তখনকার মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলো চালায়নি, আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি অংশও চালিয়েছে। পরে জনমত জরিপে দেখা গেছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচনের পক্ষে।
পাকিস্তান আমলের শেষদিকে যখন বঙ্গবন্ধু বাঙালির জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলা গ্রহণের প্রস্তাব করেন, তখন তো আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভাতেই প্রচণ্ড আপত্তি উঠেছিল। বর্তমানের মতো দোহাই পাড়া হয়েছিল মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের। বলা হয়েছিল, মুসলিম লীগাররা ইতিমধ্যেই রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে, 'জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ্।' এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ জয় বাংলা স্লোগান গ্রহণ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশ এই আপত্তি মানেননি। পরে দেখা গেছে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই আওয়ামী লীগ '৭০ সালে ভূমিধস নির্বাচন বিজয়ের অধিকারী হয়েছে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সফল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের 'সোনার বাংলা' গান জাতীয় সঙ্গীত করা, জাতীয় পতাকায় প্রভাতের লাল সূর্য রাখা নিয়েও আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকমনা ডান অংশ প্রবল আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, পতাকায় লাল সূর্য রাখা হচ্ছে হিন্দুদের সূর্য-বন্দনা। এসব বিতর্ক তুলে মুজিবনগরে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের ডানপন্থিদের প্রকাশ্য ও গোপন ষড়যন্ত্রের বিবরণ লিখতে গেলে একটি বই লিখতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও দলের প্রগতিশীল অংশের দৃঢ়তার কাছে এসব ষড়যন্ত্র টেকেনি। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। দলে প্রগতিশীল লেফট অংশও প্রায় অস্তিত্বহীন। তাই দেশের স্বাধীনতায় সেক্যুলার মূলমন্ত্র আজ আওয়ামী লীগের হাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের চার মূল স্তম্ভের একটি বলে লিপিবদ্ধ করেন, তখন তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা ও সরব আপত্তি শোনা যায়নি। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও এ কথা শোনা যায়নি যে, তিনি দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছে, দেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন, গণতন্ত্র বিসর্জন ও রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনের (যার কোনোটাই সঠিক নয়) জন্য তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত ও হত্যা করা হয়েছে। আর এখন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে গেলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগবে এবং শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন হবে এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণটা কী?
এ কথা সত্য, সমাজতন্ত্রী বিশ্বের বিপর্যয়ের পর আদর্শবাদের ক্ষেত্রে যে ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে মানুষের মনে আবার একটা আশ্রয় হিসেবে ধর্মের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। বাংলাদেশেও তা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মানুষ মধ্যযুগীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার দিকে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দফার নির্বাচনে জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর ভোটের হারের ও সংখ্যার দিকে তাকালেও দেখা যাবে, তারা জনসমর্থন লাভের দিকে মোটেই এগোতে পারছে না এবং বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারে সচেতন। তারা ধর্মগুরু হিসেবে কোনো সাম্প্রদায়িক নেতাকে মানতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক গুরু হিসেবে নয়। বরং এই ধর্মগুরু কোনো দেশদ্রোহী কাজ ও যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তার বিচারের দাবিতে তারা একাট্টা। তা না হলে নিজামী-সাঈদীকে জেলে ঢোকানো হাসিনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না।
এখন বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ তাতে সামরিক শাসকদের দুষ্টবুদ্ধিপ্রসূত রাষ্ট্রধর্ম বা বিসমিল্লাহ সংযোজন বাদ দিলে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগত, তারা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত_ এমন কথা বিশ্বাস করা আর এই বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে অসচেতন ও নির্বোধ ভাবা একই কথা। বিএনপি-জামায়াত তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে বলেও প্রচার করেছে। তাতে কোনো কাজ হয়েছে কি? বর্তমানেও সরকারের নারী অধিকার নীতির প্রশ্নে ইসলাম গেল, শরিয়া গেল হুজুগ তুলে মুফতি আমিনীকে দিয়ে হরতাল ও আন্দোলন করানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই হরতাল, আন্দোলন কতটা সফল হয়েছে?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংবিধানকে তার সেক্যুলার চরিত্রে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনলে অবশ্যই বিএনপি-জামায়াত ইসলাম গেল, ইসলাম গেল রব তুলে হরতাল ডাকত। তা কতটা সফল হতো? বর্তমানের শিথিল ও ঢিলেঢালা হরতালের চেহারাই তাতে দেখা যেত। তাতে মাদ্রাসার কিছু বাড়তি ছাত্র যোগ দিত, তার বেশি কিছু নয়। ধর্মীয় বিধান সংবিধানে রেখেও সরকার কি বিএনপি-জামায়াতকে হরতাল ডাকা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারল? বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে বহাল থাকা সত্ত্বেও তারা কি হরতাল ডাকা থেকে বিরত থেকেছেন? প্রধান ইস্যু হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করাকে।
আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে, রাষ্ট্রধর্মের মতো মেজর ইস্যুতে আপস করে সরকার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মতো মাইনর ইস্যুতে বিরোধী দলের সঙ্গে কনফ্রনটেশনে নামলেন? সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও কিছুকাল থাকা বা না থাকার ওপর দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না। নির্ভর করে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখা না রাখার ওপর। এই বিধান স্বাধীনতার মূল আদর্শ ক্ষুণ্ন করে এবং দেশ ও জাতির পরিচয় বদলে দেয়। সর্বোপরি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং তার জন্য ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দেয়। এত বড় একটা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নীতিভ্রষ্ট হতে, আপস করতে দ্বিধা হলো না; কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটা তুচ্ছ ইস্যু, যে ইস্যুতে আপস করলে কোনো ক্ষতি হতো না, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ অনাবশ্যক কেন কনফ্রনটেশনে নেমেছে, এর মাজেজাটা কী তা আমি অনেক মাথা খাটিয়েও বের করতে পারিনি।
দেশে মৌলবাদীদের অভ্যুত্থান কিংবা শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে আপস করেছে, দলটির প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের এই প্রচারণা আমি কিছুমাত্র বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতসহ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক, অধিকাংশ দলের কাছে ধর্ম তাদের রাজনৈতিক ব্যবসা; কোনো আদর্শ নয়, ধর্মের নামে তারা খুন-খারাবিতে নামে। উদ্দেশ্য থাকে ক্ষমতা দখল ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থতা। আওয়ামী লীগের বংশ নিপাতের ইচ্ছার পেছনে তাদের এই দুটি কারণ এখনও রয়ে গেছে। সুতরাং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে কি শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে?
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ওপর বিএনপি ও জামায়াতের রাগের প্রধান কারণ, এই দল ও নেত্রীর জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সব ফসল তারা এখনও ধ্বংস করতে পারেননি বলে মনে করেন। তাই এই দল ও নেত্রীর উচ্ছেদ তাদের একান্ত কাম্য। খালেদা জিয়া দেশে যে পারিবারিক শাসন স্থায়ী করতে চান, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে প্রধান কণ্টক। সুতরাং শেখ হাসিনার সঙ্গে সহাবস্থান তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর শেখ হাসিনা তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িছাড়া করেছেন। তার সন্তানদের দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন (যদিও তা আদালত করেছেন), তার স্বামীর নামের বিমানবন্দরের নাম বদল করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা হলের নামও বদলে যাচ্ছে_ এসব ব্যক্তিগত কারণও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি ঢেলেছে। সুতরাং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে এসব কারণের কোনোটি দূর করা গেছে কিংবা দেশে অরাজকতা ও হত্যা চক্রান্তের রাজনীতি ঠেকানো গেছে বলে যারা সত্যি সত্যি ভাবেন, তারা আহাম্মকের বেহেশতে বাস করছেন।
অবশ্য সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টে আঘাত দেওয়া হলো না, দেশে বিএনপি-জামায়াতের অরাজকতা সৃষ্টি ঠেকানো গেল এবং শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা গেল বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন তারা সকলেই আহাম্মক নন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জ্ঞানপাপী অংশও রয়েছেন। তাদের এই ভীতি প্রচার উদ্দেশ্যহীন নয়। উদ্দেশ্য, অতীতের ডানপন্থিদের মতো আওয়ামী লীগের সেক্যুলার চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা ও প্রগতিশীল নীতি অনুসরণের চেষ্টা ব্যর্থ করা। বাহাত্তরের সংবিধানকে মৌলিক চরিত্রে ফিরতে না দিয়ে তারা এই ষড়যন্ত্রে আপাতত সফল হলেন।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ সর্বতোভাবে সফল হচ্ছে না, জন-অসন্তোষ বাড়ছে একথা ঠিক। কিন্তু দেশে পঁচাত্তরের আলামত দেখা দিয়েছে, তাদের এটাও অতিপ্রচার ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারও হতে পারে। এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে বিশদ আলোচনার আশা রাখি।
লন্ডন, ৮ জুলাই, শুক্রবার, ২০১১
বাংলাদেশে অত্যন্ত সুকৌশলে একটা ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ভীতিটা যারা ছড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক, এমনকি প্রবীণ-নবীন নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন। ঢাকার টিভি টক শোতেও কারও কারও মুখে শোনা যাচ্ছে এই একই কথা। বাংলাদেশে '৭৫ সালের অবস্থা বিরাজ করছে। যে কোনো সময় যে কিছু হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও এই হুজুগে মন্তব্যে কণ্ঠ মেলানোর ফলে এটা আরও গুরুত্ব পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমানের এক প্রধান নেতা আমাকে টেলিফোনে বলেছেন, আপনি তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রাখার বিরুদ্ধে খুবই লেখালেখি করছেন। কিন্তু আপনি কি শেখ হাসিনার লাইফের ওপর থ্রেটটার কথা কিছুই বিবেচনা করছেন না? বঙ্গবন্ধুর আমলের সেক্যুলারপন্থি দেশ এখন আর নেই। সব দেশেই, বিশেষ করে বাংলাদেশে ধর্মের প্রতি টান ও ভক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় সহসা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্মের বিধান ও বিসমিল্লাহ বাদ দিতে গেলে বিএনপি-জামায়াত দেশে অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ তো পেতই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের ওপর হামলার আশঙ্কা দশগুণ বেড়ে যেত। এমনিতেই তিনি এই আশঙ্কা থেকে এখনও মুক্ত নন।
এই আশঙ্কাটা অমূলক নয়। আমি প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনার জীবন সর্বপ্রকার হামলামুক্ত থাকুক। অতীতের মতো তার জীবনের ওপর সকল হামলা ব্যর্থ হোক। তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিন। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানের সেক্যুলার চরিত্রে ফিরে গেলে তার জীবনের ওপর হামলা অনিবার্য হয়ে উঠত, কিংবা বিএনপি-জামায়াত '৭৫-এর মতো ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা দেখাত_ এ ব্যাপারে ভীতি প্রচার ও অতিপ্রচারণা, যায় পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, তার সত্যতাও আমাদের বাস্তবতার নিরিখে বিচার করে দেখা উচিত।
আওয়ামী লীগে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি অংশ আগেও ছিল, এখনও আছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে এরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল। বর্তমানে দেশে বামপন্থি রাজনীতির বিপর্যয়ের সুযোগে দেশের গোটা রাজনীতিতেই এরা প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কার্যত কব্জা করে ফেলেছে। সাম্প্রতিক অতীতেও এরা এ ধরনের ভীতি সৃষ্টি দ্বারা আওয়ামী লীগকে সুবিধাবাদিতা ও নীতিভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে গেছে এবং 'সাময়িক কৌশলের রাজনীতি', 'ফতোয়া চুক্তি' ইত্যাদির দিকে টেনে নিয়েছে। আওয়ামী রাজনীতির সেক্যুলার কালচারকে ত্যাগ করে বিএনপি রাজনীতির ধর্মীয় কালচারকে সর্বতোভাবে অনুকরণ করার অসম্ভবকেও সম্ভব করেছেন এরা। প্রশ্ন, এসব সত্ত্বেও আহসানউল্লাহ মাস্টার ও কিবরিয়া হত্যা, গ্রেনেড হামলাসহ শেখ হাসিনার জীবনের ওপর অন্তত ছয়টি প্রধান হামলা, বিডিআর বিদ্রোহ (প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক) ইত্যাদি কি ঠেকানো গিয়েছিল? এখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে এবং বাংলাদেশের সেক্যুলার চরিত্র বিসর্জন দিয়েও কি শেখ হাসিনার জীবনের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে?
আওয়ামী লীগের শত্রুপক্ষ এবং দলটির ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের এই খেলা আমি আওয়ামী লীগের সেই জন্মকাল থেকে দেখে আসছি। আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম থেকে যখন (১৯৫৫) মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলটি সেক্যুলার করার প্রস্তাব ওঠে, তখনও এই হায় হায় রব আমরা শুনেছি। বলা হয়েছে, দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা দলটিকে হিন্দুদের দল, ভারতের দালাল বলে ধরে নেবে। আওয়ামী লীগকে তারা একটি ভোটও দেবে না, তাদের সেন্টিমেন্টে গুরুতর আঘাত লাগবে। পরে প্রমাণিত হয়েছে, এই ভীতি ছিল অমূলক। ভীতি প্রচারকারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভীতি ছড়িয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার দল হতে না দেওয়া।
পাকিস্তান আমলেই আওয়ামী লীগে যখন সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার বদলে সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তনের প্রস্তাব ওঠে, তখন আমরা আবার এই হায় হায় রব শুনেছি। বলা হয়েছে সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম ও মুসলমানের সর্বনাশ হবে। দেশটি হিন্দুদের দখলে এবং ভারতের কবলে চলে যাবে। আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বর্জন করবে। এই প্রচারণা শুধু তখনকার মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলো চালায়নি, আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি অংশও চালিয়েছে। পরে জনমত জরিপে দেখা গেছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সেক্যুলারযুক্ত নির্বাচনের পক্ষে।
পাকিস্তান আমলের শেষদিকে যখন বঙ্গবন্ধু বাঙালির জাতীয় স্লোগান হিসেবে জয় বাংলা গ্রহণের প্রস্তাব করেন, তখন তো আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভাতেই প্রচণ্ড আপত্তি উঠেছিল। বর্তমানের মতো দোহাই পাড়া হয়েছিল মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের। বলা হয়েছিল, মুসলিম লীগাররা ইতিমধ্যেই রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে, 'জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ্।' এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ জয় বাংলা স্লোগান গ্রহণ করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলের তরুণ ও প্রগতিশীল অংশ এই আপত্তি মানেননি। পরে দেখা গেছে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই আওয়ামী লীগ '৭০ সালে ভূমিধস নির্বাচন বিজয়ের অধিকারী হয়েছে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সফল হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের 'সোনার বাংলা' গান জাতীয় সঙ্গীত করা, জাতীয় পতাকায় প্রভাতের লাল সূর্য রাখা নিয়েও আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িকমনা ডান অংশ প্রবল আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, পতাকায় লাল সূর্য রাখা হচ্ছে হিন্দুদের সূর্য-বন্দনা। এসব বিতর্ক তুলে মুজিবনগরে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকায় আওয়ামী লীগের ডানপন্থিদের প্রকাশ্য ও গোপন ষড়যন্ত্রের বিবরণ লিখতে গেলে একটি বই লিখতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও দলের প্রগতিশীল অংশের দৃঢ়তার কাছে এসব ষড়যন্ত্র টেকেনি। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। দলে প্রগতিশীল লেফট অংশও প্রায় অস্তিত্বহীন। তাই দেশের স্বাধীনতায় সেক্যুলার মূলমন্ত্র আজ আওয়ামী লীগের হাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যখন বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের চার মূল স্তম্ভের একটি বলে লিপিবদ্ধ করেন, তখন তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা ও সরব আপত্তি শোনা যায়নি। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও এ কথা শোনা যায়নি যে, তিনি দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছে, দেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন, গণতন্ত্র বিসর্জন ও রক্ষী বাহিনীর নির্যাতনের (যার কোনোটাই সঠিক নয়) জন্য তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত ও হত্যা করা হয়েছে। আর এখন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে গেলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগবে এবং শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন হবে এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণটা কী?
এ কথা সত্য, সমাজতন্ত্রী বিশ্বের বিপর্যয়ের পর আদর্শবাদের ক্ষেত্রে যে ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে মানুষের মনে আবার একটা আশ্রয় হিসেবে ধর্মের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। বাংলাদেশেও তা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মানুষ মধ্যযুগীয় ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার দিকে ফিরে গেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দফার নির্বাচনে জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর ভোটের হারের ও সংখ্যার দিকে তাকালেও দেখা যাবে, তারা জনসমর্থন লাভের দিকে মোটেই এগোতে পারছে না এবং বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারে সচেতন। তারা ধর্মগুরু হিসেবে কোনো সাম্প্রদায়িক নেতাকে মানতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক গুরু হিসেবে নয়। বরং এই ধর্মগুরু কোনো দেশদ্রোহী কাজ ও যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তার বিচারের দাবিতে তারা একাট্টা। তা না হলে নিজামী-সাঈদীকে জেলে ঢোকানো হাসিনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না।
এখন বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক চরিত্র ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ তাতে সামরিক শাসকদের দুষ্টবুদ্ধিপ্রসূত রাষ্ট্রধর্ম বা বিসমিল্লাহ সংযোজন বাদ দিলে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগত, তারা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ত_ এমন কথা বিশ্বাস করা আর এই বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে অসচেতন ও নির্বোধ ভাবা একই কথা। বিএনপি-জামায়াত তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে বলেও প্রচার করেছে। তাতে কোনো কাজ হয়েছে কি? বর্তমানেও সরকারের নারী অধিকার নীতির প্রশ্নে ইসলাম গেল, শরিয়া গেল হুজুগ তুলে মুফতি আমিনীকে দিয়ে হরতাল ও আন্দোলন করানোর চেষ্টা হয়েছে। সেই হরতাল, আন্দোলন কতটা সফল হয়েছে?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংবিধানকে তার সেক্যুলার চরিত্রে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনলে অবশ্যই বিএনপি-জামায়াত ইসলাম গেল, ইসলাম গেল রব তুলে হরতাল ডাকত। তা কতটা সফল হতো? বর্তমানের শিথিল ও ঢিলেঢালা হরতালের চেহারাই তাতে দেখা যেত। তাতে মাদ্রাসার কিছু বাড়তি ছাত্র যোগ দিত, তার বেশি কিছু নয়। ধর্মীয় বিধান সংবিধানে রেখেও সরকার কি বিএনপি-জামায়াতকে হরতাল ডাকা থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারল? বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে বহাল থাকা সত্ত্বেও তারা কি হরতাল ডাকা থেকে বিরত থেকেছেন? প্রধান ইস্যু হিসেবে তারা বেছে নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করাকে।
আমার কাছে বিস্ময়কর লাগে, রাষ্ট্রধর্মের মতো মেজর ইস্যুতে আপস করে সরকার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মতো মাইনর ইস্যুতে বিরোধী দলের সঙ্গে কনফ্রনটেশনে নামলেন? সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও কিছুকাল থাকা বা না থাকার ওপর দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না। নির্ভর করে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখা না রাখার ওপর। এই বিধান স্বাধীনতার মূল আদর্শ ক্ষুণ্ন করে এবং দেশ ও জাতির পরিচয় বদলে দেয়। সর্বোপরি '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং তার জন্য ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দেয়। এত বড় একটা ইস্যুতে আওয়ামী লীগের নীতিভ্রষ্ট হতে, আপস করতে দ্বিধা হলো না; কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো একটা তুচ্ছ ইস্যু, যে ইস্যুতে আপস করলে কোনো ক্ষতি হতো না, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ অনাবশ্যক কেন কনফ্রনটেশনে নেমেছে, এর মাজেজাটা কী তা আমি অনেক মাথা খাটিয়েও বের করতে পারিনি।
দেশে মৌলবাদীদের অভ্যুত্থান কিংবা শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে আপস করেছে, দলটির প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থিদের এই প্রচারণা আমি কিছুমাত্র বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতসহ মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক, অধিকাংশ দলের কাছে ধর্ম তাদের রাজনৈতিক ব্যবসা; কোনো আদর্শ নয়, ধর্মের নামে তারা খুন-খারাবিতে নামে। উদ্দেশ্য থাকে ক্ষমতা দখল ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থতা। আওয়ামী লীগের বংশ নিপাতের ইচ্ছার পেছনে তাদের এই দুটি কারণ এখনও রয়ে গেছে। সুতরাং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে কি শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে?
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ওপর বিএনপি ও জামায়াতের রাগের প্রধান কারণ, এই দল ও নেত্রীর জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সব ফসল তারা এখনও ধ্বংস করতে পারেননি বলে মনে করেন। তাই এই দল ও নেত্রীর উচ্ছেদ তাদের একান্ত কাম্য। খালেদা জিয়া দেশে যে পারিবারিক শাসন স্থায়ী করতে চান, বঙ্গবন্ধুর পরিবার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে প্রধান কণ্টক। সুতরাং শেখ হাসিনার সঙ্গে সহাবস্থান তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওপর শেখ হাসিনা তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িছাড়া করেছেন। তার সন্তানদের দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন (যদিও তা আদালত করেছেন), তার স্বামীর নামের বিমানবন্দরের নাম বদল করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা হলের নামও বদলে যাচ্ছে_ এসব ব্যক্তিগত কারণও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি ঢেলেছে। সুতরাং সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখে এসব কারণের কোনোটি দূর করা গেছে কিংবা দেশে অরাজকতা ও হত্যা চক্রান্তের রাজনীতি ঠেকানো গেছে বলে যারা সত্যি সত্যি ভাবেন, তারা আহাম্মকের বেহেশতে বাস করছেন।
অবশ্য সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বহাল রেখে যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সেন্টিমেন্টে আঘাত দেওয়া হলো না, দেশে বিএনপি-জামায়াতের অরাজকতা সৃষ্টি ঠেকানো গেল এবং শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা গেল বলে যুক্তি দেখাচ্ছেন তারা সকলেই আহাম্মক নন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জ্ঞানপাপী অংশও রয়েছেন। তাদের এই ভীতি প্রচার উদ্দেশ্যহীন নয়। উদ্দেশ্য, অতীতের ডানপন্থিদের মতো আওয়ামী লীগের সেক্যুলার চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা ও প্রগতিশীল নীতি অনুসরণের চেষ্টা ব্যর্থ করা। বাহাত্তরের সংবিধানকে মৌলিক চরিত্রে ফিরতে না দিয়ে তারা এই ষড়যন্ত্রে আপাতত সফল হলেন।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ সর্বতোভাবে সফল হচ্ছে না, জন-অসন্তোষ বাড়ছে একথা ঠিক। কিন্তু দেশে পঁচাত্তরের আলামত দেখা দিয়েছে, তাদের এটাও অতিপ্রচার ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারও হতে পারে। এ ব্যাপারে ভবিষ্যতে বিশদ আলোচনার আশা রাখি।
লন্ডন, ৮ জুলাই, শুক্রবার, ২০১১
No comments