রাজনীতি-পাবলিক লাইফের দীর্ঘজীবিতা! by শাহ্দীন মালিক
পাঠক শিরোনাম পড়ে শিউরে বা আতঙ্কে উঠলে অবাক হব না। বাংলা, ইংরেজির গোঁজামিল ‘জীবিতা’ স্পষ্টত বায়বীয় আসমান থেকে শুল্কবিহীন আমদানি। শিরোনামের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি অবশ্য একটা আছে—দিনকাল যা হয়েছে, তাতে সবকিছুই জায়েজ, সবকিছুই চলে। যেভাবে চলছে তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের বদৌলতে।
আওয়ামী লীগের ‘ভালো’ কাজের কারণেই যদি বিলাতফেরত তারেক রহমান এ দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়ে যান, তাহলে এই লেখার শিরোনামের মতো খটকা লাগতে পারে, তবে এটা তো এখন ‘সব চলে’, সবকিছু ‘জায়েজ’-এর দেশ।
২.
হিরো থেকে জিরো কীভাবে হয়? অতি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় বা ক্ষমতার খুব কাছে অর্থাৎ ক্ষমতা-সংক্রান্ত পাবলিক লাইফে থাকলে একদিন জিরো হতে বাধ্য। আমাদেরও হচ্ছে তাই। কিন্তু যাঁরা জিরো হচ্ছেন, তা তাঁরা মানতে রাজি নন। গদিতে থাকছেন, থাকতে চাইছেন আর আমরা সবাই দল বেঁধে গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি, তাই তাঁরা গদিতে থেকেও যাচ্ছেন প্রায় অনন্তকাল ধরে।
হঠাৎ হঠাৎ করে ঘটনাচক্রে আমাদের টনক নড়ে, আমরা টের পাই আমাদের হিরোরা কতটা বদ, কতটা নোংরা। অন্য যেকোনো সভ্য দেশে ওরা নিমিষে আসলেই হিরো থেকে জিরো হয়ে যেত। আর আমাদের দেশে হয়ে হয়েও জিরো হয় না। হয়তো আবার হিরো হবে, এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা জিরো হলে আস্তে আস্তে বিএনপির লোকেরা হিরো হবে।
আর আমাদের অবস্থা মিরপুরের হযরত আলী। সত্যিকার হিরো গুলি খেয়ে মারা গেল, আর আমরা মারা যাচ্ছি প্রতিদিন তিলে তিলে।
এই দুঃসময়ে একজন হলেও হিরো পেয়েছিলাম। কিন্তু হযরত আলীকে ইতিমধ্যেই আমরা ভুলতে বসেছি। আর তাই বোধ হয় যারা মধ্যরাতে ব্যাগভর্তি টাকা আনা-নেওয়া-পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদিতে ব্যস্ত হয়, তারাই এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পূজনীয় ব্যক্তি।
বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে যেমন ইচ্ছে করলেই বদলানো যায় না, দেশ বা মাতৃভূমি তেমনি। বদলানো যায় না। নাগরিকত্ব পাল্টানো যায়। সেটা আইনগত ব্যাপার। হূদয়ের গভীরে যে বাংলাদেশ, সেটা তো মুছে ফেলা যাবে না। তবে নেতাদের পাল্টানো যায়। এখন সেটাই করতে হবে।
প্রথম পদক্ষেপ হবে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পুরোনো দলের লোকজনকে—যদি সম্ভব হয় এবং যৌক্তিক হয়—ভোট না দেওয়া।
‘দীর্ঘজীবিতা’র কথায় আসি। ঘুরতে যাই মধ্যপ্রাচ্যে। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, হোসনি মোবারক—হিরো থেকে জিরো। সিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান আসাদের দীর্ঘজীবিতা অতটা ভয়ংকর না হলেও তাঁর পেছনে আছেন তাঁর প্রয়াত পিতা। বাপে-পুতে মিলে কয় দশক হলো কে জানে, হিসাব রাখা দায়! এঁরা ৩০-৪০ বছর আগে যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন সবাই ছিলেন হিরো। অর্থাৎ টগবগে তরুণ, দেশ সেবায় বদ্ধপরিকর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চেষ্টা-চরিত্রও করলেন সর্বাত্মকভাবে।
তবে বয়স গড়াল, গড়াল দশক, পেরিয়ে গেল যুগ একের পর এক। ২০, ৩০, ৪০ বছর পেরিয়ে গেল। কখন কে কীভাবে একেকটা গজ্জাল, এমনকি জল্লাদ হয়ে উঠল, কেউ বোধ হয় খেয়াল করেনি। গত কয়েক মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সরকার ও তাঁর বাহিনী প্রায় হাজার দশেক প্রতিবাদী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রায় একই চিত্র দেখিয়েছেন কয়েক মাস আগে গাদ্দাফি। অবশ্য হোসনি মোবারক সরে দাঁড়িয়েছিলেন বেশি মানুষ নিহত হওয়ার আগেই। সবারই এখন বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। ক্রোক হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। পাবলিক লাইফে দীর্ঘজীবিতার পরিণতি। আমাদের এতদঞ্চলে সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম মহাত্মা গান্ধী। যুগ যুগ ধরে নেতা ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের অপবাদ রটেনি। অবশ্য ‘মসনদে’ও কখনো সরাসরি বসেননি।
যত দিন যাচ্ছে দীর্ঘজীবিতার কারণে পরিস্থিতি হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতর। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যাংক পাচ্ছেন—দীর্ঘজীবিতার বদৌলতে, তবে তাঁর সঙ্গে তিন বছরের সাংসদও পেয়েছেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট আসাদের মতো বাপে-পুতে মেলালে হবে তিন বছরের অনেক বেশি।
প্রথমে বছর তিরিশেক বড় আমলা, এরপর হাফ মন্ত্রী, তারপর সাংসদ। এবং এখন বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যাংক সবই।
৩.
এখন সবাই এসডিপির রাজনীতিতে ভীষণ ব্যস্ত। রাজনীতি মানেই এখন এসডিপি। আগে ভাবতাম রাজনীতি করেন অথচ এসডিপি করেন না, এমন নেতার সংখ্যাই বেশি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখছি সে সংখ্যা কমছে।
এখন ব্যাংক-বিশ্ববিদ্যালয়ও কেউ ছাড়তে চায় না। চাকরি যেন বাপের সম্পত্তি। বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়েছে কয়েক লাখ টাকা।
চতুর্দিকে এসডিপি—সেলফ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। রাজনীতি এখন শুধু এবং কেবলই এসডিপি। ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি করার লাইসেন্স। আইনের ঊর্ধ্বে থাকার গ্যারান্টি। দুর্নীতি-লুটপাট সবই করা যাবে, আইন ঠুঁটো জগন্নাথ।
একসময় আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম যে দেশ চালানোর জন্য অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞ নেতা দরকার। অনভিজ্ঞ লোকেরা দেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে।
এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সে ধারণাটা ছিল ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের দীর্ঘজীবিতার ভয়াবহ প্রভাব আমাদের দীর্ঘজীবী নেতাদের ওপর পড়েছে। গাদ্দাফিরা যেমন ভাবতেন বাপ-ব্যাটা-কন্যা-স্ত্রী সবাই মিলে, তেমনি আমাদের দীর্ঘজীবী নেতারা এখন স্পষ্টত একইভাবে ভাবছেন। ক্ষমতায় যখন আছি, তখন টাকা বানাব। যাদের ক্ষমতা নেই বা যারা এখন ক্ষমতায় নেই, তারা টাকা বানাবে না। অথবা আইন-আদালতের কথা একটু-আধটু হলেও মনে রাখবে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় আছে, তারা কিছুই ছাড়বে না। কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না।
আমাদের প্রধান তিন দলের তিন নেতা তিন দশকের কারণে দীর্ঘজীবিতার দোষে এখন দুষ্ট। এত দিন পাবলিক লাইফে থাকলে ক্ষমতার দণ্ড এবং সারা দেশ আমাকে দেবতা-ফেরেশতা ভাবে—এমন হওয়া অবশ্যম্ভাবী। হয়েছেও তাই।
দীর্ঘজীবিতায় দূষিত নয় অর্থাৎ পাবলিক লাইফে আছেন তুলনামূলকভাবে অল্প দিন অথচ ভালো দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ এবং সৎ এমন লোক দেশে অগণিত। কিন্তু তিন দশকের পুরোনো নেতারা এমন লোক খুঁজে পাবেন না। অথবা তাঁদের চোখে পড়বে না ভালো লোক। চোখে পড়বে শুধু তাঁদের কাছের তোষামোদকারী ও মোসাহেবদেরই।
মোদ্দা কথা, আমাদের রাজনীতি এখন দীর্ঘজীবিতার দোষে ভীষণভাবে দুষ্ট। হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরও যদি না সরে দাঁড়ান, তাহলে ধরেই নেব এ দেশের আদর্শ ব্যক্তি বিচারপতি এম এ আজিজ। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘজীবীদের ধারক দল দেশকে লিবিয়া/মিসর/ইয়েমেন/সিরিয়া বানিয়ে ফেলবে। আর আমরা কি পারব না ঢাকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে আমলে না নিতে? দলীয় প্রার্থী তো দলের মতো হবে—এসডিপিই তাদের রাজনীতি। যদি ভাগ্যক্রমে এমন কাউকে পাওয়া যায় যে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-প্রার্থী অথচ এসডিপি করবেন না, তাহলে অন্য কথা। তবে সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, প্রার্থিতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তো নেবেন তিন দশকের দীর্ঘজীবী নেতা। অর্থাৎ কোন ধরনের দলীয় নেতাকে মনোনয়ন দেবে, তা যেকোনো কচি খুকিও বলে দিতে পারবে—যে যত বেশি বড় বড় ব্যাগভর্তি ক্যাশ টাকা দিতে পারবে, তার চান্স তত বেশি।
এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এটা হযরত আলীর দেশ। যারা টাকা দিয়ে চাকরি নেয় না তাদের দেশ। সেই দেশটাই বাংলাদেশ। ব্যাংক পাওয়া, টাকা খেয়ে চাকরি বা টেন্ডার দেওয়া, সাগর-রুনির হত্যা তদন্ত হতে না দেওয়া, অর্থাৎ সবকিছুকে অসততায় ছেয়ে দেওয়া লোকেদের দেশ এটা নয়।
আমাদের দেশটাকে আমাদেরই ফেরত নিতে হবে। হাজার হাজার হযরত আলী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন ইটকে বন্দুক দিয়ে ঠেকানো যাবে না।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
২.
হিরো থেকে জিরো কীভাবে হয়? অতি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় বা ক্ষমতার খুব কাছে অর্থাৎ ক্ষমতা-সংক্রান্ত পাবলিক লাইফে থাকলে একদিন জিরো হতে বাধ্য। আমাদেরও হচ্ছে তাই। কিন্তু যাঁরা জিরো হচ্ছেন, তা তাঁরা মানতে রাজি নন। গদিতে থাকছেন, থাকতে চাইছেন আর আমরা সবাই দল বেঁধে গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি, তাই তাঁরা গদিতে থেকেও যাচ্ছেন প্রায় অনন্তকাল ধরে।
হঠাৎ হঠাৎ করে ঘটনাচক্রে আমাদের টনক নড়ে, আমরা টের পাই আমাদের হিরোরা কতটা বদ, কতটা নোংরা। অন্য যেকোনো সভ্য দেশে ওরা নিমিষে আসলেই হিরো থেকে জিরো হয়ে যেত। আর আমাদের দেশে হয়ে হয়েও জিরো হয় না। হয়তো আবার হিরো হবে, এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা জিরো হলে আস্তে আস্তে বিএনপির লোকেরা হিরো হবে।
আর আমাদের অবস্থা মিরপুরের হযরত আলী। সত্যিকার হিরো গুলি খেয়ে মারা গেল, আর আমরা মারা যাচ্ছি প্রতিদিন তিলে তিলে।
এই দুঃসময়ে একজন হলেও হিরো পেয়েছিলাম। কিন্তু হযরত আলীকে ইতিমধ্যেই আমরা ভুলতে বসেছি। আর তাই বোধ হয় যারা মধ্যরাতে ব্যাগভর্তি টাকা আনা-নেওয়া-পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদিতে ব্যস্ত হয়, তারাই এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি পূজনীয় ব্যক্তি।
বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে যেমন ইচ্ছে করলেই বদলানো যায় না, দেশ বা মাতৃভূমি তেমনি। বদলানো যায় না। নাগরিকত্ব পাল্টানো যায়। সেটা আইনগত ব্যাপার। হূদয়ের গভীরে যে বাংলাদেশ, সেটা তো মুছে ফেলা যাবে না। তবে নেতাদের পাল্টানো যায়। এখন সেটাই করতে হবে।
প্রথম পদক্ষেপ হবে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পুরোনো দলের লোকজনকে—যদি সম্ভব হয় এবং যৌক্তিক হয়—ভোট না দেওয়া।
‘দীর্ঘজীবিতা’র কথায় আসি। ঘুরতে যাই মধ্যপ্রাচ্যে। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, হোসনি মোবারক—হিরো থেকে জিরো। সিরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান আসাদের দীর্ঘজীবিতা অতটা ভয়ংকর না হলেও তাঁর পেছনে আছেন তাঁর প্রয়াত পিতা। বাপে-পুতে মিলে কয় দশক হলো কে জানে, হিসাব রাখা দায়! এঁরা ৩০-৪০ বছর আগে যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন সবাই ছিলেন হিরো। অর্থাৎ টগবগে তরুণ, দেশ সেবায় বদ্ধপরিকর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চেষ্টা-চরিত্রও করলেন সর্বাত্মকভাবে।
তবে বয়স গড়াল, গড়াল দশক, পেরিয়ে গেল যুগ একের পর এক। ২০, ৩০, ৪০ বছর পেরিয়ে গেল। কখন কে কীভাবে একেকটা গজ্জাল, এমনকি জল্লাদ হয়ে উঠল, কেউ বোধ হয় খেয়াল করেনি। গত কয়েক মাসে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সরকার ও তাঁর বাহিনী প্রায় হাজার দশেক প্রতিবাদী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রায় একই চিত্র দেখিয়েছেন কয়েক মাস আগে গাদ্দাফি। অবশ্য হোসনি মোবারক সরে দাঁড়িয়েছিলেন বেশি মানুষ নিহত হওয়ার আগেই। সবারই এখন বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। ক্রোক হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। পাবলিক লাইফে দীর্ঘজীবিতার পরিণতি। আমাদের এতদঞ্চলে সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম মহাত্মা গান্ধী। যুগ যুগ ধরে নেতা ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের অপবাদ রটেনি। অবশ্য ‘মসনদে’ও কখনো সরাসরি বসেননি।
যত দিন যাচ্ছে দীর্ঘজীবিতার কারণে পরিস্থিতি হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতর। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ব্যাংক পাচ্ছেন—দীর্ঘজীবিতার বদৌলতে, তবে তাঁর সঙ্গে তিন বছরের সাংসদও পেয়েছেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট আসাদের মতো বাপে-পুতে মেলালে হবে তিন বছরের অনেক বেশি।
প্রথমে বছর তিরিশেক বড় আমলা, এরপর হাফ মন্ত্রী, তারপর সাংসদ। এবং এখন বিশ্ববিদ্যালয়-ব্যাংক সবই।
৩.
এখন সবাই এসডিপির রাজনীতিতে ভীষণ ব্যস্ত। রাজনীতি মানেই এখন এসডিপি। আগে ভাবতাম রাজনীতি করেন অথচ এসডিপি করেন না, এমন নেতার সংখ্যাই বেশি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখছি সে সংখ্যা কমছে।
এখন ব্যাংক-বিশ্ববিদ্যালয়ও কেউ ছাড়তে চায় না। চাকরি যেন বাপের সম্পত্তি। বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হয়েছে কয়েক লাখ টাকা।
চতুর্দিকে এসডিপি—সেলফ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। রাজনীতি এখন শুধু এবং কেবলই এসডিপি। ক্ষমতা মানেই দুর্নীতি করার লাইসেন্স। আইনের ঊর্ধ্বে থাকার গ্যারান্টি। দুর্নীতি-লুটপাট সবই করা যাবে, আইন ঠুঁটো জগন্নাথ।
একসময় আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম যে দেশ চালানোর জন্য অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞ নেতা দরকার। অনভিজ্ঞ লোকেরা দেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে।
এখন মনে হচ্ছে, আমাদের সে ধারণাটা ছিল ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের দীর্ঘজীবিতার ভয়াবহ প্রভাব আমাদের দীর্ঘজীবী নেতাদের ওপর পড়েছে। গাদ্দাফিরা যেমন ভাবতেন বাপ-ব্যাটা-কন্যা-স্ত্রী সবাই মিলে, তেমনি আমাদের দীর্ঘজীবী নেতারা এখন স্পষ্টত একইভাবে ভাবছেন। ক্ষমতায় যখন আছি, তখন টাকা বানাব। যাদের ক্ষমতা নেই বা যারা এখন ক্ষমতায় নেই, তারা টাকা বানাবে না। অথবা আইন-আদালতের কথা একটু-আধটু হলেও মনে রাখবে। কিন্তু যারা ক্ষমতায় আছে, তারা কিছুই ছাড়বে না। কেউ তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না।
আমাদের প্রধান তিন দলের তিন নেতা তিন দশকের কারণে দীর্ঘজীবিতার দোষে এখন দুষ্ট। এত দিন পাবলিক লাইফে থাকলে ক্ষমতার দণ্ড এবং সারা দেশ আমাকে দেবতা-ফেরেশতা ভাবে—এমন হওয়া অবশ্যম্ভাবী। হয়েছেও তাই।
দীর্ঘজীবিতায় দূষিত নয় অর্থাৎ পাবলিক লাইফে আছেন তুলনামূলকভাবে অল্প দিন অথচ ভালো দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ এবং সৎ এমন লোক দেশে অগণিত। কিন্তু তিন দশকের পুরোনো নেতারা এমন লোক খুঁজে পাবেন না। অথবা তাঁদের চোখে পড়বে না ভালো লোক। চোখে পড়বে শুধু তাঁদের কাছের তোষামোদকারী ও মোসাহেবদেরই।
মোদ্দা কথা, আমাদের রাজনীতি এখন দীর্ঘজীবিতার দোষে ভীষণভাবে দুষ্ট। হাতে-নাতে ধরা পড়ার পরও যদি না সরে দাঁড়ান, তাহলে ধরেই নেব এ দেশের আদর্শ ব্যক্তি বিচারপতি এম এ আজিজ। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘজীবীদের ধারক দল দেশকে লিবিয়া/মিসর/ইয়েমেন/সিরিয়া বানিয়ে ফেলবে। আর আমরা কি পারব না ঢাকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে আমলে না নিতে? দলীয় প্রার্থী তো দলের মতো হবে—এসডিপিই তাদের রাজনীতি। যদি ভাগ্যক্রমে এমন কাউকে পাওয়া যায় যে প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা-প্রার্থী অথচ এসডিপি করবেন না, তাহলে অন্য কথা। তবে সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, প্রার্থিতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তো নেবেন তিন দশকের দীর্ঘজীবী নেতা। অর্থাৎ কোন ধরনের দলীয় নেতাকে মনোনয়ন দেবে, তা যেকোনো কচি খুকিও বলে দিতে পারবে—যে যত বেশি বড় বড় ব্যাগভর্তি ক্যাশ টাকা দিতে পারবে, তার চান্স তত বেশি।
এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এটা হযরত আলীর দেশ। যারা টাকা দিয়ে চাকরি নেয় না তাদের দেশ। সেই দেশটাই বাংলাদেশ। ব্যাংক পাওয়া, টাকা খেয়ে চাকরি বা টেন্ডার দেওয়া, সাগর-রুনির হত্যা তদন্ত হতে না দেওয়া, অর্থাৎ সবকিছুকে অসততায় ছেয়ে দেওয়া লোকেদের দেশ এটা নয়।
আমাদের দেশটাকে আমাদেরই ফেরত নিতে হবে। হাজার হাজার হযরত আলী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন ইটকে বন্দুক দিয়ে ঠেকানো যাবে না।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
No comments