জ্বালানি পরিকল্পনা-বিদ্যুৎ খাতে সাধ ও সাধ্যের মিল হবে কি? by বদরূল ইমাম

একজন সার্থক শিল্পপতি, স্বামী ও পিতা হিসেবে মোখলেস সাহেবের সন্তুষ্টির অভাব নেই। নিজের একটি এবং দুই ছেলের জন্য দুটি গাড়ি বজায় রেখেছেন কেবল সিএনজি জ্বালানির জোরে। তাঁর ভাষায়, প্রায় বিনা মূল্যেই গাড়িগুলো চলে। এক লিটার পেট্রলের দাম ৭৫ টাকা।


ওই সমতুল্য বা সমমানের সিএনজি জ্বালানির (এক ঘনমিটার) দাম ১৬ টাকা। অর্থাৎ বিত্তবান মোখলেস সাহেব ও তাঁর ছেলেরা ৭৫ টাকার পরিবর্তে ১৬ টাকা খরচে গাড়ি চালান। ঢাকা শহরে মোখলেস সাহেবের মতো অনেকে আছেন, যাঁরা সিএনজি জ্বালানির সুবাদে একাধিক গাড়ি রাখার বিলাসিতা করেন। আর শুধু তাঁরাই বা কেন, ছেলে-যুবক-বৃদ্ধ—সবারই শখ একখানা গাড়ি কোনোভাবে কিনে নিলেই হলো—তা চালানোর তো ঝুঁকি নেই, যত দিন সিএনজি জ্বালানি আছে। আর এটিই ঢাকা শহরে পিঁপড়ার পালের মতো প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক যানজটের একটি প্রধান কারণ। যে দেশে অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে, সেখানে বিত্তবান লোকেরা পানির দামে সিএনজি ভরে গাড়ি চালাবেন কেন? তাঁরা পেট্রল বা অকটেন কিনে গাড়ি চালাবেন, তা-ই তো স্বাভাবিক। সুতরাং সরকারের উচিত হবে, প্রাইভেট গাড়িতে সিএনজি সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। উল্লেখ্য, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সিএনজির দাম সবচেয়ে কম। কোরিয়ায় সিএনজি জ্বালানির দাম পেট্রলের দামের ৪৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ৪৮ শতাংশ, ভারতে ৪৩ শতাংশ, ফিলিপাইনে ৩৯ শতাংশ, চীনে ৫৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশে মাত্র ২০ শতাংশ।

২.
বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ বৃদ্ধি স্বভাবতই আমরা কেউ পছন্দ করি না। বিদ্যুতের মূল্য কত তা উৎপাদন খরচের ওপর নির্ভরশীল, যা কিনা নির্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত জ্বালানির প্রকৃতি বা পদ্ধতির ওপর। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ যায়নি—এ রকম গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে সৌরবিদ্যুৎ যেন সভ্যতার জাদুর কাঠি। আর বিদ্যুৎ কিনতে এই দারিদ্র্যপীড়িত লোকদের ইউনিটপ্রতি দাম দিতে হয় ২৫ টাকা। তুলনামূলকভাবে বিত্তবান শহুরে লোকেরা বিদ্যুৎ কেনে ইউনিটপ্রতি দুই থেকে তিন টাকায়। অর্থাৎ দেশের সর্বাপেক্ষা দরিদ্র জনগোষ্ঠী সর্বোচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করে থাকে। সৌর জ্বালানির বিদ্যুতায়ন প্রযুক্তি এখনো বড় ব্যয়বহুল; যদিও ভবিষ্যতে কোনো একসময় এর ব্যয় কমে আসবে বলে আশা করা হয়। তুলনামূলকভাবে কয়লা বা গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম, তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কয়লা বা গ্যাসের চেয়ে বেশি (গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট গড়ে দুই টাকা, তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ গড়ে ইউনিটপ্রতি সাত থেকে ১৩ টাকা)। বাংলাদেশে ২০১০ সাল পর্যন্ত মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৮৮ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে উৎপাদিত হয়ে এসেছে, যে কারণে তুলনামূলকভাবে কম মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা গেছে। কিন্তু দেশের ক্রমবর্ধমান গ্যাস-সংকট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে বাধ্য করছে।
ইতিমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং কোনো কোনোটি বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে; যদিও এগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। ইতিমধ্যে বিদ্যমান চরম বিদ্যুৎ-সংকটকে সামাল দেওয়ার জন্য বহুসংখ্যক তেলভিত্তিক (ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল) বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। তেলভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানোর জন্য বর্তমান অর্থবছরে আগের তুলনায় অতিরিক্ত তেল আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাবমতে, এ জন্য এই বছর তেল আমদানি বাবদ আগের বছরের তুলনায় অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি খরচ হবে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা তেলের মূল্যকে আবার ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে, যা কিনা তেল আমদানির খরচকে আরও বৃদ্ধি করবে। গ্যাসের পরিবর্তে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মানে উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি। আর এ কারণে বিদ্যুতের দামও বৃদ্ধি পাবে। সরকারি ভর্তুকি এ বর্ধিত দামের কতটা নিজে বহন করতে পারে, তা দেখার বিষয়।

৩.
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন জ্বালানির ব্যবহার মাত্রায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটা অবশ্যম্ভাবী। বিগত কয়েক দশকে গ্যাসই ছিল এককভাবে জ্বালানির প্রধান অংশীদার। ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত জ্বালানির মিশ্রণ ছিল এরূপ—গ্যাস ৮৮ শতাংশ, তেল ৬ শতাংশ, কয়লা ৪ শতাংশ ও জলবিদ্যুৎ ২ শতাংশ। কিন্তু গ্যাসের ক্রমবর্ধমান অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য জ্বালানির অংশীদারি না বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এক সূত্রমতে, ২০১৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি মিশ্রণের চিত্রটা অনেকটা হবে এরূপ—গ্যাস ৬৮ শতাংশ, তেল ২৭ শতাংশ, কয়লা ৩ শতাংশ ও জলবিদ্যুৎ ২ শতাংশ। ২০১৪ সাল-পরবর্তী সময়ে অবশ্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়লার অংশীদারি বৃদ্ধি পাবে। এক প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে নয় হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে মোট উৎপাদনের ২০ শতাংশ। একই প্রাক্কলনে ধরা হয়, ২০২০ সালে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৩০ শতাংশ কয়লাভিত্তিক হবে, যা কিনা ২০২৫ সালে ৫১ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভবিষ্যৎ বিদ্যুতের চাহিদা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং তা উৎপাদনে জ্বালানিসমূহের ব্যবহার সম্পর্কিত প্রাক্কলনে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা বিদ্যমান এবং তা সময় ও পরিবর্তিত বাস্তব পরিস্থিতির প্রভাবে প্রভাবিত। তবে দেশে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি ও তাকে মূলধারায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ইতিমধ্যে এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। আরও বেশসংখ্যক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কিন্তু মূল একটি বিষয়ই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তা হলো, এ কয়লা আসবে কোথা থেকে? দেশে যে কয়লা মজুদ রয়েছে, তা থেকে পর্যাপ্ত কয়লা উৎপাদন সম্ভব, যদি উন্মুক্ত খনি পদ্ধতিতে কয়লা ্রওঠানো হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের অবস্থান কঠোর বলে মনে হয়। মূল্যবান ফসলি জমি নষ্ট, বিপুল জনগোষ্ঠী স্থানান্তর ও পরিবেশ বিনষ্টের আশঙ্কা বিষয়টিকে আরও জটিল করে ফেলেছে। সরকারের পক্ষে স্থানীয় জনগণকে আস্থায় এনে সমস্যাটির সমঝোতামূলক সমাধান করা ছাড়া উপায় নেই। অন্য বিকল্প পন্থা বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করা। কিন্তু তাতে কয়লা ব্যবহারের খরচ বাড়বে নিঃসন্দেহে। বাস্তবায়নমুখী ও পরিকল্পিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কয়লা কোথা থেকে আসবে বা তা কী দামে আসবে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য জনগণের জানা নেই।

৪.
কথায় বলে, ‘যে জনের রুটি কিনতে দিন ফুরায়, তার পক্ষে কেক কিনতে যাওয়া বিলাসিতা মাত্র।’ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন নিজস্ব গ্যাস ব্যবহারের প্রয়োজনে যে অবকাঠামো তৈরি করেছে, তা দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে চলেছে ও চলবে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি প্রায় দেড় ডলার এবং সামগ্রিকভাবে গড়ে প্রায় দুই ডলার। দেশে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর অধিক নির্ভরশীলতা আমরা পছন্দ করি না। কারণ, তাদের কাছ থেকে অধিকতর মূল্যে আমাদের গ্যাস কিনতে হয়, যার দাম গড়ে ইউনিটপ্রতি তিন ডলার।
সম্প্রতি দেশের গ্যাস-সংকট মেটানোর জন্য সরকার ‘এলএনজি’ (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এলএনজি আমদানির মাধ্যমে যে গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার দাম পড়বে ইউনিটপ্রতি ১০ থেকে ১২ ডলার। শুধু তাই নয়, জাহাজ থেকে এলএনজি নামানো ও তা পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার জন্য বিশেষ ধরনের এলএনজি টার্মিনাল এবং গ্যাসকরণ প্ল্যান্ট প্রয়োজন, যা নির্মাণ করতে বিলিয়ন ডলারের ঊর্ধ্বে খরচ করতে হবে। কোন অর্থনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এলএনজি অবকাঠামো তৈরি করে ১০ থেকে ১২ ডলার মূল্যের গ্যাস কেনার পরিকল্পনা করল, তা বোধগম্য নয়।
ইতিমধ্যে কাতার থেকে এলএনজি আমদানির জন্য সে দেশের সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে এবং দেশে এলএনজি সামুদ্রিক টার্মিনাল বানানোর জন্য দরপত্র আহ্বান ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সরকার এ গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এত উচ্চমূল্যের জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কত দামে তা জনগণকে দেবে, তার কোনো হিসাব করা হয়েছে কি?
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.