তরুণের জয়গান: সংগীত-প্রিয়াংকা গোপ সুরের সাধন by মাহমুদুজ্জামান বাবু
বাবা বাসুদেব চন্দ্র গোপের খুব চাওয়া ছিল, দুই মেয়েই শিল্পসংস্কৃতির সঙ্গে জীবনের মিতালি করুক। প্রিয়াংকাকে ভর্তি করা হলো নাচ শেখার ক্লাসে আর বড় বোন গাইতে শুরু করলেন। কিন্তু প্রিয়াংকার ঝোঁক ছিল গানের দিকেই বেশি। ঝোঁক বেশি হলেই তো হবে না, গানটা তো গেয়ে দেখাতেও হবে যে আমিও পারি।
শুনে শুনে গলায় তুলে নেওয়ার অসাধারণ দক্ষতা প্রিয়াংকার ছিল। ফলে তাঁর গান শেখার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল পরিবারের কাছে। নাচ, নাচতে নাচতে চলে গেল অন্য কোনো নৃত্যালয়ে। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলে পড়তেন প্রিয়াংকা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় সেখানকার উদীচীতে গানের ক্লাসে ভর্তি। গানের গুরু হিসেবে পেলেন আনন্দ চক্রবর্তীকে। চলতে থাকল গান শেখা। মাঝেমধ্যে সেখানে আসতেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক ড. অসিত রায়। প্রিয়াংকার গান শেখা হাঁটতে থাকল উৎকর্ষের পথে। এরই মধ্যে স্কুল শেষ হলো। উচ্চমাধ্যমিকও শেষ হলো। বিজ্ঞানের ছাত্রী। কুমুদিনী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগও অবারিত। কী করবেন প্রিয়াংকা? সংগীত গুরু ড. অসিত রায় পরিবারকে বোঝালেন, ‘এখন সংগীতেই ওর উচ্চতর শিক্ষা দরকার। ভারত সরকারের বৃত্তির জন্য আবেদন করুক, না পেলে মেডিকেলে পড়বে।’ প্রিয়াংকা আবেদন করলেন এবং বৃত্তিটা পেয়েও গেলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ছয়তলায় নিজের কক্ষে বসে এই গল্পগুলো বলছিলেন প্রিয়াংকা। যখন বৃত্তি পাওয়ার কথা উঠে এসেছিল গল্পে, তখন সেদিনের আনন্দটাও উঁকি দিচ্ছিল এদিক-ওদিক থেকে। আনন্দের পাশাপাশি সেদিন ভয়ও পেয়েছিলেন। বললেন, ‘বৃত্তি পাওয়ার পর ভয়ও লাগছিল। না জানি ওখানে গিয়ে কী পরিস্থিতিতে পড়ি! সেখানে কত বড় বড় শিক্ষক, গুরু। কিন্তু কয়েক দিন পরই ভয়টা কাটল। গানের জগৎই তো। ভয় কাটল, কিন্তু নতুন অস্বস্তি শুরু হলো। কারণ, আমি ছাড়া আর সবাই গাইয়ে বা পারফরমার হিসেবে পরিপক্ব, ওখানে আমার ক্লাসে। আমি গিয়েছি শিখতে আর অন্যরা এসেছে ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট নিতে। ফলে আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে অনেক। ওখানকার শিক্ষাদান পদ্ধতি একদমই আলাদা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষার্থী হয়, তারা আগে থেকেই শিখে এসেছে ধরে নিয়ে শিক্ষকেরা শিক্ষাদান করেন।’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয়াংকার অনার্স কোর্স ছিল তিন বছরের, মাস্টার্স দুই বছরের। শুরু থেকেই মগ্নতায় ডুব দিয়েছিলেন প্রিয়াংকা। ফলাফলও তাই আলো ঝলমল। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। ২০১০ সালে যোগ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। এখানকার শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণটিও পরিষ্কার। বললেন, ‘এখানে সবাই কিছু না শিখেই ভর্তি হয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে সা-রে-গা-মা থেকে শেখানো শুরু করতে হয়। ফলে গভীরতর শিক্ষার জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতে সময় লেগে যায় অনেক। আর চারপাশের অস্থির সময়, সমাজ পরিস্থিতি তো আছেই। সংগীতচর্চা প্রার্থনার মতো। শেয়ারবাজারের মতো লাভ-লোকসান ভাবলে ভুল হয়। একটা জীবনবোধের বিষয়। কিন্তু এটা সিলেবাসে লেখা থাকে না। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সেটা শেখান, শেখাবেন।’
মা ভানুরানী গোপ ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন প্রিয়াংকাকে। বাবা অতশত হইচই পছন্দ করতেন না। এসব ঘটত বাবার অজ্ঞাতে। প্রিয়াংকার কৃতজ্ঞতা তাই মায়ের প্রতি বেশি। বিয়ের পরে এখন সেটা করেন শাশুড়ি-মা। বিয়ে করেছেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। স্বামী সুবীর মিত্র। হয়তো কোনো টিভি চ্যানেল ভালো কোনো গান শোনাচ্ছে, প্রিয়াংকার হাতের কাজ কেড়ে নিলেন শাশুড়ি জয়ন্তী মিত্র, ঠেলে পাঠালেন গান শুনতে; কিংবা প্রাত্যহিক রেওয়াজে বসতে ফুসরত মিলছে না, তখন ১১ মাসের মেয়ে রাজন্তীকে সামলাচ্ছেন তিনি। কৃতজ্ঞ হূদয় নিয়ে প্রিয়াংকা সুরদেবতার সঙ্গে আলাপ আর বিস্তারের হাত ধরে হাঁটতে থাকেন নির্ভার। পেয়েছেন বহু পুরস্কার-স্বীকৃতি। পুরস্কারের ভারে প্রিয়াংকা কি পুলকিত?
আমরা তালিকার খানিকটা দেখে নিই—রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আচার্য উদয় ভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমিতে নজরুল সংগীতে প্রথম, ঠুমরিতে প্রথম, খেয়ালে দ্বিতীয়(২০০৪)।
ডোবারল্যান্ড মিউজিক কনফারেন্স, ২০০৮ ঠুমরি ও খেয়ালে চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে প্রথম মানে ১ম(২০০০)। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে নজরুলসংগীতে স্বর্ণপদক (২০০১)।
গুরুদের কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই? তাঁদের বিশেষ কোনো পরামর্শ? জীবনবোধ? জবাব দিতে গিয়ে বিনত এবং সজল হয়ে ওঠেন প্রিয়াংকা। বলেন, ‘রবীন্দ্রভারতীতে আমার গুরু ছিলেন পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী। কী যে শান্ত সমাহিত রূপ তাঁর! একদম দরবেশের মতো। আমি কোনো দিন তাঁর চোখের দিকে তাকাতাম না। মাথা নিচু করে গাইতাম। তিনি শুধরে দিতেন। এখনো যখন চর্চায় বা শিক্ষাদানে বসি, সেই শান্তিটা খুঁজি। অবিনশ্বর শান্তি। সংগীত তো তা-ই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ছয়তলায় নিজের কক্ষে বসে এই গল্পগুলো বলছিলেন প্রিয়াংকা। যখন বৃত্তি পাওয়ার কথা উঠে এসেছিল গল্পে, তখন সেদিনের আনন্দটাও উঁকি দিচ্ছিল এদিক-ওদিক থেকে। আনন্দের পাশাপাশি সেদিন ভয়ও পেয়েছিলেন। বললেন, ‘বৃত্তি পাওয়ার পর ভয়ও লাগছিল। না জানি ওখানে গিয়ে কী পরিস্থিতিতে পড়ি! সেখানে কত বড় বড় শিক্ষক, গুরু। কিন্তু কয়েক দিন পরই ভয়টা কাটল। গানের জগৎই তো। ভয় কাটল, কিন্তু নতুন অস্বস্তি শুরু হলো। কারণ, আমি ছাড়া আর সবাই গাইয়ে বা পারফরমার হিসেবে পরিপক্ব, ওখানে আমার ক্লাসে। আমি গিয়েছি শিখতে আর অন্যরা এসেছে ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট নিতে। ফলে আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে অনেক। ওখানকার শিক্ষাদান পদ্ধতি একদমই আলাদা। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষার্থী হয়, তারা আগে থেকেই শিখে এসেছে ধরে নিয়ে শিক্ষকেরা শিক্ষাদান করেন।’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয়াংকার অনার্স কোর্স ছিল তিন বছরের, মাস্টার্স দুই বছরের। শুরু থেকেই মগ্নতায় ডুব দিয়েছিলেন প্রিয়াংকা। ফলাফলও তাই আলো ঝলমল। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। ২০১০ সালে যোগ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। এখানকার শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণটিও পরিষ্কার। বললেন, ‘এখানে সবাই কিছু না শিখেই ভর্তি হয়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে সা-রে-গা-মা থেকে শেখানো শুরু করতে হয়। ফলে গভীরতর শিক্ষার জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতে সময় লেগে যায় অনেক। আর চারপাশের অস্থির সময়, সমাজ পরিস্থিতি তো আছেই। সংগীতচর্চা প্রার্থনার মতো। শেয়ারবাজারের মতো লাভ-লোকসান ভাবলে ভুল হয়। একটা জীবনবোধের বিষয়। কিন্তু এটা সিলেবাসে লেখা থাকে না। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সেটা শেখান, শেখাবেন।’
মা ভানুরানী গোপ ছোটবেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতেন প্রিয়াংকাকে। বাবা অতশত হইচই পছন্দ করতেন না। এসব ঘটত বাবার অজ্ঞাতে। প্রিয়াংকার কৃতজ্ঞতা তাই মায়ের প্রতি বেশি। বিয়ের পরে এখন সেটা করেন শাশুড়ি-মা। বিয়ে করেছেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। স্বামী সুবীর মিত্র। হয়তো কোনো টিভি চ্যানেল ভালো কোনো গান শোনাচ্ছে, প্রিয়াংকার হাতের কাজ কেড়ে নিলেন শাশুড়ি জয়ন্তী মিত্র, ঠেলে পাঠালেন গান শুনতে; কিংবা প্রাত্যহিক রেওয়াজে বসতে ফুসরত মিলছে না, তখন ১১ মাসের মেয়ে রাজন্তীকে সামলাচ্ছেন তিনি। কৃতজ্ঞ হূদয় নিয়ে প্রিয়াংকা সুরদেবতার সঙ্গে আলাপ আর বিস্তারের হাত ধরে হাঁটতে থাকেন নির্ভার। পেয়েছেন বহু পুরস্কার-স্বীকৃতি। পুরস্কারের ভারে প্রিয়াংকা কি পুলকিত?
আমরা তালিকার খানিকটা দেখে নিই—রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আচার্য উদয় ভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত একাডেমিতে নজরুল সংগীতে প্রথম, ঠুমরিতে প্রথম, খেয়ালে দ্বিতীয়(২০০৪)।
ডোবারল্যান্ড মিউজিক কনফারেন্স, ২০০৮ ঠুমরি ও খেয়ালে চ্যাম্পিয়ন। বাংলাদেশে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে প্রথম মানে ১ম(২০০০)। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে নজরুলসংগীতে স্বর্ণপদক (২০০১)।
গুরুদের কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই? তাঁদের বিশেষ কোনো পরামর্শ? জীবনবোধ? জবাব দিতে গিয়ে বিনত এবং সজল হয়ে ওঠেন প্রিয়াংকা। বলেন, ‘রবীন্দ্রভারতীতে আমার গুরু ছিলেন পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী। কী যে শান্ত সমাহিত রূপ তাঁর! একদম দরবেশের মতো। আমি কোনো দিন তাঁর চোখের দিকে তাকাতাম না। মাথা নিচু করে গাইতাম। তিনি শুধরে দিতেন। এখনো যখন চর্চায় বা শিক্ষাদানে বসি, সেই শান্তিটা খুঁজি। অবিনশ্বর শান্তি। সংগীত তো তা-ই।’
No comments