ঘরেতেও এসেছে সে by শেখ রোকন
প্রথম দিন থেকে না হলেও আষাঢ় এবার স্বমূর্তিতে। সামান্য বিরতি দিয়ে দিয়ে অঝোরে ভিজিয়ে চলছে বরষার প্রথম কদমফুল। অথচ মাত্র গত আষাঢ়-শ্রাবণও ছিল কেবল নামেই বর্ষাকাল। বস্তুত গত কয়েক বছর ধরে বর্ষাপ্রেমী বাঙালির দশা ছিল কিনু গোয়ালার গলিতে থাকা রবীন্দ্রনাথের সেই নায়কের মতো।
নিজের অপর্যাপ্ততা জেনে শুভ লগ্নে যে নায়িকাকে রেখে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু ঘরে না এলেও 'মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া' ছিল। গত ক'বছর বঙ্গীয় বদ্বীপে পঞ্জিকা মেনে আষাঢ়-শ্রাবণ এসেছে ঠিকই; বর্ষার দেখা ছিল না। এবার 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে'।
কেন এবার ক্যালেন্ডার মেনে বর্ষা নামল? কেন গত কয়েক বছরের আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টির দেখা ছিল না? কবিরা নিশ্চয়ই বলবেন, আকাশে মেঘের মেলা জমেছে বর্ষাগ্রস্ত বাঙালির প্রাণের ডাকে সারা দিয়ে। কিন্তু আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা জানেন, বঙ্গীয় বর্ষা আসলে বৈশ্বিক জলবায়ুর খেলা। জলবায়ুতে সর্বনাশা পরিবর্তনের কারণেই গত কয়েক বছর ধরে আষাঢ়ের পাওনা মেটাতে আকাশের এত কার্পণ্য। আরও ভেঙে বললে বলতে হবে, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের ঝগড়ার কথা। ভারত মহাসাগরের এই দুই বোন জুন-জুলাই এলে মেঘ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। যে আগে হতাশায় (নিম্নচাপ, ইংরেজিতে ডিপ্রেশান) ভুগতে থাকে সেসব মেঘকে নিজের কাছে ডেকে নেয়। আরব সাগরে নিম্নচাপ হলে পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তান বৃষ্টিতে ভেজে; আর বঙ্গোপসাগরে মেঘ জমা মানে পূর্ব ভারত তথা বাংলার চিরায়ত বর্ষা, বৃষ্টিঘন আষাঢ়-শ্রাবণ।
সাগর কেন হতাশায় ভোগে, সে ভিন্ন ও বিস্তৃত আলোচনা। এল নিনো ও লা নিনা নামে অন্য দুই ভাইবোনের গল্প। এখনকার কথা হচ্ছে, গত বছর জুনে আরব সাগরে ঘন ঘন নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছিল; আর উল্টোটা ঘটেছিল বঙ্গোপসাগরে। ফলে বাংলা ও আসামে বর্ষা ছিল না; মনের আনন্দে ভিজেছিল পাঞ্জাব, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ। এবার, বেশ কয়েক বছর পর, ঠিক বিপরীত পরিস্থিতি। আরব সাগরে ঘন ঘন নিম্নচাপ নেই। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের মুড আষাঢ়ের প্রথম থেকেই অফ। ঘন ঘন নিম্নচাপে সব মেঘ নিজের কাছে ডেকে আনছে। আর গঙ্গা-যমুনা অববাহিকায় 'আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে' বর্ষাপ্রেমীদের মন কিছুতেই বসছে না।
তার মানে, আষাঢ়ে কাঙ্ক্ষিত বর্ষণে কি জলবায়ু পরিবর্তনের চক্রান্তও ভেসে গেল? যারা ভাবছেন এবারের আকাশ ভরা মেঘ বোধহয় আশার দিগন্ত থেকে উঠে আসা, তাদের জন্য দুঃসংবাদ_ আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিবসেই ঝমঝমিয়ে নামলেও এই বৃষ্টি চিরচেনা বর্ষা নয়। আমাদের বন্ধু বর্ষা এ দেশে প্রবেশ করে সাধারণত উত্তর দিক থেকে। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা মৌসুমি বায়ুতে ভর করে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ প্রথমে মিয়ানমার ও আসাম হয়ে হিমালয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। তারপর বৃষ্টি হয়ে বাংলার বুকে ঝরতে ঝরতে দক্ষিণে পাড়ি জমায়। যে কারণে বর্ষা শুরু হয় প্রথমে উত্তরবঙ্গে। পরে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপও দক্ষিণ দিক থেকে মেঘ পাঠায়; কিন্তু সেটা আষাঢ়ে নয়, প্রায় শ্রাবণে। এবার উত্তরের বর্ষার এখনও দেখা নেই। বর্ষার এমন উল্টোযাত্রা বোধহয় সেই জলবায়ু শয়তানেরই কারসাজি। আর ঘন ঘন নিম্নচাপ মানে কিন্তু সমুদ্রগামী জেলেদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হওয়া।
এসব বিজ্ঞানের প্যাঁচাল। বাঙালি সাহিত্যের প্রেমিক। হোক না উল্টো রথে; হোক না আরও শঙ্কা-জাগানিয়া; বর্ষাযাপন বাদ দিয়ে এত তত্ত্ব জানার প্রয়োজন কী? রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে বললে_ 'বর্ষা-ঋতু নিস্প্রয়োজনের ঋতু। অর্থাৎ তাহার সংগীতে তাহার সমারোহে, তাহার অন্ধকারে তাহার দীপ্তিতে, তাহার চাঞ্চল্যে তাহার গাম্ভীর্যে তাহার সমস্ত প্রয়োজন কোথায় ঢাকা পড়িয়া গেছে। এই ঋতু ছুটির ঋতু।'
skrokon@gmail.com
কেন এবার ক্যালেন্ডার মেনে বর্ষা নামল? কেন গত কয়েক বছরের আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টির দেখা ছিল না? কবিরা নিশ্চয়ই বলবেন, আকাশে মেঘের মেলা জমেছে বর্ষাগ্রস্ত বাঙালির প্রাণের ডাকে সারা দিয়ে। কিন্তু আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা জানেন, বঙ্গীয় বর্ষা আসলে বৈশ্বিক জলবায়ুর খেলা। জলবায়ুতে সর্বনাশা পরিবর্তনের কারণেই গত কয়েক বছর ধরে আষাঢ়ের পাওনা মেটাতে আকাশের এত কার্পণ্য। আরও ভেঙে বললে বলতে হবে, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরের ঝগড়ার কথা। ভারত মহাসাগরের এই দুই বোন জুন-জুলাই এলে মেঘ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে। যে আগে হতাশায় (নিম্নচাপ, ইংরেজিতে ডিপ্রেশান) ভুগতে থাকে সেসব মেঘকে নিজের কাছে ডেকে নেয়। আরব সাগরে নিম্নচাপ হলে পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তান বৃষ্টিতে ভেজে; আর বঙ্গোপসাগরে মেঘ জমা মানে পূর্ব ভারত তথা বাংলার চিরায়ত বর্ষা, বৃষ্টিঘন আষাঢ়-শ্রাবণ।
সাগর কেন হতাশায় ভোগে, সে ভিন্ন ও বিস্তৃত আলোচনা। এল নিনো ও লা নিনা নামে অন্য দুই ভাইবোনের গল্প। এখনকার কথা হচ্ছে, গত বছর জুনে আরব সাগরে ঘন ঘন নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছিল; আর উল্টোটা ঘটেছিল বঙ্গোপসাগরে। ফলে বাংলা ও আসামে বর্ষা ছিল না; মনের আনন্দে ভিজেছিল পাঞ্জাব, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ। এবার, বেশ কয়েক বছর পর, ঠিক বিপরীত পরিস্থিতি। আরব সাগরে ঘন ঘন নিম্নচাপ নেই। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের মুড আষাঢ়ের প্রথম থেকেই অফ। ঘন ঘন নিম্নচাপে সব মেঘ নিজের কাছে ডেকে আনছে। আর গঙ্গা-যমুনা অববাহিকায় 'আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে' বর্ষাপ্রেমীদের মন কিছুতেই বসছে না।
তার মানে, আষাঢ়ে কাঙ্ক্ষিত বর্ষণে কি জলবায়ু পরিবর্তনের চক্রান্তও ভেসে গেল? যারা ভাবছেন এবারের আকাশ ভরা মেঘ বোধহয় আশার দিগন্ত থেকে উঠে আসা, তাদের জন্য দুঃসংবাদ_ আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিবসেই ঝমঝমিয়ে নামলেও এই বৃষ্টি চিরচেনা বর্ষা নয়। আমাদের বন্ধু বর্ষা এ দেশে প্রবেশ করে সাধারণত উত্তর দিক থেকে। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা মৌসুমি বায়ুতে ভর করে ঝাঁকে ঝাঁকে মেঘ প্রথমে মিয়ানমার ও আসাম হয়ে হিমালয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। তারপর বৃষ্টি হয়ে বাংলার বুকে ঝরতে ঝরতে দক্ষিণে পাড়ি জমায়। যে কারণে বর্ষা শুরু হয় প্রথমে উত্তরবঙ্গে। পরে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপও দক্ষিণ দিক থেকে মেঘ পাঠায়; কিন্তু সেটা আষাঢ়ে নয়, প্রায় শ্রাবণে। এবার উত্তরের বর্ষার এখনও দেখা নেই। বর্ষার এমন উল্টোযাত্রা বোধহয় সেই জলবায়ু শয়তানেরই কারসাজি। আর ঘন ঘন নিম্নচাপ মানে কিন্তু সমুদ্রগামী জেলেদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হওয়া।
এসব বিজ্ঞানের প্যাঁচাল। বাঙালি সাহিত্যের প্রেমিক। হোক না উল্টো রথে; হোক না আরও শঙ্কা-জাগানিয়া; বর্ষাযাপন বাদ দিয়ে এত তত্ত্ব জানার প্রয়োজন কী? রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে বললে_ 'বর্ষা-ঋতু নিস্প্রয়োজনের ঋতু। অর্থাৎ তাহার সংগীতে তাহার সমারোহে, তাহার অন্ধকারে তাহার দীপ্তিতে, তাহার চাঞ্চল্যে তাহার গাম্ভীর্যে তাহার সমস্ত প্রয়োজন কোথায় ঢাকা পড়িয়া গেছে। এই ঋতু ছুটির ঋতু।'
skrokon@gmail.com
No comments