হায় ইলিশ by রাজীব আহমেদ

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল শুক্রবার চৈত্রের শেষ দিনের সকাল। বিক্রেতা বড় আকারের দুটি ইলিশের দাম হাঁকলেন ১৫ হাজার টাকা। অমন ইলিশ খুব একটা দেখা যায় না। তাই অনেকেই কৌতূহলের বশে দাম জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু দাম শোনার পর আগ্রহ মিইয়ে যায়। তবে বিক্রেতা নির্বিকার।


এই ঢাকায় পকেটভর্তি টাকাওয়ালার অভাব নেই!
১৫ হাজার টাকা! একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের তিন মাসের সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজের মজুরি। ১৫ হাজার টাকা দিয়ে আট মণ ভালো মানের মিনিকেট চাল কেনা সম্ভব। ১৫ হাজার টাকা একটি উচ্চ বেতনের চাকরিজীবীর পরিবারের মাসের বাজার খরচের সমান। এ দেশে বেশির ভাগ পরিবারই সংসার চালায় মাত্র ১৫ হাজার টাকায়। তবুও আজ পহেলা বৈশাখ শনিবার রাজধানীসহ সারা দেশে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত অনেকের বাড়িতে ম-ম করবে ভাজা ইলিশের গন্ধ।
যাদের পরিবারে সকাল বেলা পান্তা-ইলিশ খেতেই হবে, তাদের জন্য বিকল্প অবশ্য আছে। গতকালও বাজারে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে ইলিশ মাছ মিলেছে। তবে তা গত বছর অথবা কয়েক মাস আগে ধরা হিমাগারে রাখা ইলিশ। ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের এসব ইলিশ থেকে মাথা ও লেজ বাদে চার টুকরা মাছ কাটা সম্ভব। আর একে রুপালি ইলিশ বলা যাবে না। কারণ হিমাগারে থাকতে থাকতে এসব লালচে হয়ে গেছে। এমনভাবে জমাট বেঁধেছে যে এক কেজি কেনার পর বরফ গলে গেলে প্রায় ২০০ গ্রাম ওজন কমেও যায়।
বিক্রেতারা জানান, এ বছর নববর্ষ উপলক্ষে বাজারে ইলিশের সরবরাহ অন্য বছরের চেয়ে কম। মার্চ ও এপ্রিল দুই মাস প্রজনন মৌসুমের কারণে ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এ ছাড়া নদীতে মাছ কম। ফলে বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ আসছে না। তবে মিয়ানমার থেকে কিছু ইলিশ আসছে- নাম বার্মাইয়া ইলিশ।
ঢাকা মহানগর মাছ ও কাঁচাবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, এ বছর বাজারে সরবরাহ খুবই কম। গত তিন দিন বরিশালের বিভিন্ন জেলা ঘুরেও এক কেজি ওজনের কোনো ইলিশ পাওয়া যায়নি। এক মণ ইলিশ ধরা পড়লে তাতে দু-তিনটি থাকে বড় ইলিশ, যা নৌকায় থাকতেই রপ্তানির জন্য প্যাকেটজাত করা হয়।
আনোয়ার হোসেন বলেন, এবারে নববর্ষ উপলক্ষে যে মাছ এসেছিল, এর ৭০ ভাগ বরিশাল, ঢাকা ও চট্টগ্রামের হিমাগারের মাছ। এসব মাছ গত বছর অথবা চার-পাঁচ মাস আগে কম দামের সময় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিছু বড় মাছ মিয়ানমার থেকে এসেছে। বিক্রেতারা আরো বলেন, শুক্রবার বাজার এমনিতেই চড়া থাকে। এ বছর নববর্ষের আগের দিন শুক্রবার হওয়ায় আরো চড়া ছিল ইলিশের আকাল স্বাভাভিকভাবেই ঢাকার বাইরেও। আমাদের লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গতকাল লৌহজংয়ের মাওয়া পাইকারি মাছ বাজারে এক হালি ইলিশ বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা দামে। আবদুল মোমিন নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ী এ দামে এক হালি ইলিশ কিনে বাজারে আলোচনার ঝড় তোলেন। এক কেজি ওজনের এক হালি ইলিশ গত দু-তিন দিন আগেও মাওয়া ঘাটে বিক্রি করা হয়েছে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। এক কেজির চেয়েও কম ওজনের ইলিশের হালি মাওয়ায় গতকাল বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। মাঝারি সাইজের এক হালি ইলিশ ছয় থেকে ৯ হাজার, ছোট সাইজের এক হালি ইলিশ বিক্রি হয়েছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়।
এদিকে গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম চাওয়া হয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। এক কেজির কিছুটা কম ওজনের ইলিশের দাম চাওয়া হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। আধা কেজি ওজনের ইলিশের দাম চাওয়া হয়েছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। আর চারটিতে এক কেজি হয় এমন ইলিশের দাম বিক্রেতারা চেয়েছেন প্রতিটি ২৫০ টাকা দরে।
গতকাল কারওয়ান বাজার থেকে মাঝারি আকারের এক জোড়া ইলিশ কিনেছেন ব্যবসায়ী ইলিয়াস উদ্দিন। দুটি ইলিশের দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা বলে জানিয়ে তিনি বলেন, 'নতুন বছরের প্রথম দিন আত্মীয়স্বজন বাসায় আসবে। নিজের ছেলেমেয়েরাও পান্তা-ইলিশ খেতে চায়। একটু বেশি খরচ হলেও তাদের সাধ তো পূরণ করতেই হবে।'
ঢাকার অলিগলিতে গত কয়েক দিন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারাও প্রচুর ইলিশ বিক্রি করেছেন। এমনই একজন বিক্রেতা কাজীপাড়ার আবদুস সালাম জানান, তিনি কারওয়ান বাজারের আড়ত থেকে শুক্রবার সকালে প্রতি হালি ছোট আকারের ইলিশ ৬০০ টাকা দরে কিনেছেন। আর মাঝারি আকারের ইলিশ কিনেছেন হালিপ্রতি এক হাজার ৮০০ টাকা দরে। সকালে ছোট ইলিশ হালিপ্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা ও মাঝারি আকারের ইলিশের জোড়া এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। রাতে তাঁকে কিছুটা কম দামে বিক্রি করতে হবে। কারণ সকালে কেনা মাছের রং রাতে লালচে হয়ে যাবে।
নিজের বাসায় পহেলা বৈশাখে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ইলিশ ভাজা খাবেন কি না জানতে চাইলে আবদুস সালাম বলেন, 'এত দামি মাছ নিজে খাইলে হইব?' তিনি জানান, গতকাল তিনি ১৫ হাজার টাকার মাছ কিনেছিলেন বিক্রির জন্য। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা এক লোকের কাছ থেকে ঋণ করে এনেছেন ৫০০ টাকা সুদে। ওই সুদের টাকা দেওয়ার পর তাঁর হাজারখানেক টাকা লাভ থাকতে পারে। সন্ধ্যার মধ্যে বিক্রি না হলে একটি মাছ বাড়িতে নিয়েও যেতে পারেন তিনি।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে বছর বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট ইলিশ উৎপাদন হয়েছে তিন লাখ ১৩ হাজার টন। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ১০০ টন, যা টাকায় ১২৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার টন। এর মধ্যে ৩৫২ কোটি টাকায় সাড়ে আট হাজার টন রপ্তানি হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৬০ হাজার টন।
ইলিশ রক্ষায় জাটকা নিধন কর্মসূচির আওতায় ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর মার্চ ও এপ্রিল পদ্মা ও মেঘনায় দুই মাস ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। নিষিদ্ধ মৌসুমে জেলেদের কোনো কাজ থাকে না বলে তাদের বিনা মূল্যে চাল দেয় সরকার।

No comments

Powered by Blogger.